২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

সেনাবাহিনীর হাতে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা নিয়ে যে সব প্রশ্ন সামনে আসছে

সেনাবাহিনীর হাতে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা নিয়ে যে সব প্রশ্ন সামনে আসছে - ছবি : সংগৃহীত

ম্যাজেস্ট্রেসি ক্ষমতা নিয়ে বুধবার সকাল থেকে সারাদেশে কাজ শুরু করেছে সেনাবাহিনীর সদস্যরা। এর ফলে এখন থেকে সেনাবাহিনীর কমিশন্ড কর্মকর্তারা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতাপ্রাপ্ত হলেন। এখন থেকে কোনো অপরাধীকে গ্রেফতার কিংবা গ্রেফতারের নির্দেশ দিতে পারবেন তারা।

গত দু’দশকে বাংলাদেশের সব জাতীয় নির্বাচনসহ বিভিন্ন প্রয়োজনে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হলেও তাদের হাতে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা ছিল না। তারা বিভিন্ন কাজে মাঠ প্রশাসনকে সহায়তা করেছে।

গত ৮ আগস্ট অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতা নেয়ার পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে এলেও পোশাকখাতসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় অসন্তোষ রয়ে গেছে।

এমন পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীকে বিচারিক ক্ষমতা নয়, শুধুমাত্র নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে।

প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী আলী ইমাম মজুমদার বলেন, ‘বিরাজমান পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে শুধুমাত্র ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। তাদের হাতে এই ক্ষমতা থাকলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে সুবিধা হয়।’

যে কারণে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়া হয়েছে
কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে ঢাকাসহ সারাদেশে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়লে গত ১৯ জুলাই রাতে সারাদেশে কারফিউ জারি ও সেনা মোতায়েন করেছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার।

গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে তিন দিনের মাথায় ৮ তারিখ ক্ষমতা নেয় নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।

সরকার যখন দায়িত্ব নেয় তখন সারাদেশে পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় ছিল পুলিশ। ওই সময় ছাত্রদের সাথে নিয়ে মাঠের পরিস্থিতি সামাল দিয়েছিল সেনাবাহিনী।

সরকার পতনের পর থেকে এখন পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে ও খাতে বিশৃঙ্খলা চলছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হিসেবে পুলিশও ঠিকভাবে কাজ করতে পারছে না।

বিভিন্ন খাতের কর্মীরা বিক্ষোভ প্রদর্শন করছে। অনেক ক্ষেত্রে কর্মীরা জোর করে তাদের দাবি-দাওয়া আদায়ের উদ্যোগ নিচ্ছে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে জোর করে শিক্ষকদের পদত্যাগের ঘটনা ঘটছে।

অনেক জায়গায় বিক্ষুব্ধ জনগণ আটক আসামিদের ওপর হামলা করছে। শ্রমিকরা বিক্ষোভ করে কলকারখানা ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছে। মাজার, মন্দির ভাঙচুরসহ ধর্মীয় স্থাপনায় হামলার ঘটনাও ঘটছে।

এমন পরিস্থিতিতে এক মাসেরও বেশি সময় ধরে সরকার চেষ্টা করে পরিস্থিতি অনুকূলে আনতে পারেনি।

পরে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন দিয়ে জানায় সারাদেশে আগামী দু’মাস নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব পালন করবেন সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা।

বুধবার সকালে গাজীপুরে এক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো: জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, ‘সেনাবাহিনী অনেক দিন ধরেই মাঠে আছে। তাদের একটা ক্ষমতার মধ্যে কাজ করতে হবে। পাশাপাশি আমাদের অন্যান্য বাহিনীতে স্বল্পতা রয়ে গেছে। এটা পূরণ করার জন্য সেনাবাহিনী আমরা এনেছি।’

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কেন এই সিদ্ধান্ত নিলো সেটি নিয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছেন সরকারের আরেক উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম।

সকালে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘দ্রুত সময়ের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পূর্ণ যেন ঠিক থাকে, জননিরাপত্তা যেন নিশ্চিত হয় সে কারণে একটা জরুরি পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীকে এই ক্ষমতা দেয়া হয়েছে শুধুমাত্র দু’মাসের জন্য।’

ম্যাজস্ট্রেসি ক্ষমতা পুরানো দাবি
বাংলাদেশে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সেনাবাহিনী দায়িত্ব পালন করেছে। বিভিন্ন কাজে মাঠ প্রশাসনকে সহায়তাও করেছে তারা।

২০০১ সালে লতিফুর রহমানের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয় অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। তখন নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়ার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে দাবি করেছিল বিএনপি।

যদিও এই দাবির বিপক্ষে জোরাল অবস্থান ছিল আওয়ামী লীগের।

পরে আওয়ামী লীগের দাবির মুখে সেনাবাহিনীকে নির্বাচনের মাঠে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়ার অবস্থান থেকে সরে আসে তত্ত্বাবধায়ক সরকার।

তবে ওই সময় নির্বাচন পরিচালনা আইন বা আরপিওতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংজ্ঞায় সেনাবাহিনীকে যুক্ত করা হয়।

তখন পুলিশ বা অন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মতোই নির্বাচনের মাঠে দায়িত্ব পালন করে সেনাবাহিনী। তখনো তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা ছিল না।

২০০১ সালের অষ্টম ও ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত হওয়া নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সেনাবাহিনী মাঠে ছিল অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মতোই।

নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন, ওই দুই নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অংশ হিসেবে সেনাবাহিনী নির্বাচনি অপরাধের ক্ষেত্রে একজন পুলিশ কর্মকর্তার মতোই কাউকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করতে পারতো। সেটি ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা ছিল না।

নির্বাচন বিশ্লেষক অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালে আওয়ামী লীগ সরকার আরপিওতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংজ্ঞা থেকে সশস্ত্র বাহিনীকে বাদ দেয়ার পর নির্বাচনে সেনাবাহিনীর সেই ক্ষমতা অনেকটাই কমে যায়।’

পরে গত ১৪ বছরে নির্বাচনের সময় সেনাবাহিনী দায়িত্ব পালন করেছে তবে আরপিও থেকে বাদ দেয়ার কারণে সেনাবাহিনী মোতায়েন হলেও তারা নির্বাচনে তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি।

সেনাবাহিনীর এই ক্ষমতায় কোনো ঝুঁকি আছে?
২০০২ সালে অপারেশন ক্লিনহার্টের সময় সেনাবাহিনী ৮৪ দিন অভিযান পরিচালনা করে। অভিযান শেষে যেদিন থেকে সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার শুরু হয়, তাদের আগের দিন ‘যৌথ অভিযান দায়মুক্তি অধ্যাদেশ ২০০৩’ জারি করা হয়।

তৎকালীন বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরের মাধ্যমে জানা যায়, অপারেশন ক্লিনহার্ট চলাকালে ১২ হাজার ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছিল।

সে সময় ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতাসহ সেনাবাহিনী ওই অভিযান পরিচালনা করেছিল।

অপারেশন ক্লিনহার্ট চলাকালে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি দাবি করে বিএনপি সরকার। কিন্তু তারপরও এই অভিযান বন্ধ করার জন্য চাপ প্রবল হয়ে উঠে।

অধ্যাপক ইউনূসের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতাসহ সেনাবাহিনীকে মাঠে নামানোয় তেমন কোনো সঙ্কট তৈরি হবে কিনা সেটি নিয়েও সংশয় দেখা যাচ্ছে।

নির্বাচন বিশ্লেষক অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘বড় কোনো ঝুঁকি না থাকলেও সরকারের এই সিদ্ধান্তকে সিভিল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ভালোভাবে নেবে না। কারণ জনপ্রশাসনের কর্মকর্তারা এটি নিয়ে পরে ইস্যুও তৈরি করতেও পারে।’

শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বিভিন্ন ইস্যুতে বিএনপি, জামায়াত কিংবা জাতীয় পার্টির মতপার্থক্য তৈরি হলেও সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিষয় তারা প্রায় একই রকম মত দিয়েছে।

কী বলছে রাজনৈতিক দলগুলো?
গত দেড় দশকের বেশি সময় ধরে রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিল আওয়ামী লীগ।

তবে ৫ আগস্ট পট পরিবর্তনের পর নতুন সরকার এলেও এখনো মাঠের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়ায় সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা রয়েছে।

কখনো কখনো বিএনপি নেতাকর্মীরা নিজেদের মধ্যে দখলদারিত্ব নিয়ে অন্তর্কোন্দলে জড়াচ্ছে বলেও বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হচ্ছে।

এসব ঘটনায় কিছুটা অস্বস্তিও রয়েছে বিএনপির মধ্যে। যে কারণে এই অভিযানকে প্রাথমিকভাবে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে দলটি।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘কোনো কোনো জায়গায় তাৎক্ষণিক বিশৃঙ্খলা দূর করার জন্য দু’মাসের জন্য এই ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। তাদের বিচারিক ক্ষমতা নেই। তারা শুধু গ্রেফতার করতে পারবে। এটিকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছি।’

তবে বিএনপি মনে করছে, সেনাবাহিনীর এই ক্ষমতা নিয়ে মূল্যায়ন করা যাবে তারা পুরোদমে কাজ শুরুর পর।

নৈরাজ্য দমাতে সরকারের কাছে এমন সিদ্ধান্তের কোনো বিকল্প ছিল না বলে মনে করছে জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী।

জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করতে চাই শান্তি ও কল্যাণে, নৈরাজ্য থেকে রক্ষা করে দেশের স্থিতিশীল পরিবেশের প্রয়োজনে এই ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার দেয়া হয়েছে।’

তবে এই ক্ষমতার অপপ্রয়োগ যেন না হয় সেই কথাও বলছে এই দলটি।

জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নাজুক অবস্থায়। সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার দেয়া এই মুহূর্তের জন্য যৌক্তিক।

সেনাবাহিনীর এই ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার শুধুমাত্র দেশে শৃঙ্খলা ফেরাতেই যেন কাজে লাগে- সরকারকে সেদিকে নজর রাখার কথাও বলছে রাজনৈতিক দল ও বিশ্লেষকরা।
সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement