বিপ্লবের ৮ বছর : যেমন চলছে মিসর
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ২৫ জানুয়ারি ২০১৯, ১৭:৫৭
প্রতিদিন সূর্যাস্তের সাথে সাথে আহমেদ মাহেরকে পরিবারের কাছ থেকে বিদায় নিতে হয়। ঘর থেকে বের হয়ে তাকে চলে যেতে হয় কায়রোর একটি পুলিশ স্টেশনে। সেখানেই রাত কাটাতে হয় মিসরের সুপরিচিত এই নাগরিক অধিকার কর্মীকে। সকালে আবার ফিরতে পারেন বাসায়।
দুই বছর ধরে চলছে তার এই জীবন। মাহের যেটিকে বলেন ‘অর্ধেক কারাবাস’। পারিবারিক জীবন, ক্যারিয়ার, শিক্ষা সব কিছুই বাধাগ্রস্থ হচ্ছে তার। তবুও ২০১১ সালের মোবারক বিরোধী আন্দোলনের অন্য কর্মীদের তুলনায় তিনি নিজেকে কিছুটা ভাগ্যবান ভাবতে পারেন।
ওই বিপ্লবের মাধ্যমেই পতন হয়েছিল স্বৈরশাসক হুসনি মোবারকের ৩০ বছরের শাসনের; কিন্তু সেই বিপ্লবের সুফল মিসরবাসী ভোগ করতে পারেনি বেশিদিন। এক বছরে মাথায় মোহাম্মদ মুরসির গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করে সেনাপ্রধান আবদুল ফাতাহ সিসি। তারপরই শুরু হয় বিপ্লবীদের ওপর দমন-পীড়ন।
মোবারক বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম উদ্যোক্তা এই ৩৮ বছর বয়সী প্রকৌশলী চেয়েছিলেন স্বৈরশাসন বিদায় নিয়ে দেশে আসুক মুক্তির বাতাস। যদিও মোবারকের পতনের পর মাঝখানের এক বছর বাদ দিলে মিসেরর পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হয়ে উঠেছে যা কেউ ধারণাও করেনি। মাহের রয়টার্সকে বলেন, ‘পরিস্থিতি এতটা ভয়াবহ হবে তা কেউ ভাবতেও পারিনি। এখন এমনকি কয়েকজন একত্রিত হয়ে কোন কাজ করা কিংবা মুক্তভাবে মতামত ব্যক্ত করার নিষিদ্ধ’।
অভ্যুত্থানের পর থেকেই সিসি সরকার শুরু করে দমন-পীড়ন। প্রথম দিকে মুসলিম ব্রাদারহুড কর্মী-সমর্থকদের দিয়ে শুরু হলেও ক্রমশ তা বাড়তে থাকে। এমনকি সেক্যুলার এক্টিভিস্টরাও তার হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। অনেকে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন, বড় একটি অংশ জেলে ঘানি টানছে, আর যারা বাইরে আছেন তারা ভয়ে চুপ করে থাকছেন সব সময়।
২০১৭ সালের শুরুতে তিন বছর কারাবাসের পর জেল থেকে ছাড়া পান মাহের। তার বিরুদ্ধে আইনভেঙে বিক্ষোভ করার অভিযোগ আনা হয়। নির্দেশ দেয়া হয় পরবর্তী তিন বছর দিনে বাড়িতে থাকলেও রাত কাটাতে হবে পুলিশ স্টেশনে গিয়ে।
সিসি যুগে মিসর কেমন চলছে তার একটি খণ্ডচিত্র এটি। ক্ষুদ্র একটি সমর্থক গোষ্ঠি রয়েছে সিসির- এখন তারাও বলছেন অর্থনৈতিক অবস্থা মেরামত করতে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া দরকার। ইসলামপন্থীদের কারাগার থেকে মুক্তি দিতেও বলছেন তারা।
২০১৪ সালে সিসি ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই মিসরের অর্থনীতি উল্টো পথে চলতে থাকে। ২০১৬ সালে আইএমএফের একটি লোনের সহায়তায় সংস্কার কার্যক্রম গ্রহণ করা হলেও মিসরীয় মুদ্রার অবনমন ও জ্বালানি খাতে ভর্তুকি বাতিল করায় দারিদ্রতা আরো বাড়ছে।
আধুনিক ইতিহাসের নিকৃষ্টতম নির্যাতন
মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, সিসি যুগে মিসরের ইতিহাসের সবচেয়ে বর্বর নির্যাতন চলছে। ইসলামপন্থী ছাড়াও মধ্যপন্থী এমনকি বামপন্থী শতশত কর্মী কারাবাস করছেন ২০১৩ সালের পর থেকে। বুদ্ধিজীবী, সরকারের সমালোচক, মানবাধিকার কর্মীসহ সবার বিরুদ্ধে ‘সন্ত্রাসী সংগঠনের সাথে জড়িত’ কিংবা গুজব ছড়ানোর কাল্পনিক অভিযোগ এনে জেলে ঢোকানো হচ্ছে।
পুরস্কার জয়ী সাংবাদিক ওয়ায়েল আব্বাস তাদের একজন। এছাড়া খ্যাতিমান ব্লগার আলা আবদুল ফাতাহ, আছেন সিসির সমর্থক থেকে সমালোচকে পরিণত হওয়া হাজেম আবদুল আজিম- এরা সবাই ৫ বছরের কারাদণ্ড নিয়ে জেলে আছেন বর্তমানে। ২০১১ সালে মুবারকবিরোধী আন্দোলনকারী আহমেদ দৌমাকে ১৫ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে এ মাসের শুরুতে।
নেদারল্যান্ডভিত্তিক পর্যবেক্ষক সংস্থা ইউরোমেড এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘যতবারই কেউ না কেউ নির্যাতন, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কিংবা গ্রেফতারের শিকার হয়- মিসরের কর্তৃপক্ষ এর মাধ্যমে জানিয়ে দেয় তারা যে পরিবর্তন চায় তা হবে না।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে জাতিসঙ্ঘের ১৭ মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ মিসরের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অসাধু ব্যবহার ও ভিন্নমতের কর্মীদের গ্রেফতার, নির্যাতন ও হত্যার অভিযোগ এনেছে।