রাজধানীজুড়ে গণপরিবহন সঙ্কট
- মাহমুদুল হাসান
- ১৬ এপ্রিল ২০১৯, ০০:০০
বাসচাপায় বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) শিক্ষার্থী আবরার আহমেদ চৌধুরী নিহত হন ১৯ মার্চ। সুপ্রভাত পরিবহনের বাসের চাপায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবরার মারা যাওয়ার পর তার পরিবারকে তাৎক্ষণিক ১০ লাখ টাকা দেয়ার নির্দেশ দেন আদালত। বাসের চাপায় প্রাইভেট কারের চালক রাসেল সরকার পা হারানোর ঘটনায় আদালত তাকে ৫০ লাখ টাকা দিতে গ্রিন লাইন পরিবহন কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন। পাঁচ লাখ টাকা পরিশোধ করে গ্রিন লাইন কর্তৃপক্ষ। বাকি ৪৫ লাখ টাকা এক মাসের মধ্যে দিতে আদেশ দেন আদালত।
আদালত থেকে দুই পরিবহন কোম্পানিকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার আদেশে চাপে পড়েছে পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলো। আবার সড়কে শৃঙ্খলা আনতে ভ্রাম্যমাণ আদালত ও পুলিশও সক্রিয় হয়েছে। এ অবস্থায় চাপ সামলাতে পুরনো কায়দায় যাত্রীদের জিম্মি করার কৌশল শুরু করেছেন মালিক-শ্রমিকেরা। এর পর থেকেই ছাত্র আন্দোলন ও পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের কড়াকড়ির কারণে গণপরিবহনের সঙ্কট তৈরি হয়েছে।
সড়কে গণপরিবহনের সংখ্যা অত্যন্ত কম থাকায় বিভিন্ন বাসস্ট্যান্ডে যাত্রীদের দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও কোনো গণপরিবহনের দেখা মিলছে না। ফলে অফিস যাত্রীরা ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং ব্যাংক-বীমায় কর্মরত হাজার হাজার মানুষকে অফিসে যাওয়ার জন্য সিএনজি ও ট্যাক্সির মতো ব্যয়বহুল পরিবহন কিংবা অন্য কোনো উপায়ের আশ্রয় নিতে হচ্ছে। দুয়েকটি বাস চললেও অতিরিক্ত ভিড়ের কারণে সেগুলোতে উঠতে পারছেন না।
পরিবহন মালিক-শ্রমিক সূত্রগুলো বলছে, দুর্ঘটনার পর এভাবে আদালতের রায় দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়াচ্ছে। পরবর্তী সময়ে আবারো এমন কোনো দুর্ঘটনার পর কেউ মামলা করলে আদালত জরিমানা করবেন। সুপ্রভাত পরিবহনের একটি বাসের চাপায় আবরার আহমেদ চৌধুরী মারা যাওয়ার পর মালিক-চালককে গ্রেফতর করে পুলিশ। ছাত্র আন্দোলনের ভয়ে সুপ্রভাত ও জাবালে নূর পরিবহনের সব বাসের চলাচলের অনুমোদনও বাতিল করেছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। আবার বিআরটিএ’র ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানও জোরদার হয়েছে।
আদালতের রায় ও সরকারের তৎপরতায় চাপ অনুভব করছেন মালিক-শ্রমিক নেতারা। এজন্য সর্বত্র পরিবহন ধর্মঘট দেয়া না দেয়া নিয়ে তাদের কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্ব আছে। পরিস্থিতি সামলাতে মালিক শ্রমিকেরা কয়েক দিন ধরেই ঢাকা ও এর আশপাশে পরিকল্পিতভাবে বাস-মিনিবাসের চলাচল নিয়ন্ত্রণ শুরু করেন।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী বলেন, চালক দুর্ঘটনা ঘটালে তাদের পরিবারের সবাইকে হয়রানি করা হচ্ছে। সড়ক পরিবহন আইনে অজামিনযোগ্য ধারা যোগ করা হয়েছে। পথে পথে হয়রানির শিকার হচ্ছেন চালক। এ অবস্থায় যেকোনো সময় রাজধানী ও দূরপাল্লার পথে বাস চলাচল বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তবে দূরপাল্লার পথে কোনো সমস্যা নেই বলে মনে করেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খোন্দকার এনায়েত উল্যাহ। তিনি বলেন, গ্রিন লাইন পরিবহনের বিরুদ্ধে আদালত যে ক্ষতিপূরণের রায় দিয়েছেন, এটা নিয়ে মালিক সমিতিতে আলোচনা হয়েছে। আইনি প্রক্রিয়ায় এটা মোকাবেলা করা হবে। আর পুলিশ-বিআরটিএ’র কড়াকড়ির কারণে ঢাকায় কিছুটা পরিবহন সঙ্কট হয়েছে। কারণ, অনেক বাসেরই চলাচলের অনুমতি (রুট পারমিট) ও ফিটনেস সনদে ঝামেলা রয়েছে।
গতকাল সকাল ১০টার দিকে রাজধানীর মগবাজার এলাকায় অনেক যাত্রীকে বাসের জন্য অপেক্ষায় থাকতে দেখা যায়। মাঝে মধ্যে একটা বাস এলেও সেগুলোর দরজা ছিল বন্ধ। বলাকা পরিবহনের এক চালক জানান, গত মাস থেকেই প্রচুর বলাকা গাড়ি আটক করা হয়েছে। এখন হাতেগোনা কিছু গাড়ি চলছে। কন্ডাক্টর সাইফুর বলেন, তাদেরসহ অন্য কোম্পানির অনেক বাস চলাচল বন্ধ আছে। এজন্যই সঙ্কট। তার দাবি, পুলিশের কড়াকড়ির কারণে দরজা বন্ধ করে চালাচ্ছেন। মগবাজার থেকে বলাকা পরিবহনে সায়েদাবাদগামী যাত্রী রবিউল আহসান বলেন, প্রায় এক মাস ধরেই বলাকা গাড়ির সঙ্কট। আগে ৫ থেকে ১০ মিনিট অন্তর একটি গাড়ি মগবাজারে এলেও এখন আসছে ৩০ মিনিট পর। আর গাড়িতে যাত্রী বেশি থাকায় মগবাজার থেকে যাত্রী উঠায় না। আর উঠালেও ঠিকই লোক দাঁড় করিয়ে সিটিং ভাড়া নিচ্ছে।
গতকাল দুপুরে মহাখালীতে এই কোম্পানির একটি বাস এলে বেশ কিছু নারী-শিক্ষার্থী দরজা ধাক্কাতে থাকেন। তারা আকুতি করতে থাকেন যে দুই ঘণ্টা ধরে বাসে উঠতে পারছেন না। দরজা খুলে যেন তাদের নেয়া হয়। অবশ্য বাসটির ভেতরে যাত্রীরা গাদাগাদি করেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। এরপরও কয়েকজন যাত্রী বাইরে থাকা নারী-শিক্ষার্থীদের উঠিয়ে নিতে অনুরোধ করলে দরজা খোলা হয়।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী জানিয়েছেন, পরিবহন মালিক শ্রমিকেরা কোনো কিছুই পরোয়া করেন না। কথায় কথায় যাত্রীদের জিম্মি করেন। ছাত্র আন্দোলন ও আদালতের রায়ের কারণে এবার হয়তো তাদের ওপর কিছুটা চাপ পড়েছে। এটা অব্যাহত রাখতে হবে। আইনিকাঠামোও জোরদার করতে হবে।
২২ রুটে আসছে ৬ কোম্পানির বাস
ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় গণপরিবহনে শৃঙ্খলা আনতে ২২টি রুট নির্ধারণ করা হয়েছে। এই রুটগুলোয় মহানগরীর সব বাস ছয়টি কোম্পানির অধীনে যাত্রী পরিবহন করবে। ছয়টি কোম্পানির বাস ছয় রঙের (গোলাপি, কমলা, সবুজ, বেগুনি, মেরুন ও নীল) হবে।
গত বুধবার বিকেলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) নগর ভবনে এক সভায় এই সিদ্ধান্ত নেয় গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে গঠিত বাস রুট রেশনালাইজেশন-সংক্রান্ত কমিটি। সভা শেষে এসব তথ্য সাংবাদিকদের জানান ডিএসসিসির মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন। তিনি বলেন, ২০২০ সালকে ‘মুজিববর্ষ’ ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আমরা এ বছরের মধ্যেই গণপরিবহনে শৃঙ্খলা আনতে চাই। নাগরিকদের একটি নিরাপদ নগরী উপহার দিতে চাই। সেই লক্ষ্যে নির্ধারণ করে কাজ করছে বাসরুট রেশনালাইজেশন-সংক্রান্ত কমিটি। গণপরিবহনে শৃঙ্খলার প্রাথমিক অংশ হিসেবে গত ২৭ মার্চ ধানমন্ডিতে চক্রাকার বাসসেবা চালু করা হয়েছে। এই এলাকায় এখন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত প্রায় ২০টি বাস যাত্রী পরিবহন করছে। নিরাপদ ও আরামদায়ক পরিবেশে যাতায়াত করতে পেরে সন্তুষ্টি প্রকাশ করছেন যাত্রীরা। তাই একইভাবে চলতি মাসের শেষ সপ্তাহে মতিঝিল এবং মে মাসের প্রথম সপ্তাহে উত্তরায় চক্রাকার বাসসেবা চালু করা হবে।
ডিএসসিসির মেয়র বলেন, গুলিস্তান থেকে সদরঘাট হয়ে যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত আরেকটি চক্রাকার বাসসেবা চালু করা যায় কি না, তা নিয়েও চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। এ জন্য গুলিস্তান থেকে এই বাস চলাচলের সম্ভাব্যতা যাচাই করে দেখবে বিআরটিসি। যদি ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায় তাহলে গুলিস্তান থেকে বাবুবাজার মোড়, সদরঘাট, ধোলাইখাল, যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, জয়কালী মন্দির, বঙ্গবাজার মোড় ও গুলিস্তান পর্যন্ত চক্রাকারে বাস চলাচল করবে। এই সেবা কার্যক্রম চালু হলে রায়সাহেব বাজার, তাঁতীবাজার বা সদরঘাট এলাকার যানজট কমবে। স্বাচ্ছন্দ্যে যাতায়াত করতে পারবেন পুরান ঢাকার বাসিন্দারা।
সঙ্কট মেটাতে পারে দ্বিতল বাস
রাজধানীর বিমানবন্দর থেকে বাড্ডা প্রগতি সরণি-রামপুরা-মালিবাগ হয়ে মতিঝিল পর্যন্ত রুটে গণপরিবহন বেশ কম। গত মাসে সেই সংখ্যা আরো কমে যায়। গণপরিবহন সঙ্কটে ওই পথে চলাচলকারী যাত্রীদের দুর্ভোগে পড়তে হয়। পরিস্থিতি কিছুটা সহনীয় করতে ১৪টি দ্বিতল বাস নামিয়েছে বিআরটিসি।
তবে স্বল্পসংখ্যক গণপরিবহনে যথাযথ সেবা পাচ্ছে না বলে অভিযোগ যাত্রীদের। তারা বলেন, আগে উত্তরা থেকে গুলিস্তান হয়ে বাহাদুর শাহ পার্ক এবং উত্তরা-গুলিস্তানের মতিঝিলে তিনটি বেসরকারি পরিবহনের বাস চলাচল করছিল। সুপ্রভাত, ভিক্টর ও গ্রিন ঢাকা নামে বেসরকারি গণপরিবহনগুলোই ছিল যাত্রীদের ভরসা।
গত ১৯ মার্চ সুপ্রভাত পরিবহনের একটি বাস বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) শিক্ষার্থী আবরার আহমেদ চৌধুরীকে ধাক্কা দেয়। এতে তিনি ঘটনাস্থলেই মারা যান। এরপর বন্ধ হয়ে যায় সুপ্রভাত পরিবহন। আর উত্তরা থেকে বাহাদুর শাহ পার্কগামী ভিক্টর বাসটিও এখন চলে না। এ দুটি বাদে আবদুল্লাহপুর-মতিঝিল রুটে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত একমাত্র গ্রিন ঢাকা পরিবহনের বাস চলাচল করছে।
গ্রিন ঢাকা পরিবহনে আবদুল্লাহপুর থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ভাড়া ১০০ টাকা। আর সর্বনিম্ন ভাড়া ৬০ টাকা। স্বল্প দূরত্বে চলাচলকারী যাত্রীদের জন্য এই ভাড়া অতিরিক্ত। আবার সবার পক্ষে এত ভাড়া দেয়া কঠিন। তাই এই সড়কে যাত্রীদের তীব্র গণপরিবহন সঙ্কটে ভুগতে হয়।
এমন পরিস্থিতিতে গত ২৭ মার্চ বিমানবন্দর থেকে বাড্ডা প্রগতি সরণী-রামপুরা-মালিবাগ হয়ে মতিঝিল পর্যন্ত বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশনের (বিআরটিসি) নতুন ১০টি দ্বিতল বাস চালু করেছে। এর প্রায় এক সপ্তাহ পর আরো চারটি বাস যুক্ত হয়। প্রতিটি বাসে ৭০টি করে আসন। বিমানবন্দর থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ভাড়া ৪৫ টাকা। আর সর্বনিম্ন ভাড়া ১০ টাকা।
দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে চলা বিআরটিসির বাস দেখে যাত্রীরা কিছুটা স্বস্তি পেয়েছেন। তবে সংখ্যায় এটি খুব কম মনে করছেন যাত্রীরা। একটি বাসের জন্য দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়। অপেক্ষার পর বাস পাওয়া গেলেও তাতে ভিড় ঠেলে উঠতে হয় এবং অনেক যাত্রীই দাঁড়িয়ে থাকেন।
নতুন চালু করা বাস নিয়ে বিআরটিসির ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (অপারেশন) আলমাছ আলী বলেন, বিমানবন্দর-মতিঝিল রুটে ১০টি বাস দিয়ে শুরু হলেও এখন ১৪টি চলছে। আরো ৪০টির মতো বাস এই রুটে যোগ করা হবে। যাত্রীদের চাহিদার কথা বিবেচনা করে ভারত থেকে আমদানি করা এই বাসের সংখ্যা পর্যায়ক্রমে বাড়ানো হবে। আর কাউন্টার বসানোর জন্য ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ ও সিটি করপোরেশনের পরামর্শমতো জায়গা নির্ধারণ করা হবে।