২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`
মরক্কোয় ভূমিকম্প

ফোনের ওপার থেকে প্রেমিকার শেষমুহূর্তের সাক্ষী প্রেমিক

ফোনের ওপার থেকে প্রেমিকার শেষমুহূর্তের সাক্ষী প্রেমিক - ছবি : আল-জাজিরা

‘হ্যালো, হ্যালো শুনতে পাচ্ছ? হ্যালো!’ শুক্রবার রাতে ফোনের মধ্যে অনেক ডাকাডাকি করেও ফোনে প্রেয়সীর গলা আর শুনতে পাননি মরক্কোর তিখত গ্রামের বাসিন্দা ওমর আইত এমবারেক। শুক্রবার গভীর রাতে যখন মরক্কোয় ভূমিকম্প হয়, তখন প্রেমিকার সাথেই ফোনে কথা বলছিলেন বছর পঁচিশের ওই যুবক । হঠাৎ কম্পন! চিৎকার, রান্নাঘরের থালা-বাটি মেঝেতে পড়ে যাওয়ার ঝনঝন শব্দ। কী হচ্ছে দেখতে গিয়ে হুড়োহুড়ির মধ্যে ফোন পড়ে যায়। ফোন তুলে ওমর প্রেমিকার খোঁজ নিতে যখন গেলেন, ততক্ষণে সব শেষ। ফোনে বার বার কথা বলতে চেয়েও সাড়া পাননি তিনি।

আফ্রিকার উত্তর-পশ্চিমের ছোট পাহাড়ি দেশ মরক্কো। শুক্রবার রাতে শক্তিশালী ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে দেশটি। স্থানীয় সময় অনুযায়ী রাত সাড়ে ১১টা নাগাদ ভূমিকম্প হয়। রিখটার স্কেলে যার মাত্রা ছিল ৬.৮। এর পর ছোট ছোট কয়েকটি আফটার শকেও কেঁপেছে মরক্কো। মারাকাশ শহর থেকে ৭২ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে ছিল ভূমিকম্পের উৎসস্থল।

মরক্কোর সেই ভয়াবহ ভূমিকম্পে মৃতের সংখ্যা দু’হাজার ছাড়িয়ে গেছে। আহতের সংখ্যাও দু’হাজারের বেশি বলে জানা যাচ্ছে। ধ্বংসস্তূপের নিচে এখনো অনেকের আটকে থাকার আশঙ্কা করছে প্রশাসন। সেই ভূমিকম্পেই আরো অনেকের মতোই স্বজনদের হারিয়েছেন ওমর। বাড়ি চাপা পড়ে মৃত্যু হয়েছে প্রেমিকা মিনা আইত বিহিরও।

গত ছয় দশকের মধ্যে মরক্কোর মাটিতে হানা দেয়া সবচেয়ে মারাত্মক ভূমিকম্পের আঘাত এতটাই বেশি ছিল যে- আটলাস পর্বতমালা থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরের তিখত গ্রাম রাতারাতি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। যে দিকেই চোখ যায়, শুধু ধ্বংসস্তূপ আর স্বজনহারাদের কান্না, চিৎকার, হাহাকার। অথচ শুক্রবারের আগে পর্যন্ত সেই গ্রামেই মানুষ-জন ঘুরে বেড়াত। রাস্তায় রাস্তায় খেলে বেড়াত শিশুরা। শুক্রবারের রাতের ভূমিকম্পের পর সেই গ্রাম গ্রামের আর একটি বাড়িও আস্ত নেই। ধ্বংসস্তূপে কেউ খুঁজে বেড়াচ্ছেন স্ত্রী-পুত্র-স্বামীকে, তো কেউ মা-বাবাকে। কেউ প্রেমিকাকে। যেমন ওমর।

ওমর সংবাদ সংস্থা এএফপিকে জানিয়েছেন, কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই তার সাথে মিনার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। সেই নিয়েই দুই পরিবারের ব্যস্ততা তুঙ্গে ছিল। আর তার মধ্যেই এই ঘটনা।

টকটকে লাল চোখে ধ্বংসস্তূপ হাতড়ে প্রেমিকা মিনার লাশ খুঁজে বের করেছেন তিনি। মিনার লাশ যখন খুঁজে পাওয়া যায়, তখনো তার হাতে ফোন ধরা ছিল। সেই লাশ এখন গ্রামেরই এক অস্থায়ী কবরস্থানে রাখা রয়েছে। পাশাপাশি কম্বল মুড়িয়ে রাখা হয়েছে আরো প্রায় ৭০টি লাশ।

সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, তিখত গ্রামের অন্তত ১০০টি পরিবারের বাস ছিল। কিন্তু সেই গ্রাম এখন ভাঙা ইট, কাঠ, পাথর, ছেঁড়া কাপড় ও ছেঁড়া জুতোর স্তূপ।

তিখতের বাসিন্দা, বছর ৩০-এর যুবক মহসিন আকসুম সংবাদমাধ্যমে বলেন, ‘আমাদের গ্রাম শেষ হয়ে গেছে। অসংখ্য মানুষের সাথে আমাদের সাজানো-গোছানো গ্রামটিরও মৃত্যু হয়েছে।’

বাড়িঘর এবং বাবাকে হারিয়ে বিধ্বস্ত ২৩ বছর বয়সী ছাত্র আবদেল রহমান এডজাল। একটি পাথরে বসে তিনি বলেন, ‘তিখতে সে ভাবে ভূমিকম্প কোনো দিন হয়েছে বলেও কারো মনে নেই। গ্রামের মানুষ বাড়ি তৈরির সময়ও এত কিছু চিন্তা করেনি। অথচ শুক্রবার রাতে বাড়িগুলো তাসের ঘরের মতো ভেঙে গেছে।’

তিনি জানিয়েছেন, রাতে যে সময় কম্পন অনুভূত হয়, অনেকেই তখন ঘুমোচ্ছিলেন। ভূমিকম্পের প্রতিঘাতে সব বাড়ি প্রায় ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়ে মৃত্যু হয়েছে বহু মানুষের। গত ৬০ বছরে মরক্কো এত বীভৎস প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হয়নি।


আরো সংবাদ



premium cement