দূষিত বায়ুর শহর ঢাকা
- মামুন আল করিম
- ২৬ নভেম্বর ২০১৯, ০০:০০
বিশ্বের বায়ুদূষণ পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা এয়ার ভিজুয়ালের পর্যবেক্ষণে জানা গেছে, বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহরের তালিকায় শীর্ষস্থানটি ছয়টি শহরের মধ্যে পরিবর্তন হচ্ছে। কখনো ঢাকা, আবার কখনো দিল্লি। ঢাকা শহরের বায়ুর মান এক মাস ধরেই অস্বাস্থ্যকর হয়ে উঠেছে। তবে তা সময়ে সময়ে বদলাচ্ছে। কখনো অস্বাস্থ্যকর, কখনো বা খুবই অস্বাস্থ্যকর, আবার কখনো মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে উঠছে এই শহরের বায়ু। গত রোববার রাত পৌনে ৯টায় বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহরের মধ্যে দিল্লির অবস্থান ছিল চতুর্থ। দিল্লিকে পেছনে ফেলে তখন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার অবস্থান ছিল প্রথম।
তাপমাত্রা কমার সাথে সাথে শহরের বাতাসে ভাসমান ভারী বস্তুকণা পিএম ২.৫ ও পিএম ১০-এর পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। এয়ার ভিজিুয়াল নামের সংস্থাটি ঢাকার মোট ছয়টি স্থানের বায়ুর মান পর্যবেক্ষণ করে থাকে। গুলশান, মিরপুরের রোকেয়া সরণি, বারিধারা, উত্তরা ও নর্দা এলাকায় বাংলাদেশে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসে স্থাপন করা যন্ত্র থেকে তারা ঢাকার বায়ুর মান পর্যবেক্ষণ করে থাকে। এসব স্থানে স্থাপন করা যন্ত্র থেকে প্রতি ঘণ্টায় পাওয়া তথ্য তারা তাদের ওয়েবসাইট ও অ্যাপসের মাধ্যমে তুলে ধরে।
এ ব্যাপারে পরিবেশ অধিদফতরের বায়ুর মান বিভাগের পরিচালক জিয়াউল হক জানিয়েছেন, ঢাকায় তাপমাত্রা কমতে থাকলে বাতাসে ভারী বস্তুকণার পরিমাণ বেড়ে যায়। ফলে বাতাস দূষিত হতে শুরু করে। কোনো একটি একক সংস্থা বা উৎস থেকে রাজধানীর বায়ুদূষণ হচ্ছে না। নানা উৎস থেকে দূষণকারী পদার্থ বের হয়ে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শহরের বায়ুতে মিশছে। ফলে পরিবেশ অধিদফতরের একার পক্ষে এসব উৎস বন্ধ করা সম্ভব হবে না। তিনি বলেন, আমরা ইটভাটাগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছি। তবে সরকারের অন্য বিভাগগুলোকে যুক্ত করে তাদের দূষণ কমানোর উদ্যোগে নিয়েছি।
ঢাকা শহরের চার পাশের ইটভাটাগুলোর ধোঁয়া, শহরজুড়ে নির্মাণকাজের খোঁড়াখুঁড়ি আর যানবাহনের কালো ধোঁয়া এসব দূষণ ঘটাচ্ছে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান জানিয়েছেন, ‘বিশ্বের যেসব শহরে বায়ুদূষণ কমানো হয়েছে, সেখানে কঠোর আইন করা হয়েছে। আর তা বাস্তবায়নে সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় আনা হয়েছে। আমাদের এখানে এখনো বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ আইন হয়নি। আর ঢাকাসহ দেশের বেশির ভাগ শহরের বায়ুদূষণের উৎসগুলো আমরা জানি। স্বল্পমেয়াদি উদ্যোগে তা দূর করা সম্ভব। যেমনÑ শীতকালে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে নির্মাণকাজের ধুলা বেড়ে যায়। এমনকি মেট্রোরেলের মতো সরকারের বড় প্রকল্পগুলো থেকেও প্রচুর ধুলা বের হচ্ছে। কিন্তু তাদের নিয়ন্ত্রণে কোনো সরকারি দৃশ্যমান উদ্যোগ দেখি না।’ যানবাহন থেকে কালো ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণেও কাউকে মাঠে দেখা যায় না। তাহলে বায়ুদূষণ কিভাবে নিয়ন্ত্রণ হবে?
পরিবেশ অধিদফতরের বাতাসের মান পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত বছর ১৯৭ দিন রাজধানীবাসী দূষিত বাতাসে ডুবে ছিল। আগের বছরগুলোতে রাজধানীর বাতাস বছরের ৩৬৫ দিনের মধ্যে ১২০ থেকে ১৬০ দিন দূষিত থাকত। অর্থাৎ ঢাকার বায়ুদূষণ সময়ের বিবেচনায়ও বিপজ্জনক হারে বাড়ছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) জানিয়েছে, সরকারি সংস্থাগুলোকে এখনো বায়ুদূষণ রোধে কোনো কার্যকর উদ্যোগ নিতে দেখা যাচ্ছে না। বায়ুদূষণের কারণে দেশের মানুষের মধ্যে রোগবালাই বাড়ছে। বিশেষ করে গরিব পরিবারগুলো এবং শিশু ও বৃদ্ধরা এসব বায়ুদূষণের সবচেয়ে বড় শিকারে পরিণত হচ্ছে, যা দেশে ক্রমেই বায়ুদূষণজনিত একটি মানবিক বিপর্যয় তৈরি করছে।
বায়ুদূষণে স্বাস্থ্যঝুঁকি
বৈশ্বিক বায়ুদূষণের ঝুঁকিবিষয়ক ‘দ্য স্টেট অব গ্লোবাল এয়ার-২০১৯’ শীর্ষক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বিশ্বের যে পাঁচটি দেশের শতভাগ মানুষ দূষিত বায়ুর মধ্যে বসবাস করে, তার একটি বাংলাদেশ। আর বায়ুদূষণজনিত কারণে মৃতের সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ পঞ্চম। এ কারণে ২০১৭ সালে দেশে মারা গেছে এক লাখ ২৩ হাজার মানুষ। বিশ্বে বায়ুদূষণের কারণে হৃদরোগ, শ্বাসকষ্টজনিত জটিল সমস্যা, ফুসফুসে সংক্রমণ ও ক্যান্সারের মতো রোগ ছড়িয়ে পড়ছে। বিশেষত শিশু ও গর্ভবতী নারীরা বায়ুদূষণের সবচেয়ে বেশি শিকার হচ্ছেন। ইটভাটা, অবকাঠামো নির্মাণ ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান থেকে বের হওয়া ধোঁয়া ও ধুলার কারণে ওই দূষণ ঘটছে।
বায়ুদূষণের কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকির শঙ্কার কথা চিকিৎসকেরা বরাবরই বলে আসছেন। তবে এবার তারা বলছেন, বায়ুদূষণের কারণে শিশু থেকে বৃদ্ধ তো বটেই, গর্ভের শিশুরাও স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে। তাদের মতে, দীর্ঘ দিন বায়ুদূষণের মধ্যে থাকলে অন্যদের পাশাপাশি গর্ভবতী নারীর হৃদরোগ, ফুসফুসের সংক্রমণ-ক্যান্সার, শ্বাসকষ্টজনিত রোগ (সিওপিডি), নিউমোনিয়াসহ চোখের সমস্যা ও ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ে। এ ছাড়া গর্ভবতী মা যখন দূষিত বাতাস থেকে শ্বাস নেন, তখন সন্তানের ফুসফুস ও মস্তিষ্কেও তা পৌঁছে যায়। এর ফলে গর্ভের শিশুর মস্তিষ্ক ও ফুসফুসে সমস্যা দেখা দেয়।
গত ১৯ নভেম্বর বিশ্বের বায়ুমান যাচাইবিষয়ক প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান ‘এয়ার ভিজুয়াল’-এর বায়ুমান সূচকবিষয়ক (একিউআই) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৭ থেকে ১৯ নভেম্বর ঢাকা ছিল বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত নগরী। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন পরিস্থিতিতে রাজধানীবাসী, বিশেষ করে শিশু ও বয়স্কদের মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি) গবেষক আতিক আহসান বলেন, ২০১৪ সালে ১৬৫ দিন ঢাকার বাতাস অস্বাস্থ্যকর থেকে মারাত্মক অস্বাস্থ্যকর ছিল। ২০১৫ সালে সেটা হয় ১৭৩ দিন, ২০১৬ সালে ১২৯ দিন, ২০১৭ সালে ১৪৫ দিন এবং ২০১৮ সালে ছিল সর্বোচ্চ ১৯৭ দিন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা: মোহাম্মদ আতিকুর রহমান বলেন, বায়ুদূষণের কারণে শ্বাসতন্ত্রের জটিল রোগ সিওপিডি ধূমপায়ীদের বেশি হতে দেখা যায়। এটি ফুসফুসের একটা অসুখ। এতে নিঃশ্বাস নিতে অসুবিধা হয়। সময়ের সাথে সাথে এটি ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। সিওপিডির ফলে কাশি দেখা দেয়, সেই সাথে কফসহ নানা উপসর্গ থাকে। এ ছাড়া বাতাসের দূষণ, ধুলো, ধোঁয়া ফুসফুসে প্রদাহের সৃষ্টি করে। এর ফলে সাধারণ মানুষের সাথে গর্ভবতী নারীরাও বেশি আক্রান্ত হন। এতে গর্ভের শিশুদেরও এসব রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্ডিওলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা: মো. হারিসুল হক জানিয়েছেন, এনভায়রনমেন্ট সরাসরি হৃদরোগের ওপর প্রভাব ফেলে। ঢাকায় ভয়াবহ রকমের বায়ুদূষণ। দূষিত বাতাস অক্সিজেন ক্যারিং সক্ষমতা নষ্ট করে দেয়। আর অক্সিজেন ক্যারিং সক্ষমতা নষ্ট করে দিলেই তখন হৃদরোগের আশঙ্কা তৈরি হয়। হার্টের পাম্পিং অ্যাক্টিভিটি কমে যায়, এভাবেই হার্ট দুর্বল হয়ে যায়। বিষয়টি কেবল সাধারণ মানুষের মধ্যে যে ঘটে তা নয়, এসব রোগে গর্ভবতী কোনো নারী আক্রান্ত হলে, তা তার শিশুর ফুসফুস ও মস্তিষ্কেও সংক্রমিত হতে পারে।
দূষিত বাতাস শিশুদের জন্য সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্যঝুঁঁকির কারণ বলে মনে করেন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা: এ বি এম আব্দুল্লাহ। তিনি বলেন, পাশাপাশি বৃদ্ধ ও গর্ভবতী মায়েরা ঝুঁকিতে রয়েছেন। আর গর্ভবতী মা দূষিত বাতাস থেকে শ্বাস নেয়ার সাথে সাথে তার গর্ভের সন্তানও সেই ঝুঁকিতে পড়ছে।
দরকার সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা
মাত্রাতিরিক্ত ইটভাটা, যানবাহন, নির্মাণকাজ ও কলকারখানার ধোঁয়ার কারণে ঢাকা শহরের প্রায় দেড় কোটি মানুষ এক অবিশ্বাস্য বিষাক্ত গ্যাসের মধ্যে বাস করছে। মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার এক পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, ঢাকার বাতাসে দূষণের মাত্রা গত ১০ বছরে ৮৬ শতাংশ বেড়েছে। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, ঢাকার বায়ুদূষণমাত্রা কত এবং বায়ুদূষণমাত্রা কমানোর জন্য জরুরি ভিত্তিতে সময়োপযোগী কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। গত শনিবার শাহবাগ জাতীয় জাদুঘরের সামনে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা), নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ ফোরাম (নাসফ) ও পরিবেশ আন্দোলন মঞ্চসহ সমমনা সংগঠনের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত মানববন্ধনে বক্তারা এসব কথা বলেন। ‘নগরে বিষ ঢালছে বায়ুদূষণ, বায়ুদূষণ বন্ধে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করো’ এই দাবিতে এ মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, ঢাকা শহরের বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ ইটভাটা, যানবাহন, নির্মাণকাজ ও কলকারখানার বিষাক্ত ধোঁয়া। ঢাকার আশেপাশে ফসলের জমি দখল করে অবৈধভাবে শত শত ইটের ভাটা গড়ে উঠেছে। যার বেশির ভাগেরই বৈধ ড্রাম চিমনি নেই। সালফারের মান যাচাই না করেই এসব ইটের ভাটায় নিম্নমানের কয়লা ব্যবহার করছে। পাশাপাশি কাঠ, টায়ার, প্লাস্টিক ইত্যাদি ক্ষতিকারক জ্বালানি ব্যবহারের ফলে নির্গত হচ্ছে ধোঁয়া, ধূলিকণাসহ বিভিন্ন ধরনের ভারী ধাতবকণা। নির্গত হচ্ছে মানবস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকারক সালফার ও নাইট্রোজেনযুক্ত অক্সাইড, কার্বন মনোঅক্সাইড, ব্ল্যাক-কার্বনসহ অন্য ক্ষতিকর উপাদান যা মানুষের চোখ, ফুসফুস ও শ্বাসনালির মারাত্মক ক্ষতি ঘটাতে পারে।
বক্তারা বলেন, নগরবাসীর স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ নিশ্চিত করতে অচিরেই বায়ুদূষণের উৎসগুলো বন্ধ করতে হবে। বায়ুদূষণের সাথে জড়িত দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।