সিটিং সার্ভিসের নামে বাড়তি ভাড়া আদায়
- মাহমুদুল হাসান
- ২৯ জানুয়ারি ২০১৯, ০০:০০
দুই কোটি মানুষের এই নগরীতে গণপরিবহন মাত্র সাড়ে চার হাজার। ফলে পরিবহন সঙ্কট প্রতিনিয়ত লেগেই আছে। সকাল-বিকেল যাতায়াতে প্রতিনিয়ত ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে কর্মজীবী মানুষকে। এ ভোগান্তিকে পুঁজি করে উন্নত সেবার নামে ফায়দা লুটছে পরিবহনসংশ্লিষ্টরা। এক কথায় পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়ছে রাজধানীবাসী। বাড়তি ভাড়া নিয়ে নৈরাজ্যের কোনো সমাধান নেই। ঢাকা মহানগরে বিআরটিএ নির্ধারিত সর্বনিম্ন ভাড়া বাসের জন্য ৭ টাকা আর মিনিবাসের জন্য ৫ টাকা। মহানগর পরিবহন নীতিমালায় লোকাল বা সিটিং ভেদে ভাড়ার কোনো হেরফের নেই। মোটরযান আইনেও সিটিং সার্ভিস বলে কিছু নেই। অথচ সিটিং সার্ভিসের বাসগুলোতে সর্বনিম্ন ভাড়া ১০ টাকা থেকে ক্ষেত্রবিশেষে ২৫ টাকা পর্যন্ত নিচ্ছে। গেটলক, ডাইরেক্ট ও সিটিং সার্ভিসের নামে প্রতারণা চলছেই। রাজধানীর ৯৬ শতাংশ গণপরিবহন এখন সিটিংয়ের নামে প্রতারণা চালিয়ে যাচ্ছে। এই প্রতারণার দায় মালিক-শ্রমিকেরা একে অপরের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছেন।
রাজধানীতে গত ১৫ জানুয়ারি থেকে চলছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক শৃঙ্খলা পক্ষ, চলবে ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত। এই সময়ে রাজধানীজুড়ে গণপরিবহনের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। মগবাজারের বাসিন্দা রবিউল ইসলাম, প্রতিদিন মগবাজার থেকে মতিঝিলে অফিস করেন। গতকাল মগবাজার ওয়্যারলেস থেকে বলাকা গাড়িতে মতিঝিল যাওয়ার পথে প্রতিবেদককে তিনি জানান, ট্রাফিক পক্ষ শুরুর পর থেকে বলাকা বাস অনেক কমে গেছে। ফলে সিটিং সার্ভিস হলেও জোর করে উঠতে হয় প্রতিদিন। বাসে আগে থেকেই কয়েকজন দাঁড়িয়ে থাকায় মগবাজার থেকে আর যাত্রী নিতে চায় না। নিলেও সারা পথ দাঁড়িয়ে এসে ১০ টাকা ভাড়া দিতে হয়।
মতিঝিল থেকে যাত্রাবাড়ীর দূরত্ব তিন কিলোমিটার। বাসে এই দূরত্বে ভাড়া হওয়া উচিত পাঁচ টাকা। কিন্তু তথাকথিত ‘সিটিং সার্ভিস’ বলাকা বাসে চড়ায় রাবেয়া খাতুনকে দিতে হয়েছে ১০ টাকা। এভাবেই সরকার নির্ধারিত ভাড়াকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নিজেদের ইচ্ছামতো ভাড়া নির্ধারণ করছেন ঢাকার ভেতরে চলাচল করা বাসের মালিকেরা। জিম্মি হয়ে পড়া যাত্রীরা বলছেন, অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে ভাড়া নির্ধারণ করার কোনোই নিয়ম-কানুন নেই।
তবে অফিস শুরু ও শেষের সময় এই ‘সিটিং সার্ভিস’ বাসগুলোই আর সব সাধারণ বাসের মতো হয়ে যায়। এ সময় তারা দাঁড়িয়ে যাওয়ার জন্যও যাত্রী তোলে, ভাড়া নেয় সিটিংয়ের সমান। রাজধানীতে চলমান প্রতিটি বাসে নির্ধারিত ভাড়ার তালিকা টাঙানোর নিয়ম থাকলেও গতকাল বিভিন্ন পথে চলাচলকারী পরিবহনের বাসে উঠে দেখা যায়, নির্ধারিত ভাড়ার তালিকা টাঙানো নেই।
মিরপুর ইসিবি চত্বর থেকে আজিমপুর পথে চলাচলকারী মিরপুর লিংক বাসটির সর্বনিম্ন ভাড়া ২৬ টাকা। মিরপুর রূপনগর থেকে আজিমপুর পর্যন্ত চলাচলকারী বিহঙ্গ পরিবহনের সর্বনিম্ন ভাড়া ১৬ টাকা। ঢাকার অন্যান্য পথে চলাচলকারী লাব্বাইক, ওয়েলকাম, নিউ ভিশন, বসুমতীসহ আরো কয়েকটি পরিবহনের সর্বনিম্ন ভাড়া ১৫ টাকা। মিরপুর থেকে গুলিস্তান ও মতিঝিলে চলাচলকারী খাজাবাবা পরিবহন লিমিটেড, ইটিসি ট্রান্সপোর্ট কোম্পানি লিমিটেড ও বিকল্প অটো সার্ভিস লিমিটেডের বাসগুলোর সর্বনিম্ন ভাড়া ১৫ টাকা। ভাড়া বেশি নেয়া হলেও প্রতিটি বাসেই যত্রতত্র থামিয়ে আসনের অতিরিক্ত যাত্রী তুলতে দেখা গেছে। চলন্ত বাসের দরজাও খোলা। চিড়িয়াখানা থেকে মতিঝিল পথে চলাচলকারী নিউ ভিশনের এক যাত্রী বলেন, ভাড়া সিটিংয়ের নিলেও দাঁড়ানো যাত্রী তোলে। সব বাসেই এমন দাঁড়ানো লোক তোলে। রাস্তায় বাস কম। লোকজন বাধ্য হয়েই ওঠে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ প্রতি কিলোমিটার ১ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ১ টাকা ৭০ পয়সা আর সর্বনিম্ন ভাড়া ৫ থেকে ৭ টাকা বেঁধে দিলেও তা মানছে না পরিবহনগুলো। সিটিং ও গেটলক সার্ভিসের নামে তারা সর্বনিম্ন ভাড়া আদায় করছে ১০ থেকে ১৫ টাকা। জানা গেছে, মহাখালী থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত সরকার নির্ধারিত ভাড়া ৮ টাকা। এই রুটে বিভিন্ন পরিবহনে ২০ টাকা ভাড়া আদায় করা হয়। এটিকে আবার ভাগ করে নেয়া হয়েছে। অর্থাৎ মহাখালী থেকে মগবাজার এলেই গুনতে হচ্ছে ২০ টাকা। আগে এই পথের ভাড়া ছিল ১০ টাকা।
২০১৮ সালের মে মাসে বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজধানীর ৯৬ শতাংশ বাস সিটিং সার্ভিস হিসেবে চলাচল করে। সংগঠনটি ঢাকার ২১টি পথের এক হাজার ৫৩টি বাসের ওপর এই জরিপ চালায়। সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক বলেন, আইন প্রয়োগের দায়িত্বে যারা আছে, তারা ঠিকমতো তা করছে এমন প্রতিফলন সড়কে দেখা যাচ্ছে না। পরিবহন মালিকেরা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। গত এক বছরে এই সিটিং সার্ভিসের নামে নৈরাজ্য আরো খারাপ হয়েছে।
রাজধানীতে সিটিং সার্ভিস বন্ধে ২০১৭ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ), পরিবহন মালিক সমিতি ও পুলিশ অভিযান শুরু করে। এ সময় পরিবহন মালিকেরা বাস বন্ধ করে দিয়ে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করেন। এরপর সিটিং সার্ভিস পুনরায় চালু করে এ বিষয়ে করণীয় ঠিক করতে বিআরটিএ, মালিক-শ্রমিক সংগঠন, নাগরিক প্রতিনিধি ও পুলিশের সমন্বয়ে আট সদস্যের এই কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটি ২৬ দফা সুপারিশ সংবলিত প্রতিবেদন ২০১৭ সালের নভেম্বরে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়।
এই সুপারিশগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত আটকে আছে ঢাকা মহানগর আঞ্চলিক পরিবহন কমিটিতে (মেট্রো আরটিসি)। ঢাকায় বাস চলাচলের অনুমতি দেয় এই মেট্রো আরটিসি।
কমিটি সুপারিশ করেছিল, রাজধানীতে চলাচলকারী কিছু বাস সিটিং আর কিছু হবে লোকাল। দুই শ্রেণীর বাসের রঙ হতে হবে আলাদা। সিটিং সার্ভিসে দাঁড়িয়ে যাত্রী পরিবহন করা যাবে না, স্টপেজ থাকবে কম। আর লোকাল বাসকে কোনো অবস্থাতেই সিটিং সার্ভিস হিসেবে ব্যবহার না করার পরামর্শ দিয়েছিল কমিটি। ভাড়া-নৈরাজ্য, যাত্রী হয়রানি ও একচেটিয়া ব্যবসা বন্ধে বেসরকারি মালিকদের অনুমতি বন্ধ রেখে বিআরটিসির দ্বিতল বাস বেশি করে চালুর পরামর্শ দিয়েছিল।
বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, গণপরিবহনে বিশৃঙ্খলা কমানোসহ সড়কের নৈরাজ্য বন্ধে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। শুধু সচেতনতা বাড়াতে কর্মসূচি পালন করে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো সম্ভব নয়। দীর্ঘমেয়াদি স্থায়ী সমাধান ছাড়া এই নৈরাজ্য বন্ধ হবে না।