ঢাকায় চালু হলো ঐতিহ্য জাদুঘর
- সুমনা শারমিন
- ১৬ অক্টোবর ২০১৮, ০০:০০
রাজধানীর বুকে আরো একটি জাদুঘরের যাত্রা শুরু হলো। ইতিহাসপ্রেমীদের জন্য নিমতলী দেউড়িখ্যাত একসময়ের ঢাকার নবাবদের নিমতলী প্রাসাদের পশ্চিম প্রবেশদ্বারটিকে ইতিহাসের সংগ্রহশালায় রূপান্তরিত করা হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার থেকে চালু হয়েছে পুরান ঢাকার নিমতলীর এশিয়াটিক সোসাইটি ঐতিহ্য জাদুঘর। লিখেছেন সুমনা শারমিন
ঢাকার নায়েব নাজিমদের শেষ চিহ্ন নিমতলী দেউড়ি। কিছুদিন আগে নতুন রঙ লেগেছে দেউড়ি ভবনে। তিনতলা সমান উঁচু এই ভবনের প্রবেশপথটি ঠিক মাঝখানে। দেউড়ি ভবনের নিচতলায় ডান দিকে পাশাপাশি দু’টি ঘর। প্রতি ঘরের তিন দিকে দেয়ালে স্মারক রাখার জায়গা করা হয়েছে। আর বাঁয়ে আছে একটি ঘর। দেউড়ি ভবনটিতেই ছিল এশিয়াটিক সোসাইটির প্রথম অফিস। নিচতলায় তাই রাখা হচ্ছে এশিয়াটিক সোসাইটির নানা স্মারক। প্রথম তলায় তিনটি ঘর দেখে সরু একটি সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠতেই একটি মাত্র ঘর। যেখানে শোভা পাচ্ছে আলোকচিত্র, তৈলচিত্রসহ বেশ কিছু। তৃতীয় তলায় বড় ঘরটি ৪৫ ফুট দীর্ঘ। দেয়ালে আলোকচিত্র আর তৈলচিত্রের পাশাপাশি সংরক্ষণ করা হয়েছে মসলিন, ধাতব মুদ্রা এবং তৈজসপত্র। ঘরের মাঝ বরাবর পশ্চিম পাশে সাজানো হয়েছে নায়েব নাজিমের দরবার। পেছনের এলইডি পর্দায় দরবারের ছবি দেখানোর ব্যবস্থা আছে।
গত ১১ অক্টোবর এশিয়াটিক সোসাইটি ঐতিহ্য জাদুঘরের উদ্বোধন করেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। সংস্কৃতিমন্ত্রী বলেন, জাদুঘর সবার সহযোগিতা ছাড়া গড়ে উঠতে পারে না। এটি অমূল্য সম্পদ। এর মূল্য দেয়ার সক্ষমতা আমাদের এখনো গড়ে ওঠেনি। মন্ত্রী আরো বলেন, এশিয়াটিক সোসাইটি জাদুঘর প্রতিষ্ঠা একটি অত্যন্ত শুভ উদ্যোগ। ঢাকার বাইরেও আমরা আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য সংরক্ষণের কাজ করতে চাই। যদিও নানা কারণে এটি কঠিন কাজ।
জাদুঘরের প্রধান গবেষণা সমন্বয়ক ড. শরীফ উদ্দিন আহমেদ জানালেন, ১৭ থেকে ১৯ শতক পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ের স্মারক আছে এই জাদুঘরে। সময়কাল ধরে সাজানো হয়েছে। পুরো ভবনটা এমনভাবে সাজানো হয়েছে, যেন দর্শনার্থীরা নবাবি আমলে ফিরে যেতে পারেন। এখানে বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় স্মারক সম্পর্কিত ইতিহাস শোনার সুযোগ আছে।
ঢাকায় সুবেদারি আমলের পর আসে নবাবি আমল। নায়েব নাজিমদের নবাব নামেই ডাকা হতো। ঢাকা নিয়াবত বলা হতো এ অঞ্চলকে। তখনকার ঢাকার ইতিহাস-ঐতিহ্য আছে। নবাবদের তালিকা আছে। তাদের কাজকর্মের বর্ণনা আছে। নবাবদের আওতায় ত্রিপুরা আর চট্টগ্রামও ছিল। তার বর্ণনাও থাকছে। তখনকার দালানকোঠা, মসজিদ, ভবন সম্পর্কেও তথ্য আছে। ঢাকার গান-বাজনা, পোশাক, খাবার নিয়েও থাকছে অনেক তথ্য। আমরা গত ১১ অক্টোবর এই জাদুঘরের উদ্বোধনী দিনে তিনটি বই প্রকাশ করেছি। একটির নাম নায়েব নাজিমস অব ঢাকা। আরেকটি বই শুধু ভবনটি নিয়ে। তৃতীয় বইটি আসলে একটি অ্যালবাম। ছবির বই।
ড. শরীফ উদ্দিন আহমেদ বললেন, ‘এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে আমরা যখন ঢাকার ৪০০ বছরপূর্তি প্রকল্প হাতে নেই, তখন ভেবেছিলাম একটা কি দুইটা বই প্রকাশ করেই কাজটা শেষ হয়ে যাবে। পরে এটা বিশাল প্রকল্পে রূপ নেয়। ঢাকার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে এ পর্যন্ত প্রায় ২২টি বই প্রকাশ করা হয়েছে। তারপর ভাবলাম, শুধু বই লিখলে তো হলো না, আরো কিছুও করা দরকার। তখন এ ভবনটির কথা মনে এলো। এটা ঢাকার ঐতিহ্যবাহী একটি নিদর্শন, অথচ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।’ তখন সংস্কারের কথা ভাবা হলো। অনুমোদনও পাওয়া গেল। কিন্তু আসল বিপদ এলো তার পরে। সংস্কার প্রসঙ্গে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলল। সব কিছু সামলে নিয়ে নিমতলী দেউড়ি সংস্কারে হাত দিয়েছিলাম। আমার সাথে ছিলেন স্থপতি ড. আবু সাঈদ এম আহমেদ। দেশ-বিদেশে অনেকের সাথে যোগাযোগ করা হলো। নেয়া হলো পরামর্শ। প্রায় আড়াই বছর লেগে গেল সংস্কার কাজে।
এরপর মনে প্রশ্ন হলো, জাদুঘর কী নিয়ে হবে, জিনিসপত্রই বা পাব কোথায়? প্রথম ভেবেছিলাম, জিনিসপত্র না পেলে জাতীয় জাদুঘর থেকে দেখে দেখে রেপ্লিকা (নকল) তৈরি করব। কলকাতা কিংবা মুর্শিদাবাদ গিয়ে ছবি তুলে আনার চিন্তাও ছিল। তারপর একপর্যায়ে কয়েকটি কর্মশালার আয়োজন করলাম। সেখানে সংগ্রাহক থেকে শুরু করে ঢাকা নিয়ে কাজ করেন এমন লোকও ছিলেন। আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম ঢাকার আদি বাসিন্দাদেরও। আমি নিজেও ঢাকার বনেদি বাড়িগুলোতে গেছি। জাদুঘর সম্পর্কে বলেছি, বুঝিয়েছি।
এভাবে নানা অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন শরীফ উদ্দিন। তিনি জানালেন, উপকরণ সংগ্রহের জন্য আমরা অনেক কষ্ট করেছি। একদিন যেমন রাত ১১টায় মসলিন শাড়ি দেখার জন্য ছুটে গেলাম আলুবাজার। বাড়িতে লিফটও ছিল না। কিন্তু উঠে গেছি আটতলায়।
এ পর্যন্ত ৭৫টি স্মারক পাওয়া গেছে। এগুলোর মধ্যে আছেÑ মসলিন শাড়ি, ধাতব মুদ্রা, আসবাবপত্র, তৈজসপত্র, দরবারে ব্যবহার হতো এমন হুঁকা, কাঁটাচামচ, চাকু, রাইচ ডিশ, প্লেট, বাটি, স্যুপের পাত্র, শাড়ি, শাল, হরিণের শিং, ক্যাশবাক্স, বাতি, কলস, ঝাড়বাতি, পানদান, কুরআন শরীফ, গয়নার বাক্স, সাবানদানি, দোয়াত ইত্যাদি। ১৩ জন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে এগুলো পাওয়া গেছে।
ড. শরীফ উদ্দিন বললেন, এ ভবনের সাথে জড়িত কোনো স্মারক এখনো পাইনি। ভবনটা ১৯ শতকের মাঝামাঝি সময়ে বিক্রি করে দেয়া হয়েছিল। যারা কিনেছে, তারা প্রায় সব কিছুই নিয়ে গেছেন। যে ব্যবসায়ী কিনেছিলেন, তাদের কেউ-ই আর এখানে নেই। এ ভবনের সাথে সম্পর্কিত কিছু উপকরণ জাতীয় জাদুঘর ও আহসান মঞ্জিলে আছে।
ড. শরীফ উদ্দিনের পরিকল্পনা হলো, নিমতলী প্রাসাদে বসবাসকারী নায়েব নাজিমদের জীবনযাত্রা, শিক্ষা, সংস্কৃতি তুলে ধরা। ১৭১৭-১৮৪৩ সাল পর্যন্ত নায়েব নাজিমদের শাসনকালের কালানুক্রমিক তালিকা, বিশিষ্ট নায়েব নাজিমদের পোট্রেট (যারা এ প্রাসাদে বসবাস করেছেন), বিশিষ্ট চিত্রশিল্পীর আঁকা ঈদ, মহররম ও জন্মাষ্টমীর মিছিলের চিত্রকর্ম ছাড়াও নিমতলী দেউড়ি চিত্র (সংস্কারের আগে ও পরে ) প্রদর্শন করা হচ্ছে।
১৭৬৬ সালে নির্মিত ঢাকার নিমতলীর প্রাসাদের নহবতখানা সংবলিত তোরণদ্বার এবং বারোদুয়ারি নামে দরবারগৃহের কিছু অংশ ছাড়া বর্তমানে এর কিছুই অবশিষ্ট নেই। যদিও এককালে এখানে ছিল হাতিশালা, ঘোড়াশালা, সৈন্য-সামন্ত, পাইক-বরকন্দাজ, নকিব-নফর। ছিল বিভিন্ন হম্যরাজি ও নায়েব নাজিমদের প্রাসাদ, হারেম (অন্দরমহল), রাজপুরুষ ও সরকারি অমাত্যদের জন্য বালাখানা, দফতর, কাচারি প্রভৃতি। আরো ছিল খাজাঞ্চিখানা, নকিবদের নহবতখানা এবং সেনাছাউনি।
ঐতিহাসিক স্থাপনাটিকে জাদুঘরে রূপান্তরের অন্যতম লক্ষ্য থেকে একে একটি শিক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, গবেষণা ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হবে। এশিয়াটিক সোসাইটি ও গবেষকদের জ্ঞানচর্চা, শিক্ষা এবং গবেষণার অন্যতম কেন্দ্র ছাড়াও এটি পর্যটকের অনুসন্ধিৎসুতার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠবে। সাধারণ ঐতিহ্যপিয়াসী নাগরিক দর্শক, ঢাকাপ্রেমী, গবেষক ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে অতীত ঐতিহ্য তুলে ধরা এ জাদুঘরের মূল উদ্দেশ্য। জাদুঘরটিকে মূলত ভিজুয়াল ফর্মে রূপান্তরিত করা হবে। সেখানে থাকবে সব রকম তথ্য। তবে খুবই পুরনো স্থাপনাটি ঝুঁঁকিপূর্ণ হওয়ায় একসাথে ১৫ জনের বেশি দর্শনার্থীকে এখানে ঢুকতে দেয়া হবে না। ন্যূনতম দর্শনীর বিনিময়ে এ জাদুঘর পরিদর্শন করা যাবে।
নিমতলী দেউড়ি ভবন
এ ভবনটি ঢাকার প্রথম ব্রিটিশ সামরিক শাসক আর্চিবল্ড সুইন্টনের তত্ত্বাবধানে ১৭৬৫-৬৬ সালে নির্মিত হয় নায়েব নাজিমের বসবাসের জন্য। জসরত খানের উত্তরাধিকারী নবাব হাসনাত জং এবং নবাব নুসরাত জং প্রাসাদটি ১৮৪৩ সাল পর্যন্ত ব্যবহার করেছেন। ১৮৭৯ সালের ভূমিকম্পে প্রাসাদটি পুরো বিধ্বস্ত হয়। তবে দেউড়ি ভবনটি মোটামুটি অক্ষত থাকে। পরে কয়েকবারই প্রাসাদের মালিকানা বদল হয়েছে। ফরাশগঞ্জের রূপলাল দাসও কিনেছিলেন প্রাসাদ এলাকা। ১৯১৩ সালে লর্ড কারমাইকেল এখানে একটি জাদুঘর তৈরির জন্য জমি অধিগ্রহণ করেন। ঢাকা জাদুঘরের গোড়াপত্তনও হয় এখানে। উল্লেখ্য, প্রাসাদ এলাকায় সৈনিকদের ব্যারাক, কর্মচারী আবাস, মসজিদ, বাগান আর পুকুরও ছিল।