সুদানে কেন হঠাৎ করেই লড়াই শুরু!
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ১৭ এপ্রিল ২০২৩, ২১:৪৮
সুদানের রাজধানী খার্তুমসহ দেশটির অন্যত্র বড় ধরনের যে লড়াই শুরু হয়েছে তা দেশটির সামরিক বাহিনীর নেতৃত্ব নিয়ে শুরু হওয়া দ্বন্দ্বেরই সরাসরি ফল।
রাজধানীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোতে সেনাবাহিনীর নিয়মিত সৈন্য এবং আধা-সামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সের সদস্যদের মধ্যে এই সংঘর্ষ চলছে।
উভয়পক্ষই বিভিন্ন স্থানের দখল নিয়ে সেগুলোতে অবস্থান করছে। সংঘাতের কেন্দ্রে রয়েছে শীর্ষ দুই জেনারেল এবং সবশেষ এই সংঘর্ষের জন্য তাদের নেতৃত্বাধীন দুটো বাহিনী পরস্পরকে দায়ী করছে। সংঘর্ষে ইতোমধ্যে বহু বেসামরিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন।
সেনাবাহিনী ও আরএসএফ বাহিনীর মধ্যে নতুন করে শুরু হওয়ার এই সংঘর্ষের কারণে রাজধানী খার্তুমসহ সারা দেশের মানুষের মধ্যে আবারো বড় ধরনের অনিশ্চয়তায় পতিত হওয়ার আতঙ্ক তৈরি হয়েছে।
কিন্তু হঠাৎ করে কেন এই লড়াই শুরু হলো?
পেছনের পটভূমি
সুদানে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে জেনারেলদের একটি কাউন্সিল দেশটি পরিচালনা করছে। কিন্তু পরে বিভিন্ন ইস্যুতে তাদের মধ্যে তৈরি হয় ক্ষমতার দ্বন্দ্ব।
মূলত কাউন্সিলের শীর্ষ দুই সামরিক নেতাকে ঘিরেই এই বিরোধ। এরা হলেন জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান এবং জেনারেল মোহামেদ হামদান দাগালো। জেনারেল আল-বুরহান সুদানের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান এবং সে কারণে তিনিই দেশটির প্রেসিডেন্ট।
অন্যদিকে দেশটির উপনেতা জেনারেল মোহামেদ হামদান দাগালো কুখ্যাত আধা-সামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস বা আরএসএফের কমান্ডার। তিনি হেমেডটি নামেই বেশি পরিচিত।
অল্প কিছুদিন আগেও তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব ছিল। সুদানের প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশিরকে ২০১৯ সালে ক্ষমতা থেকে সরাতে তারা দুজন একসাথে কাজ করেছেন।
২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানেও তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। কিন্তু এক পর্যায়ে আগামীতে দেশটি কিভাবে পরিচালিত হবে তা নিয়েই এই দুই নেতার মধ্যে বিরোধ তৈরি হয়। বিশেষ করে সুদানের ভবিষ্যৎ এবং দেশটির বেসামরিক শাসনে ফিরে যাওয়ার প্রস্তাবনা নিয়ে তারা ভিন্ন অবস্থান গ্রহণ করেন।
এর আগে দেশটিতে বেসামরিক সরকার পুন-প্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্ন গ্রুপ ও সেনাবাহিনীর মধ্যে আলাপ-আলোচনা চলছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওই সংলাপও ব্যর্থ হয়।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এছাড়া এই দুই জেনারেলের মধ্যে যে বিষয়টি বিরোধের একেবারে কেন্দ্রে রয়েছে তা হচ্ছে এক লাখ সদস্যের র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেসকে সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা এবং তার পরে নতুন এই বাহিনীর নেতৃত্বেকে থাকবে সে বিষয়টি।
সামরিক বাহিনীতে আরএসএফের একীভূত করার আলোচনায় মতবিরোধের জের ধরেই উত্তেজনা তৈরি হয়। এই আলোচনায় মূল প্রশ্ন ছিল: নতুন বাহিনীতে কে কার অধীনে কাজ করবেন?
শনিবারে লড়াই শুরু হলো কেন?
এর আগে বেশ কিছু সময় ধরেই উত্তেজনা চলছিল। পরিস্থিতি সামাল দিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে আরএসএফ বাহিনীর সদস্যদের মোতায়েন করা হয়। এই সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারেনি সুদানি সেনাবাহিনী। তারা এটিকে তাদের জন্য হুমকি হিসেবে মনে করে।
উত্তেজনা নিরসনে কিছু আলাপ আলোচনাও শুরু হয়েছিল। আশা করা হচ্ছিল যে সংলাপের মধ্য দিয়ে এই উত্তেজনা প্রশমিত হবে এবং বিরোধের অবসান ঘটবে।
কিন্তু আলোচনায় কোনো সমাধান আসেনি। তার জের ধরেই শনিবার সকালে লড়াই শুরু হয়। তবে কোন পক্ষ প্রথম আক্রমণ করেছে তা স্পষ্ট নয়। আরএসএফ বাহিনীর প্রধান জেনারেল দাগালো বলেছেন, তার সৈন্যরা সব সেনা ঘাঁটি দখল না করা পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাবে।
অন্যদিকে আরএসএফকে ধ্বংস না করা পর্যন্ত আপস-আলোচনার প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছে সুদানের সশস্ত্র বাহিনী। তারা এই সংঘর্ষকে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই হিসেবে বিবেচনা করছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে দেশটিতে এতদিন ধরে যে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করছিল এই সংঘাতের ফলে তার মারাত্মক অবনতি ঘটবে।
সুদানে বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা দুই পক্ষের প্রতি যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছেন।
কারা এই আরএসএফ?
এই আধা-সামরিক বাহিনীটি গঠিত হয় ২০১৩ সালে। যাদের নিয়ে দেশের ভেতরে ও বাইরে অনেক বিতর্ক রয়েছে।
এই বাহিনীর মূলে রয়েছে কুখ্যাত জানজাওয়িদ মিলিশিয়া গ্রুপ যারা দাফুরের বিদ্রোহীদের নিষ্ঠুরভাবে দমন করেছে। এই গ্রুপের নেতা ছিলেন জেনারেল দাগালো।
আন্তর্জাতিক নিন্দা ও সমালোচনা সত্ত্বেও ওমর আল-বশির এই গ্রুপটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে একটি আধা-সামরিক বাহিনী হিসেবে স্বীকৃতি দেন। যার নামকরণ করা হয় বর্ডার ইন্টেলিজেন্স ইউনিটস।
পরে এই গ্রুপটির সদস্যরা সুদানের গোয়েন্দা বিভাগের অংশ হয়ে ওঠে। আরো কয়েক বছর পর ওমর আল-বশির আরএসএফ বাহিনীটি গঠন করেন। তিনি নিজে এই বাহিনীর কার্যক্রম তদারকি করলেও এর প্রধান ছিলেন জেনারেল দাগালো।
এই দাগালো পরে প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশিরের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। আল-বশিরকে উৎখাতের পর সামরিক বাহিনীর নেতৃত্বাধীন সরকারে তিনি উপ-প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
জেনারেল দাগালো পরে আরএসএফকে একটি শক্তিশালী বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলেন। এবং এর মধ্য দিয়ে খুব দ্রুত তার ক্ষমতার উত্থান ঘটতে শুরু করে।
আরএসএফ বাহিনী ইয়েমেন ও লিবিয়ার সংঘাতেও জড়িয়ে পড়ে। শুধু তাই নয় সুদানের বেশ কয়েকটি সোনার খনিতেও তারা তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে।
এই বাহিনীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় বড় ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনেরও অভিযোগ উঠেছে। তার মধ্যে রয়েছে ২০১৯ সালে প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশিরের সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ চলাকালে ১২০ জনেরও বেশি প্রতিবাদকারীকে হত্যা করা।
দেশটির সেনাবাহিনীর বাইরে এরকম শক্তিশালী একটি বাহিনীর উপস্থিতিকেও সুদানের অস্থিতিশীলতার অন্যতম কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
অন্যদিকে জেনারেল আল-বুরহান কার্যত দেশটির নেতা। ওমর আল-বশিরকে যখন ক্ষমতা থেকে সরানো হয় তখন তিনি ছিলেন সেনাবাহিনীর ইন্সপেক্টর জেনারেল। দাফুর সংঘাতের সময় তিনি আলোচনায় আসেন এবং এই সময়েই তার ক্ষমতার উত্থান ঘটে।
সামরিক বাহিনী কেন ক্ষমতায়?
সুদানে দীর্ঘ প্রায় ৩০ বছর ধরে ক্ষমতায় ছিলেন ওমর আল-বশির। ২০১৯ সালে এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। যেভাবে তার শাসনামল শুরু হয়েছিল সেভাবেই তাকে ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছে।
উত্তর ও দক্ষিণ সুদানের মধ্যে দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে যখন গৃহযুদ্ধ চলছিল তখন ১৯৮৯ সালে আল-বশির ক্ষমতায় আসেন এবং শক্ত হাতে দেশ পরিচালনা করেন। ২০১১ সালে দেশটি বিভক্ত হয়ে দক্ষিণ সুদানের জন্ম হয়। তার আগ পর্যন্ত সুদান ছিল আফ্রিকার সবচেয়ে বড় দেশ।
রুটির মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে সারা দেশে প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশির সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হলে সেনাবাহিনীর এক অভ্যুত্থানে তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন। কিন্তু তার শাসনের অবসান দেশটিতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি।
ওমর আল-বশিরকে উৎখাতের পর দেশটি পরিচালনার জন্য একটি অন্তর্বর্তী সামরিক কাউন্সিল গঠন করা হয়। এই কাউন্সিল দুই বছরের জন্য দেশের দায়িত্বভার গ্রহণ করে।
ক্ষমতা গ্রহণের সময় তারা নির্বাচনের মাধ্যমে বেসামরিক প্রশাসনের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও বেসামরিক গ্রুপ দেশটিতে গণতান্ত্রিক শাসন ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনায় তাদেরকেও অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানাতে থাকে।
এই দাবির প্রেক্ষিতে বেসামরিক ও সামরিক। এই যৌথ নেতৃত্বে একটি সরকার গঠিত হয়। তাদের মধ্যে সম্পর্ক খুব একটা ভাল ছিল না। নানা বিষয়ে উভয়পক্ষের মধ্যে বিরোধ দেখা দিতে থাকে এবং ২০২১ সালের অক্টোবর মাসে আরো একটি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা-ভাগাভাগির সেই সরকারকেও উৎখাত করা হয়।
এর মধ্যে গত বছরের ডিসেম্বর মাসে বেসামরিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়ে এক সমঝোতায় সবকটি পক্ষ সম্মত হয়েছিল। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সেনাবাহিনী ও আরএসএফের সাথে ক্ষমতা ভাগাভাগির এক চুক্তিতে স্বাক্ষরও করেছিল। কিন্তু মতবিরোধের কারণে সেই সমঝোতা চূড়ান্ত করা সম্ভব হয়নি।
এর পর থেকেই সামরিক কাউন্সিলের দুই নেতা জেনারেল আল-বুরহান এবং জেনারেল দাগালোর মধ্যে বিরোধ তীব্র হতে থাকে।
তাদের মধ্যেকার এই দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে দেশটির সামরিক বাহিনীতে উত্তেজনা দেখা দেয় এবং তার জের ধরেই ১৫ এপ্রিল শনিবার শুরু হয় সর্বশেষ এই লড়াই।
এখন কী হতে পারে?
ধারণা করা হয় সুদানের সেনাবাহিনীর সৈন্য সংখ্যা দুই লাখেরও বেশি। অন্যদিকে আরএসফ বাহিনীর সদস্য প্রায় এক লাখ, কিন্তু তারা অনেক বেশি প্রশিক্ষিত এবং অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত।
এই লড়াই যদি বন্ধ না হয় এবং দীর্ঘ সময় ধরে অব্যাহত থাকে, তাহলে দেশটিতে রাজনৈতিক অস্থিরতা আরো মারাত্মক রূপ নিতে পারে।
পশ্চিমা এবং আঞ্চলিক নেতারা উত্তেজনা প্রশমন এবং দেশটিতে বেসামরিক শাসন ফিরিয়ে আনার জন্য উভয় পক্ষের প্রতি আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়েছেন। রাজনৈতিক দলগুলোও আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক শক্তিগুলোকে জরুরি ভিত্তিতে সংঘর্ষ বন্ধ করতে সহায়তা করার আহ্বান জানিয়েছে।
সুদানে বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক, যারা বেসামরিক প্রশাসনের কাছে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেয়ার প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছিলেন। তারা বিবদমান দুটো পক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন এই লড়াই বন্ধ করার জন্য।
বিবিসির সংবাদদাতারা বলছেন, সংঘাত বন্ধ করার লক্ষ্যে দুই জেনারেলকে আলোচনার টেবিলে বসাতে কূটনীতিকরা মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এই সংঘাত কখন ও কিভাবে শেষ হবে সেটা বলা কঠিন। কিন্তু ততক্ষণ পর্যন্ত সুদানের সাধারণ জনগণকে আরো এক দফা অনিশ্চয়তার মধ্যে বসবাস করতে হবে।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন সামরিক বাহিনীর কাছ থেকে বেসামরিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিকল্পনা নিয়ে বিরোধের জেরে সর্বশেষ এই লড়াই শুরু হলেও, সুদানের অনেকেই এখন আপাতত গণতন্ত্রের চেয়ে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার উপরেই বেশি জোর দিচ্ছেন।
তবে সামরিক বাহিনীর ভেতরে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে শুরু হওয়া লড়াইয়ের ফলে বেসামরিক সরকারের কাছে দেশটির শাসনভার হস্তান্তরের প্রক্রিয়া যে বড় ধরনের অনিশ্চয়তায় পড়ে গেল তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
সূত্র : বিবিসি
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা