২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

বইয়ের রাজ্য বাংলাবাজার

-

বইমেলা শেষে এখনো নতুন বইয়ের গন্ধ রয়েছে বাংলাবাজারে। বইমেলার শেষে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বই বাজারের লোকজনের সময় এখন কাটছে একটু ঢিমেতালে। বাইন্ডিংখানা থেকে ভ্যানে করে বই আসছে, বই যাচ্ছে। ঢাকার সবচেয়ে পুরনো এলাকার একটি হলো বাংলাবাজার।
বাংলাবাজারে বাংলাদেশী বইয়ের বৃহত্তম মার্কেট। দেশের প্রকাশনা ব্যবসা আবর্তিত হচ্ছে বাংলাবাজারকে ঘিরে। দেশের বড় প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোর অফিসও বাংলাবাজারে। নতুন বইয়ের পাশাপাশি পুরনো বইয়ের জন্যও বাংলাবাজার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। এ এলাকার অস্তিত্ব ছিল মোগল আমলেরও আগ থেকে। তখন থেকেই মূলত এটি ব্যবসাকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। মোগল আমলের আগের ঢাকার একটি অতি পুরাতন অংশ ছিল বাংলাবাজার। সেই যুগে এ এলাকা ছিল ব্যবসায় বাণিজ্যের মূল কেন্দ্র। পরে ঢাকা শহর পশ্চিম দিকে সম্প্রসারিত হয় এবং চকবাজার হয়ে ওঠে এর মধ্যমণি।
সময়ের আবর্তনে অপরিসর গলি, গলির ভেতরে থরে থরে বিভিন্ন প্রকাশনীর দোকান আর বই বহুতল মার্কেটের সুবাদে এ এলাকা থেকে এখন আকাশ দেখাই দায়। বইয়ের সাথে বাংলাবাজারের সম্পৃক্ত আকস্মিকভাবে ঘটেনি, আছে দীর্ঘ প্রেক্ষাপট। মোগল সুবেদার ইসলাম খাঁ ১৬১০ সালে ঢাকায় স্থাপন করলেন বাংলার রাজধানী। ১৮৬০ সালে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হলো ‘বাঙ্গালা যন্ত্র’, মানে ছাপাখানা। আর ১৮৬৫ থেকে ১৯০০, এই সময়ে কলকাতার বটতলার পুঁথির আদলে বাংলাবাজারের পার্শ্ববর্তী চকবাজারে দেখা গেল অগণিত মুসলমানি পুঁথি, গড়ে উঠল কেতাবপট্টি। বাংলাবাজারের সাথে বইয়ের জোড় বাঁধার ক্ষেত্রে এই তিনটি ঘটনার প্রভাব আছে। সেই পঞ্চাশের দশকে বুড়িগঙ্গা ও সদরঘাট লাগোয়া এই বাজার সম্প্রসারিত হয়েছিল যতটা না সৃজনশীল বইয়ের হাত ধরে, তার চেয়ে বেশি পাঠ্যপুস্তককে কেন্দ্র করে। বিশেষত ষাটের কালপর্বে যখন গড়ে উঠল পূর্ব পাকিস্তান পাঠ্যপুস্তক বোর্ড। ওই সময় প্রধানত পাঠ্যবইকে অবলম্বন করে স্বাস্থ্যবান হতে শুরু করল বাংলাবাজার। ধর্মীয় ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বই দুই রকম প্রকাশনায় বাজার ছিল রমরমা। কালক্রমে আমাদের সহায়ক বিভিন্ন পাঠ্যপুস্তকের বড় অংশের জোগান এখনো আসে এখান থেকে।
পঞ্চাশের পটভূমিতে এটি ছিল এক রাস্তার এবং এই পি কে রায় সড়কটিই (প্যারিদাস রোডসহ) ছিল বাংলাবাজার এলাকার প্রথম পাকা রাস্তা, প্রায় ৭০ বছর পর এখনকার বাস্তবতায় আরো বহু পথ মিলে একাকার হয়েছে। ষাটের দশক থেকে লক্ষ্মীবাজার, জগন্নাথ কলেজ (এখন বিশ্ববিদ্যালয়), বাহাদুর শাহ পার্কসহ বাংলাবাজারের আশপাশের এলাকায় গড়ে উঠেছিল পুস্তক বিতান। বলার অপেক্ষা রাখে না, বর্তমানে সেটি আরো বর্ধিষ্ণু, সম্প্রসারিত। আর হ্যাঁ, খান ব্রাদার্স, আহমদ পাবলিশিং হাউস, মাওলা ব্রাদার্স, চট্টগ্রামের বইঘর, চলন্তিকা বইঘর, পুঁথিঘর, বর্ণমিছিল, বুক কোম্পানি, বিউটি বুক হাউস এসব সৃজনশীল প্রকাশনী ষাট ও সত্তর দশকের উত্তাল সময়ে এক দিকে যেমন এ দেশের সাহিত্যিকদের বেড়ে ওঠায় সহায়ক হয়েছে, তেমনি বাংলাবাজারের আলোও ছিল তারা। তখন এখানকার বেশির ভাগ দোকান ছিল একতলা। দোতলার ওপরে কোনো দালান ছিল না। ঘরগুলো কোনোটা টিনের, কোনোটা ছিল চুন ও মাটি-সুড়কির গাঁথুনিতে গড়া। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের পর প্রথম এখানে রড-সিমেন্ট ব্যবহার করে দালান নির্মাণ শুরু হয়। তখন দোকানপাট সব ছিল প্রধান সড়কের ওপরে, ভেতরে কোনো দোকান ছিল না। এখন যেখানে মান্নান মার্কেট, সেখানে দাঁড়ালেই দেখা যেত বুড়িগঙ্গা নদী।
পুরান ঢাকা পেরিয়ে বইয়ের হাটবাজার এখন যদিও ছড়িয়ে পড়েছে নতুন ঢাকায়, তবু বাংলাবাজারের মাহাত্ম্য একটুও টোল খায়নি তাতে। প্রকাশকদের তথ্যমতে, বর্তমানে এখানে বইয়ের দোকান আছে প্রায় দুই হাজার। ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত খুচরা ক্রেতারা হরহামেশা এখান থেকে বই কিনলেও এখন এটি বইয়ের পাইকারি বাজার হিসেবে পরিচিত। দেশের সব প্রান্তে এখান থেকে সরবরাহ করা হয় সহায়ক পাঠ্যপুস্তক ও সৃজনশীল বই। বাংলাবাজারের একাধিক সৃজনশীল প্রকাশকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতিদিন এখান থেকে ছয়-সাত লাখ টাকার মতো সৃজনশীল বইয়ের লেনদেন হয়। ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল অবধি এই হার থাকে একটু বাড়তির দিকে। অক্ষরবিন্যাস, মুদ্রণ, পেস্টিং, বাঁধাই ও লেমিনেশন বইয়ের প্রশস্ত কর্মযজ্ঞে বাংলাবাজারের বইপাড়াকে ঘিরে জীবিকা নির্বাহ করছেন প্রায় লক্ষাধিক মানুষ।

 


আরো সংবাদ



premium cement