জটিল স্বাস্থ্য সমস্যা : নিজেদের রক্ষায় নিজেরাই যখন হাতিয়ার
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ১৫ এপ্রিল ২০১৯, ১১:১৪, আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০১৯, ১১:৩৭
প্রসবজনিত ফিস্টুলা একটি জটিল সমস্যা হলেও প্রায় অনেকেই তা গোপন রাখেন। বিশ্বজুড়ে ২০ লাখের বেশি মাকে এই সমস্যায় আক্রান্ত করছে।
কিন্তু আফ্রিকার দেশ মাদাগাস্কারের একদল নারী এই সমস্যা মোকাবেলায় তৈরি করেছেন নতুন এক নজির।
একদল নারী যারা নিজেরাই ফিস্টুলায় আক্রান্ত, তারা নিজের ও নিজেদের জীবনের কষ্টকর অভিজ্ঞতা আর দুর্ভোগের গল্প ছড়িয়ে দিচ্ছেন অন্য আরো অনেক নারীদের মাঝে, যাদের চিকিৎসা প্রয়োজন।
তাদেরকে মনে করা হচ্ছে ‘পেশেন্ট অ্যাম্বাসেডর’। গতবছর এই প্রকল্পটি চালু হওয়ার পর থেকে অনেকেরই জীবনরক্ষাকারী অস্ত্রোপচার সম্পন্ন হয়েছে।
ফেলিসিয়ার গল্প
১৪ বছর আগের কথা। ফেলিসিয়া ভোনিয়ারিসোয়া মিয়াডানাহারিভেলোর প্রথম সন্তান প্রসবের সময় প্রচণ্ড জটিলতার সৃষ্টি হয়।
‘আমি একদিন বাড়িতে চেষ্টার পর কাছাকাছি হাসপাতালে গিয়েছিলাম। আমি তিন দিন ব্যথা সহ্য করেছি এবং তখনো প্রসব হয়নি।’
তার সন্তান প্রসবের আগেই মারা যায়। এবং ফেলিসিয়ার প্রসবজনিত ফিস্টুলার সমস্যা শুরু হয়।
বিলম্বিত ও বাধাগ্রস্ত প্রসব এবং যথাযথ চিকিৎসা সুবিধা না থাকার কারণে প্রসবজনিত ফিস্টুলার সমস্যার শুরু হয়।
যোনিপথ, মূত্রাশয় ও মলদ্বারের মাঝখানে কোনো অস্বাভাবিক ছিদ্র তৈরি হলে একে প্রসবজনিত ফিস্টুলা বলে।
এর ফলে কোনোরকম নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই প্রস্রাব-পায়খানা বের হয়ে যায়। বিব্রতকর গন্ধ এবং সার্বক্ষণিক ভেজা-ভাব স্বাভাবিক জীবনযাপনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
এর ফলে আরো অনেক ফিস্টুলা সমস্যায় আক্রান্ত নারীর ভাগ্যে যা ঘটে থাকে, তাই ঘটেছিল ফেলিসিয়ার ভাগ্যেও। তার জীবনসঙ্গী তাকে ত্যাগ করে এবং এই নারীকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে বাধ্য করা হয়।
এমনকি তার পরিবারের অনেক লোকজনও তাকে মেনে নিতে চায় না। ‘লোকজন এমন আচরণ করতে লাগলো যেন আমি কোনো মানুষই নই, এবং এই বিষয়টি আমাকে খুবই কষ্ট দিয়েছিল’, বলেন ফেলিসিয়া।
জাতিসঙ্ঘের পরিসংখ্যান অনুসারে মাদাগাস্কারে প্রতিবছর প্রায় ২০০০ নারী সন্তান জন্মদানের সময় প্রসবজনিত ফিস্টুলার শিকার হয়। কারণ তারা সময়মতো সিজারিয়ান সি-সেকশন বা অস্ত্রোপচার কিংবা চিকিৎসা সহায়তা পান না।
আর একবার তাদের ফিস্টুলা দেখা দিলে খুব সামান্য শতাংশ নারী তা সমাধানের জন্য সার্জারির সুযোগ পায়।
একদশকের বেশি সময় তাই ফিস্টুলা নিয়ে কাটাতে হয় ফেলিসিয়াকে। এরপর তার সুযোগ মেলে তামাতাভে শহরে ফ্রিডম ফ্রম ফিস্টুলার বিনা বেতনে পরিচালিত ক্লিনিকে চিকিৎসা নেয়ার।
সেখানেই তার চিন্তা আসে কিভাবে সে অন্যদের সহায়তা করতে পারে।
‘আমি যখন সুস্থ হলাম তখন আমি সিদ্ধান্ত নিলাম রোগীদের শুভেচ্ছা দূত হিসেবে কাজ করবো। কারণ আমি জানতাম যে, আমার এলাকায় বহু নারী আছে যারা আমার মতো একই রোগে ভুগছে এবং সমাজ থেকে তাদের বিতাড়িত করা হয়েছে।’
চিকিৎসা শেষে নিজের গ্রামে ফিরে গেলেন ফেলিসিয়া এবং তার জীবন একটি সার্জারির পর কীভাবে বদলে গেছে সে-কথাই অন্য নারীদের কাছে তুলে ধরার সিদ্ধান্ত নিলেন।
যেভাবে শুরু করলেন সেবা দেয়া
ফেলিসিয়া ছোট্ট একটি দোকানে কফি এবং কেক বিক্রি করেন। যে রাস্তা ধরে বহু লোক এক গ্রাম থকে আরেক গ্রামে যাতায়াত করে। দোকানে আসা লোকজনের সাথে ফিস্টুলা নিয়ে কথাবার্তা বলেন তিনি।
লোকজনের কাছে নিজের ফোন-নম্বর দিয়ে সে অনুরোধ করে নতুন কোনো ফিস্টুলা রোগীর কথা জানতে পারলে তাকে খবর দিতে।
মানুষের দরজায় দরজায় ঘুরে ঘুরেও ফিস্টুলার কথা জানান তিনি। অনেকেই যে সমস্ত বিষয় নিয়ে খোলাখুলি কোনো প্রশ্ন তুলে ধরতে সংকোচ বোধ করে, সেসব প্রশ্ন তুলে ধরে; উত্তর দেন তিনি নিজেই।
ফিস্টুলা রোগীদের নিয়ে এখনো সামাজিক অনেক কুসংস্কার প্রচলিত আছে। অনেক মানুষই ফিস্টুলা শব্দের সাথেও পরিচিত নয়।
তারা হয়তো বিষয়টি সম্পর্কে বলে থাকে যে, ‘নারীর গায়ে দুর্গন্ধ’ কিংবা ‘শিশুর জন্মদানের পর ফুটো’।
‘তাদের সাথে একত্রে বসবাস করা কঠিন। কারণ তাদের গা থেকে সবসময় প্রস্রাবের গন্ধ। তাদের অনেককে সমাজ থেকে বিতাড়িত করা হয় এবং তাদের ওপর লোকজন ক্ষুব্ধ থাকে’- বলছিলেন একজন নারী।
তবে ফেলিসিয়া এখন সবার কাছে খুব ভালোভাবে পরিচিত। গণ্যমান্য ব্যক্তিরা তার সাথে সরাসরি যোগাযোগ রাখে ও তাকে তারা বিশ্বাস করে। তবে কাজটি মোটেই সহজসাধ্য নয়। লোকজনকে চিকিৎসা সেবা নেবার ব্যাপারে উৎসাহিত করতে তাকে কখনো কখনো একাধিকবারও তাদের কাছে যেতে হয়।
‘লোকজন যেতে চায় না, তার মূল কারণ হচ্ছে তারা ভয় পায়। অস্ত্রোপচার নিয়ে তাদের ভীতি রয়েছে। অঙ্গ চুরি হয়ে যেতে পারে এমন গুজব প্রচলিত আছে। রোগীদের পরিবারগুলো মনে করে হাসপাতালে তারা মারা যাবে তাই সেখানে পাঠাতে চায় না তারা।’
এইসব এলাকায় যাতায়াতের একমাত্র উপায় হাঁটাপথ। কলাগাছ ও কফিগাছ দ্বারা ঘেরা খাড়া পাহাড় বেয়ে যেতে হল। কোনো রাস্তা না থাকায় জঙ্গলের ভেতর পথ বেছে নিতে হয়।
মারিয়ান্নের বয়স ২১ বছর। কিন্তু তাকে দেখতে মনে হয় আরো অনেক ছোট। প্রসবের সময় তার নবজাতক সন্তানটি দুই সপ্তাহ আগে মারা গেছে সময়মত সে হাসপাতালে যেতে পারেনি বলে। ফিস্টুলার শিকার হওয়ায় তার স্বামী তাকে ত্যাগ করেছে এবং বাবা ও সৎ মায়ের কাছে ফিরে আসতে সে বাধ্য হয়েছে।
‘আমি খুব লজ্জা ও বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে ছিলাম এবং সবসময় লুকিয়ে থাকতাম। শরীর থেকে বাজে গন্ধ বের হওয়ার কারণে গ্রামে বের হওয়ার মতো বা কোনো মানুষের কাছে যাওয়ার সাহস ছিল না।’
প্রতিদিন মারিয়ান্নেকে কাপড়চোপড় ধুতে হতো প্রস্রাবের গন্ধের কারণে। সে বলে, ‘বাচ্চাকে হারানোর কারণে আমার খুব খারাপ লাগে। আমার জীবনটাই পুরো পাল্টে গেছে এ কারণে।’
মারিয়ান্নেকে শহরে নিয়ে চিকিৎসা সেবা দেয়ার ব্যাপারে তার পরিবারের লোকজনের সাথে কথা বলেছে ফেলিসিয়া। নিজের জীবনের কথাও তাদের সামনে তুলে ধরেছে সে। তাদের নানা প্রশ্নের জবাব এবং মারিয়ান্নেকে যথাসময়ে তাদের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতিও দিতে হয় তাকে। এরপর মারিয়ান্নে নিজেও আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছে।
সে বলে, ‘ফেলিসিয়া নিজে হাসপাতালে গিয়েছিল এবং অস্ত্রোপচার করেছিল। আমার মনে হয় এটা সে না হয়ে অন্য কেউ হলে আমি হয়তো তাকে বিশ্বাস করতাম না। কারণ আমরা অনেক ধরনের গুজব শুনেছি এবং এর আগে কখনো এই এলাকা ছাড়িনি।’
‘এখন আমি জানি যে, প্রকৃতপক্ষে চিকিৎসা পেতে পারলে সুস্থ হয়ে উঠতে পারবো। আমি আমার আগের জীবন ফিরে পেতে চাই।’
দাতব্য সংস্থা ফ্রিডম ফ্রম ফিস্টুলা এইসব নারীদের ভ্রমণের খরচ বহন করছে। যদিও ফেলিসিয়া যে সময় দিচ্ছে সেজন্য তারা তাকে অর্থ দিচ্ছে না।
কিন্তু গতবছর নিজের সার্জারির পর থেকে সে অন্য মহিলাদের সহায়তা করার জন্য শক্তভাবে পাশে দাঁড়ায় ফেলিসিয়া। এই যাত্রায় বেশ কয়েকদিন লাগে এবং বেশিরভাগই পায়ে হেটে এবং গণপরিবহনে আসা-যাওয়া করতে হয়।
দ্য ফ্রিডম ফ্রম ফিস্টুলা ক্লিনিকে ৬টি ওয়ার্ড এবং ৪২টি শয্যা রয়েছে। সেখানে সার্জারির জন্য আসা একজন রোগী যাফেলিয়েনে, যার বয়স ৩৮। সে প্রত্যন্ত এলাকা থেকে এসেছে কিন্তু সে ভীত নয় বলে জানায়।
প্রসবকালীন ফিস্টুলা বিশেষজ্ঞ মিশেল ব্রিন তার অস্ত্রোপচার করবেন।
এই অস্ত্রোপচারের জন্য প্রথমে ব্লাডার এবং পরে যোনিপথের সার্জারি করা হবে। অস্ত্রোপচারের জন্য ৩০ থেকে ৪০ মিনিট সময় লাগে।
‘এটা তাদেরকে সম্পূর্ণ নতুন এক জীবন এনে দেবে। অন্যতম প্রধান সমস্যা তাদের রাতের বেলা অনবরত প্রস্রাব বেরোনো । তো অস্ত্রোপচারের পর প্রথম যে জিনিসটি তারা উপলব্ধি করবে তা হলো, শেষপর্যন্ত তারা রাতের নির্বিঘ্ন ঘুম পেতে যাচ্ছে’, বলছিলেন চিকিৎসক মি ব্রিন।
এই দাতব্য সংস্থার পরিচালক এলো ওটোবো বলেন, ‘নিজ সম্প্রদায়ের মানুষদের কাছে ফেরত যাওয়ার আগে তাদের শারিরীক সুস্থতার পাশাপাশি এইসব নারীদের জন্য প্রচুর মানসিক যত্ন প্রয়োজন। সে কারণে তাদের কাউন্সিলর দিয়ে কাউন্সিলিংয়ের ব্যবস্থা রয়েছে।’
পরিচালক ওটেবো বেলন, ‘এসব নারীরা শুধুমাত্র শুভেচ্ছা দূত হিসেবে নয়, তারা যেন প্রকৃত অর্থে নিজ কমিউনিটির মধ্যে নেতৃস্থানীয় হয়ে উঠতে পারে সেজন্য তাদের ক্ষমতায়নের কাজ করা হচ্ছে।’
এখানে যে শুধু সুস্থ করার কাজটিতেই গুরুত্ব দেয়া হয় তেমনটি নয়। বরং সুস্থতার পর একেকজন রোগী কি অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে দিন পার করেছে সে গল্প শেয়ার করার এবং তা নিয়ে কোন ধরনের সংকোচের বদলে গর্ব করার প্রেরণাও দেয়া হয় এই সংস্থাটি থেকে।
যেমনটা বলছেন ডিরেক্টর ওটোবো- ‘অনেক ফিস্টুলা রোগী ১৫, ২০ বছর ধরে এই দুর্ভোগ সহ্য করে আসছে এবং এখন তারা আমাদের ক্লিনিকে আসে আমরা তাদের সমাজে ফিরে গিয়ে নিজেদের গল্পগুলো তুলে ধরতে, এবং গর্বের সাথে কথা বলা শেখাই। এবং সামগ্রিক আরোগ্যলাভের প্রক্রিয়ায় এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে আমি মনে করি।’
এখানেই শেষ নয়। পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয় সর্বশেষ ধাপে একটি বিদায়ী পার্টির মধ্য দিয়ে। নিজেদের অভিজ্ঞার গল্প বলার অনুশীলনের সুযোগ এটি। নতুন পোশাক এবং উজ্জ্বল গোলাপি রঙের লিপস্টিকে সজ্জিত এই নারীরা সেদিন আত্মবিশ্বাসী এবং উচ্ছ্বসিত। চলে প্রত্যেকের নিজেদের গল্প বলা এবং বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেয়া। এমনকি তাদের দেয়া হয় সার্টিফিকেটও।
অনেক দেশ সি-সেকশন সার্জারি, মাতৃস্বাস্থ্য সেবা এবং প্রশিক্ষিত মিডওয়াইফদের মাধ্যমে ফিস্টুলা সার্বিকভাবে নির্মূল করতে সক্ষম হয়েছে।
কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত সব জায়গায় সেই পর্যায়ের সেবা না পৌঁছাচ্ছে মাদাগাস্কারের এসব নারীরা অন্তত নিজেরাই একে অপরের পাশে দাঁড়িয়ে সহায়তার হাত বাড়াচ্ছে। তাদের উদ্দেশ্য মানুষকে বোঝানো যে ফিস্টুলা রোগীরাও মানুষ এবং তাদের সমাজ থেকে প্রত্যাখ্যান করা উচিত নয়।
সূত্র : বিবিসি