২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

ডেঙ্গু পরিস্থিতি কি নিয়ন্ত্রণের বাইরে

-

রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে প্রতিদিনই ডেঙ্গু রোগীরা আসছে। এবারের সংখ্যাটা অনেক বেশি। গত বছরের তুলনায় প্রায় পাঁচ গুণ বেশি। এমনও রোগী আছেন, যারা দ্বিতীয়বারের মতো, তৃতীয়বারের মতো আক্রান্ত হয়ে আসছেন। তাদের অবস্থা বেশ জটিল। আর এবারের ডেঙ্গুতে ছড়াচ্ছে মূলত ৩ নম্বর প্রজাতির মশাগুলো। যেগুলোর কারণে রোগের জটিলতা অনেক বেড়েছে।
সব মিলিয়ে এবারের ডেঙ্গু পরিস্থিতি আগের চেয়ে উদ্বেগজনক এবং বিগত যেকোনো বছরের চেয়ে এই জটিলতার দিকগুলো অনেক বেড়েছে বলে জানিয়েছেন বেশির ভাগ চিকিৎসক। কারণ আগে ডেঙ্গু হলে জ্বর হতো, মাথা ব্যথা, চোখের পেছনে ব্যথা হতো। তবে এবারে ডেঙ্গুর লক্ষণগুলো অন্য রকম। যেমন কেউ তীব্র পেট ব্যথা নিয়ে আসছেন, কারো হার্টের সমস্যা বেড়েছে। কারো ব্রেনে অ্যাফেক্ট করেছে।
আশার খবর হলো ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া রোগের জীবাণুবাহী এডিস মশা নিধনে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) সাথে কাজ করবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। গত শনিবার ডিএসসিসি মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকনের সাথে বৈঠক শেষে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) বাংলাদেশ প্রতিনিধি ড. এডউইন স্যানিজা স্যালভেদর বলেন, বাংলাদেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি উদ্বেগজনক তবে নিয়ন্ত্রণের বাইরে নয়। মশা নিধনে সিটি করপোরেশন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অন্যান্য সরকারি সংস্থার সাথে কাজ করতে চায় ডব্লিউএইচও।
মশা নিয়ে গবেষণা করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার। তার মতে, এবার সচেতন হওয়া বেশি জরুরি, কারণ কয়েকটি কারণে এবার ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি হওয়ার আশঙ্কা আছে।
এবার ফেব্রুয়ারিতে বৃষ্টি হয়েছে। এডিস মশার ডিম ছয় মাস পর্যন্ত শুকনো স্থানে থাকলে বেঁচে থাকতে পারে। এবার আগে বৃষ্টির ও এখন থেমে থেমে বৃষ্টির কারণে এডিস মশার ঘনত্ব বাড়ছে। আবার ঢাকাসহ সারা দেশে পানির স্বল্পতার কারণে মানুষ বালতি কিংবা ড্রামে পানি জমিয়ে রাখে। আর বিভিন্ন ধরনের নির্মাণকাজের সাইটগুলোতে চৌবাচ্চা, ড্রাম এডিস মশার বিস্তারে প্রধান ভূমিকা পালন করছে।

সরকারি হাসপাতালেই মিলছে ভালো চিকিৎসা
ডেঙ্গু জ্বরের রোগী সরকারি হাসপাতালে বেশি ভর্তি হচ্ছে। আর এসব হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যুও কম। গত চার বছরে এ রোগে আক্রান্ত ও মৃত্যু বিষয়ে সরকারি তথ্য বিশ্লেষণে এমন চিত্র পাওয়া গেছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার নির্দেশনা অনুসরণ করে চিকিৎসা দেয়ার চর্চা বেশি। এ কারণে মৃত্যুর সংখ্যাও কম।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, গত চার বছরে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মোট ৫১ জন মারা গেছে। এর মধ্যে ১৮ জন মারা গেছে সরকারি হাসপাতালে। এদের মধ্যে দু’জনের মৃত্যু হয়েছে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। বাকি ৩৩ জন মারা গেছে বেসরকারি হাসপাতালে।
এ বছর ডেঙ্গুতে ২২ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের মধ্যে ১৮ জনের মৃত্যু হয়েছে রাজধানীর ১০টি বেসরকারি হাসপাতালে। এর মধ্যে সবচেয়ে ব্যয়বহুল তিনটি হাসপাতালও আছে। দু’জনের মৃত্যু হয়েছে একটি সরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ও বাকি দু’জনের মৃত্যু হয়েছে একটি আধা সরকারি হাসপাতালে।
বরাবরের মতো এ বছরও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ঢাকা মেডিক্যাল থেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে ৪৬৯ জন। একজনেরও মৃত্যু হয়নি ঢাকা মেডিক্যালে।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ খান আবুল কালাম আজাদ জানিয়েছেন, ডেঙ্গু বা যেকোনো রোগের প্রাদুর্ভাবের শুরুতেই ঢাকা মেডিক্যাল চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনার বিষয়ে প্রস্তুতি নিয়ে থাকে। চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। প্রতিদিন রোগী দেখার সময় জ্যেষ্ঠ-কনিষ্ঠ সব পর্যায়ের চিকিৎসকেরা সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন। ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসার নির্দেশনা মেনে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। পুরো কাজটি করা হয় দলগতভাবে।
স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, এ বছর ডেঙ্গুতে পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে পাঁচটি বেসরকারি হাসপাতালে। অধিদফতরের পুরনো হিসেবে দেখা যায়, ২০১৮ সালে ডেঙ্গুতে ২৬ জনের মৃত্যু হয়েছিল। এর মধ্যে বেসরকারি হাসপাতালে ১৯ জন ও সরকারি হাসপাতালে সাতজনের মৃত্যু হয়।
ব্যতিক্রম দেখা যায় ২০১৭ সালের মৃত্যু তালিকায়। এ বছর আটজন মারা যায়। এর মধ্যে দু’জন মারা যায় বেসরকারি হাসপাতালে, চারজন ঢাকা শহরের সরকারি হাসপাতালে। বাকি দু’জন দু’টি উপজেলা হাসপাতালে। উপজেলাপর্যায়ে মৃত্যুর ঘটনা এর আগে ও পরে আর ঘটেনি।
২০১৬ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ১৪ জনের মৃত্যু ঘটে। এর মধ্যে ৯ জন মারা যায় বেসরকারি হাসপাতালে। আর ২০১৫ সালে তিনজনের মৃত্যু হয়েছিল। এর কোনোটি সরকারি হাসপাতালে হয়নি।
জনস্বাস্থ্যবিদ ও বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক রশীদ-ই মাহবুব জানিয়েছেন, প্রশিক্ষণের বিশেষ প্রয়োজন আছে। সেই সুযোগ নিয়ে প্রটোকল মেনে সরকারি চিকিৎসকেরা যেভাবে কাজ করেন, বেসরকারি পর্যায়ে তার ঘাটতি আছে। আবার বেসরকারি কিছু প্রতিষ্ঠানে সার্বক্ষণিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক থাকেন না। অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সরকারি চিকিৎসকদের ওপর নির্ভরশীল। জরুরি সময়ে তারা হয়তো উপস্থিত হতে পারেন না। ডেঙ্গুর চিকিৎসা অনেকটা জরুরি চিকিৎসার মতো। জরুরি চিকিৎসা দেয়ার যে ব্যবস্থাপনা কাঠামো, তা অনেক বেসরকারি হাসপাতালে অনুপস্থিত। এ ক্ষেত্রে তারা স্বাস্থ্য অধিদফতরের নজরদারির প্রয়োজন।
ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব যে শুধু ঢাকা বা বাংলাদেশেই বেশি তা নয়। আমাদের পাশের দেশ ভারতের দিল্লি, মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর শহর, সিঙ্গাপুর সিটি, থাইল্যান্ড, ফিলিপিন্সের মতো জায়গায় এবার রেকর্ডসংখ্যক মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। এসবের পেছনে আসলে জলবায় পরিবর্তনের ইস্যুই ঘুরে ফিরে আসছে।

ডিএনসিসি কর্মীদের ছুটি বাতিল
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মশক নিয়ন্ত্রণ ও পরিচ্ছন্নতা বিভাগের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর ছুটি বাতিল করা হয়েছে। ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘যারা মশক নিয়ন্ত্রণে নিয়োজিত আছেন এবং যারা পরিচ্ছন্নতার কাজে নিয়োজিত আছেন, তাদের সব ছুটি বাতি করেছি। ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া যত দিন নিয়ন্ত্রণে না আসবে, মওসুম যতদিন থাকবে এ আদেশ ততদিন বলবৎ থাকবে।’
নগরাবাসীকে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়ে মেয়র বলেন, ‘ডেঙ্গু মশার উৎপত্তিস্থল জমে থাকা স্বচ্ছ পানি, নোংরা পানি নয়। তিনদিন জমে থাকা স্বচ্ছ ও পরিষ্কার পানিতে ডেঙ্গুর জন্ম হয়। এ ধরনের পানি জমতে দেবেন না। বাড়ির আঙ্গিনায়, ফুলের টবে, পরিত্যক্ত টায়ারে পানি জমে থাকলে তা পরিষ্কার করুন। নিজ উদ্যোগে এসব কাজ করতে হবে।’
মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, ‘ডব্লিউএইচওকে সুনির্দিষ্ট কিছু পয়েন্ট দেয়া হয়েছে। যেমনÑ মশক নিধনের ওষুধগুলোর কার্যকারিতা পরীক্ষা করা, ওষুধে কোনো পরিবর্তন দরকার কি না, দরকার হলে তা কেমন হবেÑ এসব তারা দ্রুত সময়ের মধ্যে আমাদের অবহিত করবে।
তবে ডেঙ্গু পরিস্থিতি এখনো নিয়ন্ত্রণে আছে জানিয়ে জনসচেতনতার প্রতি জোর দেন মেয়র। তিনি বলেন, কয়েক বছরের তুলনায় এবার ডেঙ্গুর প্রকোপ অনেক বেশি। তবুও আশপাশের অনেক দেশের তুলনায় ভালো। পরিস্থিতি এখনো নিয়ন্ত্রণে আছে। এটি নিয়ন্ত্রণে রাখতে জনসচেতনতার কোনো বিকল্প নেই।


আরো সংবাদ



premium cement

সকল