২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

জারের পানি কতটা বিশুদ্ধ?

-

সুপেয় পানির দুষ্প্রাপ্যতার সুযোগে রাজধানীজুড়ে চলছে ‘জার’ নামক প্লাস্টিক কনটেইনার ভর্তি পানির রমরমা ব্যবসায়। কমদামে বেশি পানির প্রলোভন দেখিয়ে চুটিয়ে ব্যবসায় করছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। প্লাস্টিকের কনটেইনারে ভর্তি করে ‘মিনারেল ওয়াটার’ নামে বিক্রি করা হচ্ছে এই পানি। একটি জারে প্রায় ৪০ লিটার পানি থাকে। দাম মাত্র ৩০ থেকে ৪০ টাকা।
এই পানির ব্যবসায় ঘিরে রাজধানীতে গড়ে উঠেছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। জানা গেছে, বেশির ভাগ জারের পানি আদৌ পরিশোধন করা হয় না। সরাসরি ওয়াসার সাপ্লাই করা
পানিতে শুধু ফিটকিরি ও দুর্গন্ধ দূর করার ট্যাবলেট মিশিয়ে তা জারে ভরে বাজারজাত করা হচ্ছে। লিখেছেন মাহমুদুল হাসান
পানির অপর নাম জীবন। ঢাকার নাগরিক জীবনে বেঁচে থাকার জন্য সেই পানির একটি ফোঁটাও মেলে না বিনামূল্যে। তাই সাধারণ মানুষ খুঁজে ফেরেন কম মূল্যের সুপেয় পানি। ঘরে ওয়াসার লাইনের পানি ফুটিয়ে পান করেন তারা। বাইরে তাদের ভরসা ‘ফিল্টার্ড পানি’। জারে সরবরাহ করা এ পানি আসলেই কি নিরাপদ?
রাজধানীর মতিঝিলের ফুটপাথের একটি দোকানে চা পান করছিলেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী রাশেদ নাঈম। চা পানের আগে জার থেকে এক গ্লাস পানি পান করে নিলেন তিনি। এই পানি কতটুকু নিরাপদ জানতে চাইলে রাশেদ বলেন, এটা ফিল্টার করা। ওরা তো ভালোই বলে। তবে ইদানীং তো অনেক কথাই শুনছি। কিন্তু কিছু করার নেই। বাইরে থাকলে খেতেই হয়!
চা দোকানদার পলাশের জারের ফিল্টার করা পানির প্রতি গ্লাসের দাম এক টাকা। তার কাছেও জানতে চাওয়া হয়, জারের পানি কতটুকু নিরাপদ। পলাশ বলেন, আমরা প্রতিটি জার ৩০ টাকা করে কিনি। বিভিন্ন কোম্পানি পানি নিরাপদ বলে আমাদের দোকানে দিয়ে যায়। আমরাও সরল বিশ্বাসে এসব কিনে নেই। কাস্টমারও সরল বিশ্বাসে খায়। আদৌ বিশুদ্ধ কি না আমি তো বলতে পারব না।
গত কয়েকদিনে রাজধানীর কয়েকটি এলাকায় এভাবেই অনেকের কাছে জারের পানির ব্যাপারে জানতে চাওয়া হয়। এতে দেখা গেছে, বেশির ভাগ মানুষই জারের পানি নিয়ে সংশয়ে আছেন। তবে দোকান বা রেস্টুরেন্টে দেদার বিক্রি হচ্ছে জারের পানি। পথচারী, চাকরিজীবী, শিক্ষার্থীসহ নিম্ন-আয়ের মানুষই বেশি জারের পানি পান করছেন। সন্দেহ থাকলেও কারোই স্পষ্টভাবে জানা নেই, ফিল্টার করা পানি মনে করে যা পান করছেন তা নিরাপদ কি না। অথচ খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই জারের পানির বেশির ভাগই সরাসরি ওয়াসার লাইন থেকে নেয়া হচ্ছে। অথচ বাসায়ও এ পানি ফুটিয়ে ছাড়া কেউ পান করেন না। দিনের পর দিন অস্বাস্থ্যকর পানি সরবরাহের কারবার করে যাচ্ছেন কিছু অসৎ ব্যবসায়ী। মাঝে মধ্যে দু-একটি অভিযান চালানো হলেও পানির মান যাচাইয়ে নেই কোনো কার্যকর পদক্ষেপ।
সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বিএআরসি), জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনে (বিএসটিআই) জারের পানির নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হয়। ২৫০টি নমুনা পরীক্ষা করে বিএআরসির গবেষকেরা জারের পানিতে কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়া পেয়েছেন। মানুষ ও প্রাণীর মলে এ জীবাণু থাকে। পানিতে টোটাল কলিফর্ম ও ফিকাল কলিফর্মের পরিমাণ শূন্য থাকার কথা থাকলেও ৯৭ শতাংশ জারের পানিতে দুটিরই উপস্থিতি রয়েছে, যা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। অন্য দুই প্রতিষ্ঠানের পরীক্ষায়ও তথ্য মিলেছে, বেশির ভাগ জারের পানি ফিল্টার বা পরিশোধন করা হয় না। এতে রোগজীবাণু রয়েছে।
ফার্মগেটের একটি রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবার শেষে গ্লাসে সরবরাহ করা জারের পানি পান করছিলেন তেজগাঁও কলেজের শিক্ষার্থী মাজনুন আহমেদ। জারের পানি খান কি না এ প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, খাবারের সাথে পানি দিলে টাকা রাখে না। আর ছোট এক বোতল পানির দাম ১৫ টাকা। তাই খাই। এসব পানি কোত্থেকে কিভাবে আনে আল্লাহই জানে। একটু পরে হোটেলের হাত ধোয়ার জায়গায় দেখা গেল ট্যাপের পানি থেকে সরাসরি জারে পানি পূর্ণ করে রেখে দিচ্ছে। সারা দিনই মানুষ জার থেকে নিরাপদ পানি ভেবে ট্যাপের পানি পান করছে।
বর্তমানে জারে করে প্রতিদিন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সরকারি-বেসরকারি কার্যালয়, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান, হোটেল-রেস্তোরাঁ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন জায়গায় পৌঁছে দিচ্ছে পানি। বিএআরসি গবেষকেরা রাজধানীর ফার্মগেট, কাওরান বাজার, এলিফ্যান্ট রোড, নিউ মার্কেট, চকবাজার, সদরঘাট, কেরানীগঞ্জ, যাত্রাবাড়ী, মতিঝিল, বাসাবো, মালিবাগ, রামপুরা, মহাখালী, গুলশান, বনানী, উত্তরা, এয়ারপোর্ট, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, গাবতলী, আমিনবাজার, আশুলিয়া ও সাভার থেকে জারের পানি নিয়ে গবেষণা করেন। ২৫০টি নমুনা নিয়ে এসজিএস ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করা হয়। ওই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, শতভাগ জারের পানিতেই কলিফর্মের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এসব জারের প্রতি ১০০ মিলিলিটার পানিতে টোটাল কলিফর্মের মাত্রা ছিল ১৭ ও এক হাজার ৬০০ মিলিলিটার এমপিএন (সর্বোচ্চ সম্ভাব্য সংখ্যা)। আর ১০০ মিলিলিটার পানিতে শুধু ফেক্যাল কলিফর্মের মাত্রা ছিল ১১ ও ২৮০ মিলিলিটার এমপিএন। বিএআরসি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, জারের পানিতে ক্ষতিকর মাত্রায় মানুষ ও প্রাণীর মলের জীবাণু টোটাল কলিফর্ম ও ফিকাল কলিফর্ম পাওয়া গেছে। এসবের পরিমাণ শূন্য থাকার কথা থাকলেও ৯৭ শতাংশ জারের পানিতে এ দুটিরই উপস্থিতি রয়েছে, যা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
বিএআরসির প্রতিবেদনে বলা হয়, কলিফর্ম মূলত বিভিন্ন রোগ সৃষ্টিকারী প্যাথোজেন, ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, প্রোটোজোয়া সৃষ্টি করে। কলিফর্ম বিভিন্ন উপসর্গ ছাড়াও ক্রমাগত মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট করে দেয়। সংশ্লিষ্টরা জানান, জারের পানিতে বেশি মাত্রায় আছে কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়া। এই পানি পান করার ফলে সাধারণ মানুষ মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁঁকিতে আছেন। কলিফর্ম গোত্রের অণুজীব মানবদেহে দীর্ঘস্থায়ী ডায়রিয়া, মাথা ব্যথা, বমিভাব, পেট ব্যথা, জ্বর-ঠাণ্ডা, বমির মতো নানা উপসর্গ সৃষ্টির পাশাপাশি ক্রমাগত মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। এই রোগের কারণে ক্রমান্বয়ে লোহিত রক্ত কণিকা ধ্বংস হয়ে যায় এবং অনেক ক্ষেত্রে কিডনিতে মারাত্মক সমস্যা দেখা দেয়। তাই এসব পানি পান থেকে বিরত থেকে ফোটানো পানি পানের পরামর্শ দেন তারা।
ঢাকা শহরের অলিগলিতে তৈরি করা জারের পানি সরবরাহ করা প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগেরই বিএসটিআইয়ের লাইসেন্স নেই। কোথাও লাইসেন্স থাকলেও শর্ত অনুযায়ী পানি পরীক্ষা করা হয় না। পানি বাজারজাত করার ক্ষেত্রে ওই বিএসটিআইয়ের কিছু নির্ধারিত মাত্রা আছে। যাকে বলা হয় বিডিএস (বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস)। বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান মনগড়াভাবে উপাদানগুলোর মাত্রা বা পরিমাণ বোতলের গায়ে উল্লেখ করেছে। জারের গায়ে খনিজ উপাদানের উপস্থিতি বা গুণগত মান সম্পর্কিত কোনো লেবেলই থাকে না। ফলে পানির গুণাগুণ সম্পর্কে কোনো তথ্যই পান না ভোক্তারা।
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, পানির ব্যবসায় যারা করছে, তাদের বেশির ভাগই প্রতারক। তারা আসলে ওয়াসার লাইনের পানি দিচ্ছে। সেখানে তাদের কাছে উন্নতমানের সেবা পাওয়ার আশাটা দুরাশা ছাড়া আর কিছুই নয়। এ জন্যই পানি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে শৃঙ্খলার মধ্যে আনা প্রয়োজন।
বিএসটিআই কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, রাজধানীতে ১৯৯টি পানি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দেয়া হয়েছে, যার মধ্যে জার ১৬৫টি ও বোতল ৩৪টি। নির্দিষ্ট মানের সাথে আন্তর্জাতিক একটি মান আছে আইএসও-১৭৬৫, এটি অনুসরণ করেই বিএসটিআই লাইসেন্স দিয়ে থাকে। প্রতিষ্ঠানগুলোয় দক্ষ জনবল ও ল্যাবরেটরি আছে কি না সব যাচাই-বাছাই করে তবেই দেয়া হয় লাইসেন্স। যেসব প্রতিষ্ঠানে লাইসেন্স নেই, সেগুলো শনাক্ত করতে অভিযান চলছে। আর যেগুলোর লাইসেন্স আছে, সেখানে পানির নিয়মতান্ত্রিক পরীক্ষা হয় কি না তা-ও যাচাইয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে জানিয়েছে বিএসটিআই কর্তৃপক্ষ। হ

 


আরো সংবাদ



premium cement

সকল