ইরিত্রিয়ায় রাজধানীর কাছে রকেট হামলা

ইথিওপিয়ার টিগ্রে অঞ্চল থেকে সীমান্তের ওপারে ইরিত্রিয়ায় রকেট নিক্ষেপ করা হয়েছে বলে জানাচ্ছে স্থানীয় গণমাধ্যম ও কূটনীতিকরা।

ইরিত্রিয়ার আসমারা শহরের বাইরে একাধিক রকেট বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে, তবে সেখানে সাথে সাথে কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।

টিগ্রে'র ক্ষমতাসীন দল, যারা ইথিওপিয়ার কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে সংঘাতপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে, তারা হামলার হুমকি দিয়েছে।

ঐ দলের বাহিনী এর আগে ইথিওপিয়ার অন্য একটি অঞ্চলে রকেট নিক্ষেপ করেছে।

টিগ্রে পিপলস লিবারেশন ফ্রন্ট (টিপিএলএফ) বলেছে যে, তারা শুক্রবার আমহারা অঞ্চলের দু'টি জায়গায় হামলা চালিয়েছে এবং আরো হামলার হুমকি দিয়েছে।

টিপিএলএফ ও কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যে অস্থিরতা গত মাসে আবার বৃদ্ধি পেয়েছে।

দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে ইথিওপিয়া ও ইরিত্রিয়া রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। ২০১৮ সালে দুই দেশের মধ্যে শান্তিচুক্তি হয়।

টিগ্রেকে কেন্দ্র করে হওয়া সংঘাত সুদানেও প্রভাব ফেলেছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী ১৭ হাজারের বেশি বেসামরিক নাগরিক ইথিওপিয়ার সীমান্ত পার করে সুদানে আশ্রয় নিয়েছেন।

ইরিত্রিয়ায় কী হচ্ছে?
শনিবার রাতে আসমারার নাগরিকরা প্রবল বিস্ফোরণের শব্দ শোনার খবর জানায়।

নাম প্রকাশ না করে একজন কূটনীতিক সংবাদ সংস্থা এএফপি'কে জানায়, "আমরা যেসব খবর পাচ্ছি, তা থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে বিমানবন্দরের আশেপাশে বেশ কয়েকটি রকেটের আঘাত হয়েছে।"

ইরিত্রিয়ার আধা-সরকারি সংবাদ সংস্থা টেসফা নিউজের ওয়েবসাইট টুইট করেছে যে, টিগ্রে'র টিপিএলএফ নিয়ন্ত্রণাধীন অঞ্চল থেকে ছোঁড়া রকেট বিমানবন্দরে আঘাত না করে শহরের উপকণ্ঠে আঘাত করেছে।

টিপিএলএফ'এর একজন মুখপাত্র এর আগে ইরিত্রিয়ার বিপক্ষেও হামলা করার হুমকি দিয়েছে।

ইরিত্রিয়ার সরকার যদিও চলমান এই সংঘাতে নিজেদের জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছে, তবে বিবিসি'র আফ্রিকা অঞ্চলের সম্পাদক উইল রস বলছেন সীমান্ত অঞ্চল থেকে পাওয়া খবরে বিপরীতটিকেই সত্য মনে হয়।

কী হচ্ছে ঐ অঞ্চলে
ইরিত্রিয়ায় মিসাইল হামলার ঘটনার পর ঐ অঞ্চলের সংঘাত আরো জটিল হয়েছে এবং সমস্যার সমাধানের পথও আরো কঠিন হয়েছে। এই হামলার ফলশ্রুতিতে ঐ পুরো অঞ্চলে অস্থিরতা দেখা যেতে পারে।

তবে ঐ অঞ্চলের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পটভূমির প্রেক্ষিতে অনেকেই মনে করছিলেন যে এ ধরণের ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে, বিশেষ করে ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী আবিই আহমেদ ও ইরিত্রিয়ার স্বৈরাচারী নেতা ইসাইস আফওয়ের্কি একে অপরের মিত্র হওয়ার পর থেকে।

এখন দুই নেতারই একই শত্রু - টিপিএলএফ'এর টিগ্রেয়ান রাজনীতিবিদরা, যারা ইথিওপিয়া ও ইরিত্রিয়ার রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চলাকালীন সময় থেকে এখন পর্যন্ত ইথিওপিয়ার রাজনৈতিক অঙ্গনে রয়েছেন।

এই যুদ্ধ থামানোর জন্য আন্তর্জাতিক মহলের আহ্বান উপেক্ষিত হয়ে এসেছে এখন পর্যন্ত। যুদ্ধের কারণে হাজার হাজার বেসামরিক শরণার্থী সুদানে আশ্রয় নিয়েছেন।

সাম্প্রতিক সহিংসতা কতটা শঙ্কার?
সংঘাত শুরু হওয়ার পর থেকে শত শত মানুষ মারা গেছে। এই সপ্তাহে বেসামরিক নাগরিকদের ওপর গণহত্যা চালানো হয়েছে বলেও খবর প্রকাশিত হয়েছে।

মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে যে সোমবার মে কাদেরা শহরের 'শত শত মানুষকে ছুরিকাঘাতে বা কুপিয়ে হত্যা' করার ঘটনা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পেরেছে তারা।

সংস্থাটি বলছে, তারা 'শহরের বিভিন্ন এলাকায় লাশ পড়ে থাকার এবং স্ট্রেচারে করে নিয়ে যাওয়ার লোমহর্ষক ছবি ও ভিডিও যাচাই' করতে সক্ষম হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী আবিই আহমেদ টিগ্রে'র নেতাদের সমর্থক বাহিনীর বিরুদ্ধে এই গণহত্যা চালানোর অভিযোগ তুলেছেন। টিপিএলএফ অবশ্য হামলার সাথে কোনো ধরণের সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করেছে।

সংঘাতের কারণে টিগ্রে'তে মানুষের জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়েছে।

মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট সেবা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় যোগাযোগ কঠিন হয়ে গেছে।

এ এলাকায় খাবারের আটা ও জ্বালানির পাশাপাশি পানিরও ঘাটতি দেখা গিয়েছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে।

সরকার ও টিপিএলএফ কেন যুদ্ধ করছে?
২০১৮ সালে আবিই আহমেদ ক্ষমতা নেয়ার আগ পর্যন্ত কয়েক দশক ধরে ইথিওপিয়ার সেনা এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে টিপিএলএফ'এর কর্তৃত্ব বজায় ছিলো।

গত বছর আবিই ক্ষমতাসীন জোট ভেঙ্গে দেন এবং একাধিক নৃতাত্বিক গোষ্ঠী ভিত্তিক আঞ্চলিক দল গঠন করেন এবং তাদের নিয়ে একটি দল গঠন করেন। টিপিএলএফ ঐ দলে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানায়।

সেপ্টেম্বরে ঐ দ্বন্দ্ব আরো বৃদ্ধি পায় যখন টিগ্রে'তে একটি আঞ্চলিক নির্বাচন হয়। যদিও করোনাভাইরাস মহামারির জন্য সেসময় পুরো দেশে সব ধরণের ভোটগ্রহণ বন্ধ ছিল।

আবিই সেসময় ভোটকে অবৈধ বলে ঘোষণা করেন। টিগ্রে'র প্রশাসন আবিই'র সংস্কার কার্যক্রমকে নেতিবাচকভাবে দেখে। তারা মনে করে তিনি কেন্দ্রীয় সরকারকে বেশি ক্ষমতা দিয়ে আঞ্চলিক রাজ্যগুলোর ক্ষমতা সীমিত করতে চান।

ইরিত্রিয়ার প্রেসিডেন্ট ইসাইস আফওয়ের্কির সাথে আবিই'র 'নীতি বহির্ভূত' বন্ধুত্বরও সমালোচক তারা। ২০১৯ সালে ইরিত্রিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখার জন্য নোবেল শান্তি পুরষ্কার পাওয়া আবিই মনে করেন টিপিএলএফ তার কর্তৃত্বকে খর্ব করতে চায়।

ইরিত্রিয়া-ইথিওপিয়ার যুদ্ধ
ইথিওপিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হতে সেপ্টেম্বর ১৯৬১ সাল থেকে মে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত লড়াই করে ইরিত্রিয়ার বিচ্ছিন্নতাবাদীরা।

ইতালির উপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হওয়ার পরে ১৯৪৭ সালে ইরিত্রিয়া স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই ইথিওপিয়ার রাজা শাসন দাবি করে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের হস্তক্ষেপে ইরিত্রিয়া ইথিওপিয়ার সঙ্গে প্রথমে একটি ফেডারেশন, পরবর্তীতে সাংবিধানিক স্টেট হিসাবে থাকে। তবে ইরিত্রিয়া স্বাধীনতার আন্দোলন শুরু হওয়ার পর ১৯৬১ সালে ফেডারেশন বাতিল করে ইরিত্রিয়াকে একীভূত করে নেয় ইথিওপিয়া।

এরপর থেকেই ইরিত্রিয়ার বিভিন্ন গোষ্ঠী স্বাধীনতার আন্দোলন চালাতে থাকে। সে সময় স্নায়ু যুদ্ধের বিভিন্ন পক্ষ ইথিওপিয়া-ইরিত্রিয়াকে সহায়তা করে।

অবশেষে ১৯৯১ সালের মে মাসে ইথিওপিয়ার বাহিনীকে পরাজিত করে ইরিত্রিয়ার ইপিএলএফ মুক্তিযোদ্ধারা।

একমাস পরেও ইপিএলএফ বাহিনীর সহায়তায় ইথিওপিয়ান পিপলস রেভ্যুলশনারি ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট আদ্দিস আবাবার দখল নেয়ার করে নেয়।

১৯৯৩ সালের এপ্রিল মাসে একটি গণভোট হয়, যেখানে ইরিত্রিয়ার স্বাধীনতার পক্ষে ভোট পড়ে। সেই বছরেই ইরিত্রিয়া স্বাধীন হয়।

এরপর ১৯৯৮ সালে দুই দেশের মধ্যে আবার যুদ্ধ শুরু হয়। মাত্র দু বছর ধরে চলা সেই যুদ্ধে লাখ লাখ মানুষ প্রাণ হারায়।

২০০০ সালে দু দেশের মধ্যে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর হলেও সীমান্তে এক ধরনের যুদ্ধাবস্থা রয়েই যায়।

সূত্র : বিবিসি