পাঠকের পদচারণায় মুখর বইমেলা
- মাহমুদুল হাসান
- ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০০:০০
বসন্ত পেরিয়ে ভালোবাসা দিবস, তারপর টানা দু’দিন ছুটি হওয়ায় গত বুধবার থেকে লেখক-পাঠক ও দর্শনার্থীদের পদচারণায় জমজমাট বইমেলা প্রাঙ্গণ। আর এই চার দিনে অমর একুশে গ্রন্থমেলা বেশ জমজমাট ছিল বলে জানিয়েছেন গ্রন্থমেলার বিভিন্ন প্রকাশক। দল বেঁধে আসছেন আর বই কিনছেন বইপ্রেমীরা। পুরো মেলায় যেন তিল পরিমাণ জায়গা ফাঁকা নেই। সর্বত্রই দর্শনার্থীদের সরব উপস্থিতি।
শুক্রবার ছুটির দিন হওয়ায় সকাল থেকেই বইমেলা তার চিরচেনা রূপ পেয়েছে। সকালে ছিল শিশুপ্রহর। শিশু-কিশোরদের সরব উপস্থিতি মেলাকে করেছে প্রাণবন্ত। বিকেলে সব শ্রেণী-পেশার, সব বয়সী মানুষের যেন মঞ্জিল ছিল বইমেলা। বেলা ৩টায় অমর একুশে বইমেলার দ্বার খোলার পর থেকেই মেলায় প্রবেশ করতে থাকেন দর্শনার্থীরা। বেলা যত বেড়েছে মেলায় দর্শনার্থীদের সংখ্যাও বেড়েছে। দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে মেলায় প্রবেশ করতে যেন কোনো ক্লান্তি নেই দর্শনার্থীদের। কিনেছেন প্রিয় লেখকের বই।
দর্শনার্থীদের সরব উপস্থিতিতে গত কয়েক দিনে মেলায় বেচাবিক্রিও হয়েছে বেশ। সকাল থেকেই ব্যস্ত সময় পার করেছেন প্রকাশনাগুলোয় থাকা বিক্রয়কর্মীরা। বেচাবিক্রি ভালো হওয়ায় হাসি ফুটেছে প্রকাশকদের মুখেও। প্রিয়মুখ প্রকাশনীর বিক্রয়কর্মী শুভ বলেন, মেলায় আজ দর্শনার্থী অনেক বেশি। বেচাবিক্রিও হচ্ছে খুব ভালো। আশা করি, আগামী দিনগুলোয়ও এ ধারা অব্যাহত থাকবে।
ঋতুরাজ বসন্তের সকালে ফাল্গুনের মাতাল হাওয়ার বৃষ্টি মন কেড়ে নিতে পারে প্রকৃতিপ্রেমী যে কারোরই। তবে ফাল্গুনের হঠাৎ এই বৃষ্টিতে অপ্রত্যাশিত ছন্দপতন ঘটল মাসব্যাপী অমর একুশে গ্রন্থমেলার। গত রোববার সকালের ফাল্গুনের হঠাৎ বৃষ্টি আর দমকা হাওয়ার ঝাপটায় বেশ ক্ষতির মুখে পড়েছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা। বৃষ্টিতে ভিজে গেছে সব স্টলেরই কমবেশি বই, ভেঙে পড়ে অনেক স্টলের স্থাপনাও। বিকেলেও অনেক স্থানে জমে থাকে সকালের বৃষ্টির পানি। স্টলের ক্ষতির কারণে বাংলা একাডেমির অব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন প্রকাশনা সংশ্লিষ্টরা। যদিও সার্বিক প্রস্তুতির কোনো কমতি ছিল না দাবি করে, ক্ষতির জন্য প্রকাশনা সংস্থাগুলোর ওপর দায় চাপাচ্ছে বাংলা একাডেমি।
জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রুবিনা আক্তার বলেন, ছুটির দিনে মেলায় চাপ বেশি থাকায় আজ বন্ধুদের নিয়ে বইমেলায় এসেছি। বাংলা একাডেমি অংশ ঘোরা শেষে এখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশ থেকে মৌলিক কিছু বই কেনার অপেক্ষায় আছি। হুমায়ূন আহমেদের দু’টি বই কিনেছি। পছন্দের বই পেলে আরো কিছু কিনব। সময় পেলেই মেলায় আসি। বইমেলায় না এলে ভালো লাগে না।
বিক্রেতাবিহীন স্টল
বাংলা একাডেমির পুকুরপাড়ের দিকে গেলে সহজেই নজরে পড়বে দু’টি শিশুর প্রতিকৃতি দিয়ে সাজানো একটি স্টল। সেখানে লেখা ‘এক টাকায় আহার’। সামনে বই সাজানো। পাশে টাকা রাখার বাক্স ও রসিদ বই। এই স্টল থেকে বই কিনতে হবে নিজ দায়িত্বে। পাশেই টাঙানো আছে মূল্যতালিকা।
পথশিশুদের নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের একটি স্টল এটি। তারা বিদ্যানন্দ প্রকাশনী নামে গত বছর থেকে বইমেলায় স্টল নিয়ে বসছে। তবে এ বছরই তারা ‘বিক্রেতাবিহীন’ স্টল দিয়েছে। ভিন্নধর্মী হওয়ায় অনেকেরই নজর কাড়ছে এই স্টল। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় প্রায় সবাই একবার উঁকি দিচ্ছেন। কেউ কেউ নিজ দায়িত্বে বইও কিনছেন।
রওশনা ইলা ২০১৭ সাল থেকে বিদ্যানন্দের একজন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছেন। স্টলে বিক্রেতা না রাখার প্রসঙ্গে রওশনা ইলা বলেন, দেশে এখনো সততা আছে। সততা না থাকলে দেশ এগোতে পারত না। বইয়ের দোকানটাও চালাতে পারতাম না। এখানে মানুষ বই কিনতে আসে। যিনি বই কিনতে আসেন, তিনি চোর হন না। তার মতে, ভালো মানুষেরাই বই কেনেন। পথশিশুদের নিয়ে যারা চিন্তা করেন, তারা টাকা না দিয়ে যাবেন না। এই স্টলটা পথশিশুদের জন্য। এখানে তাদেরই থাকার কথা ছিল। কিন্তু সেই শিশুদের কাউকে রাখা সম্ভব হয়নি বলে শিশুদের প্রতিকৃতি বানিয়ে রাখা হয়েছে। মহসিন জানান, বিদ্যানন্দ থেকে এবার ১৫টি বই এসেছে। প্রত্যাশার চেয়েও বেশি বিক্রি হচ্ছে।
বই বিক্রির এই টাকা বিদ্যানন্দ সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পেছনে ব্যয় করবে বলে জানানো হয়। প্রতিদিন মেলা শুরু হওয়ার সময় স্বেচ্ছাসেবকদের কেউ এসে স্টল খুলে দিয়ে যান এবং দিন শেষে আবার কেউ এসে এটা বন্ধ করে দেন।
শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা
মেলায় প্রবেশের পথে টিএসসিতে সুইচ বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে কিছু স্বেচ্ছাসেবী সদস্যকে দেখা যায়। তাদের সাথে রয়েছে অনেক হুইল চেয়ার। এ বিষয়ে সুইচ বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের প্রধান সমন্বয়ক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, তিন বছর ধরে আমরা অমর একুশে গ্রন্থমেলায় শারীরিক প্রতিবন্ধী ও যারা হেঁটে চলাফেরা করতে পারে না, তাদের হুইল চেয়ারের মাধ্যমে আমরা মেলা ঘুরে দেখার সেবা দিচ্ছি। মেলার দুই প্রান্ত টিএসসি এবং দোয়েল চত্বরে ১৫টি হুইল চেয়ার নিয়ে সেবা দিচ্ছি আমরা। হুইল চেয়ারে করে যতক্ষণ খুশি ততক্ষণ মেলায় ঘোরার সুবিধা আমরা দিয়ে থাকি। সাথে আমাদের একজন সদস্যও থাকেন। শিশুদের জন্য রয়েছে আমাদের বিশেষ চেয়ার। মেলায় আসার পর যেকোনো অভিভাবক তার শিশুকে চেয়ারে বসিয়ে মেলায় নিয়ে যেতে পারবেন। প্রতিদিন বেলা ৩টা থেকে রাত ৮টা এবং শুক্রবার সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত চলে আমাদের এই সেবা। ২০১১ সাল থেকে পথশিশুদের শিক্ষা দান এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ওপরে সচেতনতামূলক কাজ করে এই সুইচ বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন।
এবারের বইমেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশ সুদৃশ্য হয়ে ওঠার পেছনে নিয়ামক গ্লাস টাওয়ার, কৃত্রিম লেক এবং মেলায় স্টলের নতুন বিন্যাস। মেলার যেকোনো প্রান্ত থেকে চোখে পড়ে খোলা লেক, পাশে সারি সারি সিমেন্টের বেঞ্চ। এসব ছাপিয়ে চোখ আটকে যায় গ্লাস টাওয়ারে। বইপ্রেমীরা মেলায় এসে স্টলে স্টলে ঘুরে বই কিনতে গিয়ে তাদের বেশির ভাগের যে পা ব্যথা হয় তার প্রমাণ মেলে লেকের ধারের বেঞ্চগুলোর দিকে তাকালে।