আলজেরিয়ায় ‘পরাজয়ের মহানায়ক’ আব্বাস মাদানি আর নেই
- নয়া দিগন্ত ডেস্ক
- ২৭ এপ্রিল ২০১৯, ০৭:৩৮, আপডেট: ২৭ এপ্রিল ২০১৯, ০৮:১৪
আলজেরিয়ার বিরোধী নেতা যাকে বলা হয় আলজেরিয়ার মহিমান্বিত পরাজয়ের নায়ক আব্বাস মাদানি বুধবার কাতারে ইন্তেকাল করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। তার বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর। ১৯৩১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি আলজেরিয়ার দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় শহর বিস্ক্রার সিদি আকবাতে তার জন্ম। তিনি শিক্ষা ওপরে লন্ডন থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন ও আলজেরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারার হিসেবে পেশাগত জীবন শুরু করেন। ১৯৫৪ সালে ফরাসি দখলদার বাহিনীর হাতে গ্রেফতারের পর তার রাজনৈতিক কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯৬২ সালে ফ্রান্স থেকে আলজেরিয়া স্বাধীনতা লাভের পূর্ব পর্যন্ত তিনি কারাগারে বন্দী ছিলেন।
মুক্তির পর তিনি ক্ষমতাসীন ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট (এনএলএফ) দলের সাথে তার মতভেদ দেখা দেয়। আরবি ভাষার সাথে ফরাসি ভাষা ব্যবহার করান সরকারের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেন তিনি। এ কারণে তাকে আবার কারাগারে যেতে হয়। ১৯৮২ সাল পর্যন্ত তিনি কারাগারে বন্দী ছিলেন।
কারাগার থেকে মুক্তির পর সংক্ষিপ্ত ঘোষণা দিয়ে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। ১৯৮৮ সালে মাদানি ও আলি বিন হাজ যৌথভাবে ইসলামি সালভেশন ফ্রন্ট (এফআইএস) গঠন করেন এবং মসজিদগুলোতে তাদের প্রচারণা শুরু করেন। এফআইএস ছোট ছোট সশস্ত্র মিলিশিয়া বাহিনীর সাথে যুক্ত হয়, যা শাসকদের সাথে দ্বন্দ্ব তৈরি করে। ১৯৮৮ সালে আগের ব্যাপক দাঙ্গার পর ১৯৮৯ সালে দেশটির সেকুলারপন্থী সরকার এফআইএসকে বৈধতা প্রদান করে। বিশেষ করে শহুরের ক্ষুব্ধ যুবসমাজ এফআইএসকে সরকারের পশ্চিমাপন্থী সরকারের বিকল্প হিসেবে গণ্য করতে শুরু করে। ওই সরকার ফ্রান্স ও পশ্চিমাদের সাথে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিল।
আলজেরিয়ায় পশ্চিমা কর্তৃত্বের বিরোধিতা করে এফআইএস ১৯৯০ সালে স্থানীয় নির্বাচনে ব্যাপক জয়লাভ করে পশ্চিমাঘেঁষা সেকুলারপন্থী শাসনব্যবস্থাকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়। ১৯৯১ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনের প্রথম দফায় ২৩১টি আসনের মধ্যে ১৮৮টিতে জয় পায় আব্বাস মাদানির এফআইএস।
এক মাস পর দ্বিতীয় দফা নির্বাচনে এফআইএসের সুনিশ্চিত বিজয় ঠেকাতে ফ্রান্স-সমর্থিত প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেনারেল খালেদ নেজার সামরিক অভ্যুত্থান ঘটান। ইতিহাসের অধ্যাপক ফিলিপ নাইলোরের একটি বই অনুসারে আলজেরিয় রাজনীতিবিদ আলি হুসেইন কাফি, যিনি ফরাসি সেনাবাহিনীতে চাকরিকালে নেজারের ভূমিকার এবং ফ্রান্সের বিরুদ্ধে আলজেরীয় বিপ্লবে তার শেষ দিকে অংশগ্রহণের সমালোচনা করেছিলেন।
উল্লেখ্য, কাফি ১৯৯২ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রের হাই কাউন্সিলের সভাপতি ছিলেন।
নেজার-নিযুক্ত জান্তা সামরিক আইন জারি করে হাজার হাজার মানুষকে প্রশ্নবিদ্ধ বিচারের মাধ্যমে হত্যাসহ জনগণের ওপর চরম জুলুম-নির্যাতন চালান। জোরপূর্বক অন্তর্ধান ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের গুরুতর লঙ্ঘন ছিল দৈনন্দিন ঘটনা। এই অপরাধের অধিকাংশই করা হতো এফআইএসের সমর্থকদের বিরুদ্ধে। ১৩২ বছরের ফরাসি ঔপনিবেশিক শাসন ও স্বাধীনতা যুদ্ধের চেয়ে নেজারের শাসনের কোনো তফাৎ ছিল না। এ সময় দেড় লাখ আলজেরিয় নাগরিককে হত্যা করা হয় যাদের অধিকাংশ ছিল এফআইএসের সমর্থক। অভ্যুত্থানের পর এফআইএসকে নিষিদ্ধ করে সেনাবাহিনী। এরপর দেশটিতে গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে। দশ বছর ধরে চলে এই গৃহযুদ্ধ। এ সময় নিখোঁজ হয় ২০ হাজার আর দেড় লাখ মানুষকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত করা হয়।
১৯৯৭ সালে আলজেরিয়ার কর্তৃপক্ষ আব্বাস মাদানিকে মুক্তি দেয়। একই সাথে মুক্তি দেয়া হয় প্রখ্যাত এফআইএস নেতা আবদুল কাদের হাকানিকে, যাকে দুই বছর পর হত্যা করা হয়। ২০০০ সালে মাদানি ও তার উপপরিচালক আলি বিন হাজের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়। এর তিন বছর পর মাদানিকে চিকিৎসার জন্য কাতার যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়। গত বুধবার সেখানেই তিনি মারা যান।
কয়েক দশক ধরে আলজেরিয়ার রাজনীতিতে মাদানির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ও দেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যতে তার অবিশ্বাস্য বিশ্বাস বহু বছর ধরে মনে রাখা যেতে পারে। ১৯৯০ সালে একটি ভিডিওতে আলজেরিয়ার সংগ্রামকে সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরেছিলেন তিনি। বলেছিলেন, ‘আলজেরিয়াকে ফ্রান্সের জন্য অথবা আলজেরিয়াকে মুসলমানদের জন্য বেছে নিতে হবে। যত তাড়াতাড়ি মানুষ জেগে উঠবে ও ইসলামকে বেছে নেবে ততই উত্তম। অবশ্য এটি এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।’
ফ্রান্স আলজেরিয়ায় দ্বৈত নীতি চালাচ্ছে উল্লেখ করে মাদানি ভিডিওতে তার কথা শেষ করেন। তিনি বলেন, ‘ফ্রান্স গণতন্ত্রের মিছিল বন্ধ করেছিল। কারণ প্যারিস মনে করে, গণতন্ত্র প্রয়োজন ফ্রান্সের জন্য, আলজেরিয়দের জন্য নয়। তাই আমরা এখনো ঔপনিবেশের মধ্যেই আছি।’
সূত্র : মিডলইস্ট মনিটর