২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ব্যবসায় ও বসবাস

-

পুরান ঢাকা আবাসিক, না শিল্প এলাকাÑ তার উত্তর সবারই অজানা। পুরান ঢাকার ঘিঞ্জি ও ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় গড়ে উঠেছে দেশের সবচেয়ে বড় রাসায়নিক ব্যবসায় কেন্দ্র। আছে আরো বহু ধরনের কারখানা ও গুদাম। রীতিমতো বিস্ফোরকের ওপর বসবাস করছেন এখানকার বাসিন্দারা। দুর্ঘটনার পরেও সরেজমিন দেখা যায়, বেশির ভাগ বাড়ির নিচে গড়ে তোলা কারখানা ও গুদামগুলোতে রয়েছে অতি দাহ্যবস্তু। আগুন লাগলে বের হওয়ারও পথ নেই। ফায়ার সার্ভিসের গাড়িগুলো এসব গলিতে ঢুকতে পারে না। গত বুধবার রাতে পুরান ঢাকার অন্যতম প্রসাধনী ও প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবসায় কেন্দ্র চুড়িহাট্টায় আগুন লেগে ৬৭ জন নিহত হওয়ার অন্যতম কারণও ছিল এটি।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, জীবিকার তাগিদেই তাদের জীবনের ঝুঁকি নিতে হচ্ছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানই অনিয়ম ও ঝুঁকির বিষয়গুলো জানে। তাদের সামনেই এই ঝুঁকিপূর্ণ জীবনযাপন চলছে বছরের পর বছর। বড় দুর্ঘটনার পরই বিষয়গুলো নিয়ে নড়াচড়া হয়। আবার কিছু দিন পর তা থেমেও যায়। পুরান ঢাকার রাসায়নিকের ব্যবসায়ীরা বলছেন, তারা এই এলাকা ছাড়তে চান। কিন্তু সরকার গুদাম সরাতে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়েও কিছু করেনি।
রাসায়নিক ছাড়াও প্লাস্টিক, প্রসাধনী, কাগজ, লোহা, কাপড়, বিভিন্ন ধরনের ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিকস, তৈজসপত্রসহ নানা পণ্যের গুদাম রয়েছে পুরান ঢাকায়। এ ছাড়া আছে প্লাস্টিকের গুটি তৈরি, প্রসাধনী, জুতা, আঠা, যানবাহনের যন্ত্রাংশ, রাবার ও প্লাস্টিকের বিভিন্ন উপকরণ, কার্টন ইত্যাদি তৈরির কারখানা। এসব গুদাম ও কারখানায় অতি দাহ্যবস্তুর ছড়াছড়ি। বহুতল ভবনে এসবে আগুন লাগলে সরু গলির কারণে মানুষের জন্য দ্রুত বের হওয়াও কঠিন।
ভয়াল আগুন চুড়িহাট্টার চিরচেনা রূপ বদলে দিয়েছে। চকবাজারের চুড়িহাট্টা মোড় এখন বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। যানজট নেই, রিকশার টুংটাং শব্দ নেই। ঠেলাগাড়ি, ভ্যানগাড়ির ব্যস্ত ছুটে চলা নেই। কোলাহল নেই, জায়গায় জায়গায় লোকজন জড়ো হয়ে দুর্ঘটনা নিয়েই আলোচনা করছিলেন। গত বুধবার রাত ১০টার দিকে চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মৃত্যু ছাপিয়ে তাদের আলোচনার মূল বিষয় এখন রাসায়নিক। দুর্ঘটনার জন্য রাসায়নিককে দায়ী করা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন তারা।
চুড়িহাট্টার মোড়ের কয়েকজন স্থায়ী বাসিন্দা জানান, এই এলাকার প্রায় প্রত্যেকে নিজেদের বাড়ির নিচতলায় রাসায়নিক গুদাম, প্রসাধন সামগ্রীর পণ্যসহ বিভিন্ন পণ্যের দোকান ভাড়া দিয়েছেন। যদিও অনেকে এই দুর্ঘটনার জন্য শুধু রাসায়নিককে দায়ী করতে নারাজ। তাদের ভাষ্য, গাড়ির গ্যাস সিলিন্ডার থেকে দুর্ঘটনা ঘটেছে। তাই এ দুর্ঘটনায় রাসায়নিককে দায়ী করা যুক্তিহীন। তবে আগুনের ভয়াবহতার জন্য গ্যাস সিলিন্ডার, রাসায়নিক সবই দায়ী।
চকবাজারের ইমামগঞ্জ থেকে মিটফোর্ড রোডে ঢুকতেই রাসায়নিকের গন্ধ নাকে আসে। এই সড়কের দুই পাশে সারিবদ্ধভাবে রয়েছে শত শত রাসায়নিক ও সুগন্ধির দোকান। আর বেড়িবাঁধ থেকে ঢাল বেয়ে নেমে যে রাস্তাটি লালবাগের ইসলামবাগের দিকে গেছে, তার দুই পাশের ঘরবাড়িগুলোর বেশির ভাগ পুরোটা অথবা একাংশ ব্যবহৃত হচ্ছে কারখানা, গুদাম বা দোকান হিসেবে। মাথার ওপর তারের জট, সারিবদ্ধ ট্রান্সফরমার আর সরু গলি।
চকবাজারের উর্দু রোড, ওয়াটার ওয়ার্কস রোড, নন্দ কুমার দত্ত রোডেও প্রচুর রাসায়নিক ও প্লাস্টিকের কাঁচামালের গুদাম দেখা যায়। গত বুধবার রাতে চুড়িহাট্টায় আগুন লাগার পর এখানকার বেশ কিছু গুদাম থেকে কয়েক শ’ বস্তা প্লাস্টিকের গুটি (কাঁচামাল) সরিয়ে ফেলা হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। চকবাজার, চুড়িহাট্টা এলাকায় বিভিন্ন ধরনের প্রসাধনী তৈরির কারখানা বাড়িতে বাড়িতে। যার বেশির ভাগই ‘নকল’ বলে স্বীকার করছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বিভিন্ন ধরনের শ্যাম্পু, লোশন, ক্রিম তৈরি করে নামকরা কোম্পানির মোড়কে বিক্রি করেন।
কাগজের জন্য সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার বাবুবাজার ও নয়াবাজার। বাবুবাজারের সৈয়দ হাসান আলী লেনে প্রায় প্রতিটি বাড়ির নিচে কাগজের দোকান ও গোডাউন আছে। অথচ এলাকাটিতে আগুন লাগলে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঢোকার কোনো পথ নেই।
অন্য দিকে সিদ্দিকবাজার প্রসিদ্ধ জুতার কারখানার জন্য। ইসলামপুরে কাপড়ের গুদাম, পাটুয়াটুলীতে বইয়ের দোকান, প্যারিদাস রোডে টায়ারের দোকান ও গুদাম, নবাবপুরে ইলেকট্রনিকসের দোকান, লালবাগ, ইসলামবাগ এবং শহীদনগরে জুতা, প্লাস্টিকের কয়েক হাজার কারখানা, দোকান ও গুদাম রয়েছে।
দুর্ঘটনার পরে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, চকবাজার থেকে রাসায়নিক কারখানা সরিয়ে নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। পাশাপাশি পুরান ঢাকার অন্যান্য এলাকা থেকেও রাসায়নিক গুদাম সরানোর নির্দেশ দিয়েছেন।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন বলেন, এলাকায় যেসব বাড়িতে রাসায়নিকের গুদাম আছে, তা দ্রুত সরিয়ে নিতে হবে। কোনো বাড়িতে রাসায়নিকের গুদাম পাওয়া গেলে সেই বাড়ির মালিকের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। অগ্নিকাণ্ডের একটি ভিডিও ফুটেজ পাওয়া গেছে। সেখানে দেখা গেছে গাড়ির গ্যাস সিলিন্ডার থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। সরকারি তথ্য অনুযায়ী এতে ৬৭ জনের মৃত্যু হয়েছে।
রাসায়নিক ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আরিফ হোসাইন জানিয়েছেন, রাসায়নিক ব্যবসায়ীরা এখান থেকে সরতেই চায়। অনেকেই এর মধ্যে গুদাম সরিয়েছেন। কিন্তু এটি দেশের প্রধান ব্যবসায় কেন্দ্র হওয়ায় তাদের জন্য দোকান সরানো কঠিন। সরকার এ বিষয়ে উদ্যোগ নেয়ার কথা বললেও শেষ পর্যন্ত কিছু হয়নি। এই সমিতির সদস্য ব্যবসায়ীর সংখ্যা আড়াই হাজারের মতো। এ ছাড়া ক্ষুদ্র পরিসরে আরো বহু মানুষ এ ব্যবসায়ের সাথে যুক্ত।
বেনজিন, ইথাইল অ্যালকোহল, মিথাইল অ্যালকোহল, হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড ইত্যাদিসহ অতি দাহ্য ২৯টি রাসায়নিক আমদানি ও মজুতের জন্য বিস্ফোরক অধিদফতরের অনুমোদন প্রয়োজন হয়। দেখা যাচ্ছে, বড় ব্যবসায়ীরা অনুমোদন নিয়ে নিয়মমতো সেগুলো সংরক্ষণ করতে পারলেও ছোট অনেক ব্যবসায়ী তা করেন না। মিটফোর্ড এলাকার রাসায়নিকের ব্যবসায়ী এনায়েত হোসেন পাকিস্তান আমল থেকে ওই এলাকায় তার বাবার রাসায়নিকের ব্যবসায় পরিচালনা করছেন। বাংলাদেশ হওয়ার পর তারা চার ভাইও একই ব্যবসায় যুক্ত হন। তিনি বলেন, একেকটা দুর্ঘটনার পর পরিস্থিতি এমন হয় যে রাসায়নিকের ব্যবসায়ীদের ধরে বেঁধে কারাগারে নিয়ে যেতে পারলেই যেন সমাধান হবে। কিন্তু সমস্যাটার শিকড়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন না কেউ। দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসা ব্যবসায় সরাতে প্রস্তুতি ও বিনিয়োগ প্রয়োজন। হাজারীবাগ থেকে ট্যানারিগুলো সরাতে সরকারকে বেগ পেতে হয়েছে, কারণ ব্যবসায়ীরা হাজারীবাগ ছাড়তে চাননি। কিন্তু রাসায়নিকের ব্যবসায়ীরা পুরান ঢাকা ছাড়তে রাজি। কিন্তু সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া এটি সম্ভব নয়।

প্রায়ই ছোটখাটো অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটছে
নিমতলী ও চুড়িহাট্টার মতো এলাকায় প্রায়ই ছোটখাটো অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটছে। গত বছরের ১৬ জুন লালবাগের ইসলামবাগের বাগানবাড়ি এলাকায় আগুনে পুড়ে যায় ১৬টি কারখানা ও ২০টি গুদাম। গত বছরের আগস্টে পাশের এলাকা লালবাগের আলীঘাটে আগুন লেগে বেশ কয়েকটি ঘর পুড়ে যায়। এর আগের বছর ২০১৭ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ইসলামবাগের একটি চারতলা বাড়ির নিচতলায় থাকা প্লাস্টিক কারখানা থেকে আগুন ছড়িয়ে তিনজন নিহত হন।
ফায়ার সার্ভিসের লালবাগ এলাকায় ওয়্যারহাউজ পরিদর্শক নাসরিন সুলতানা জানান, বসতবাড়িতে প্রচুর কারখানা-গুদাম স্থাপনের কারণে এখানে নানা ধরনের দুর্ঘটনা ঘটছে প্রায়ই। সরেজমিন স্থানীয় বাসিন্দা ও ব্যবসায়ীদের কয়েকজনের সাথে কথা বলে ধারণা পাওয়া যায়, এমন ঝুঁকির মধ্যে থেকেও তাদের তেমন দুশ্চিন্তা নেই।

সরু গলিতে অসহায় ফায়ার সার্ভিস
আগুন দ্রুত ছড়াচ্ছিল। ছড়িয়ে পড়ছিল আশপাশের ভবনে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ছুটে গিয়েছিল ফায়ার সার্ভিসের বেশ কিছু গাড়ি। কিন্তু ঘটনাস্থলের কিছু দূরে থেমে যেতে হয় সেগুলোকে। কারণ, সরু গলি দিয়ে গাড়িগুলোর আর এগোনোর সুযোগ ছিল না। ফায়ার সার্ভিসের নিরুপায় কর্মীরা লম্বা পাইপ দিয়ে পানি টেনে নিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালান।
পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় আগুন নেভানোর কাজে নিয়োজিত ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা জানিয়েছেন, সড়কগুলো সরু হওয়ায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে তাদের বেশি সময় লেগেছে। এ ছাড়া সরু সড়কের ওপর দিয়ে যাওয়া বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট, ডিশের তারও অগ্নিনির্বাপণ কাজে বিঘœ ঘটায়। রাজধানীর অন্য এলাকা থেকে চুড়িহাট্টা মোড়ে যাওয়ার প্রধান পথ উর্দু রোড ও ওয়াটার ওয়ার্কস রোড। এই দুটি রোড থেকে পৃথক চারটি গলি পৌঁছেছে চুড়িহাট্টা মোড়ে। এই গলিগুলো মাত্র ৮ থেকে ১০ ফুট চওড়া। এই পথে একটি ব্যক্তিগত গাড়ি ঢুকলে বিপরীত পাশ থেকে একটি রিকশারও ঠিকমতো যাওয়ার উপায় নেই।
ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা বলেন, গাড়ি নিয়ে আগুনের কাছাকাছি যাওয়া গেলে দ্রুত সময়ের মধ্যে তা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব ছিল।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কেমিকৌশল বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ড. সৈয়দা সুলতানা রাজিয়া জানিয়েছেন, শুধু পুরান ঢাকাই নয়, সারা দেশে কোথায় কতটা রাসায়নিক গুদাম বা স্থাপনা আছে, তার একটা জরিপ করা প্রয়োজন। এ ছাড়া জরুরিভিত্তিতে জাতিসঙ্ঘ পরিবেশ কর্মসূচি (ইউএনইপি) এর প্রস্তাবনার আলোকে বিশেষজ্ঞ গবেষক, ইন্ডাস্ট্রি এবং সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে রাসায়নিক ব্যবস্থাপনা এবং নিরাপত্তাবিষয়ক জাতীয় সমন্বয় কমিটি নামে একটি কাঠামো করা যেতে পারে, যারা অদূরভবিষ্যতে একটি পূর্ণাঙ্গ অধিদফতরে রূপ নিতে পারে।


আরো সংবাদ



premium cement