দুর্নীতিতে অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের স্ত্রী-সন্তানদের শাস্তির বিধান কী
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ২৬ জুন ২০২৪, ০১:০৮
বাংলাদেশে সম্প্রতি বেশ কয়েকজন সাবেক ও বর্তমান সরকারি কর্মকর্তার কথিত দুর্নীতির খবর নিয়ে তোলপাড় চলছে। এসব কর্মকর্তাদের নিজের ও পরিবারের সদস্যদের নামে নগদ অর্থ, জমি, বাড়ি, ফ্ল্যাট-সহ জ্ঞাত আয়বহির্ভূত অস্বাভাবিক সম্পদের মালিকানা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও চলছে তুমুল আলোচনা।
এসব কর্মকর্তার অবৈধ উপায়ে অর্জিত বেশির ভাগ সম্পদই তারা নিজ নামে ছাড়াও করেছেন স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে বা পরিবারের অন্য সদস্যদের নামে।
সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে গণমাধ্যমে এসব সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রেও বিভিন্ন ধরনের বক্তব্য দেয়া হচ্ছে।
সরকারি চাকরিজীবীদের অবৈধ উপায়ে অর্জিত সম্পদ বা অর্থ নিজের নামে থাকলে তা প্রমাণিত হলে দুর্নীতি দমন কমিশন আইনেই শাস্তির ব্যবস্থা আছে।
কিন্তু তাদের স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে, ভাই-বোন বা পরিবারের অন্য সদস্যদের নামে অবৈধ সম্পদ রাখার অপরাধ প্রমাণিত হলে আইনে তাদের জন্য কী শাস্তির বিধান রয়েছে?
আলোচনায় পুলিশের সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ
বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ তিনটি পদে এক দশকেরও বেশি সময় সময় ধরে দায়িত্ব পালন করেছেন বেনজীর আহমেদ। বারবারই দায়িত্ব পালনের সময় আলোচনায় ছিলেন তিনি।
সম্প্রতি নতুন করে দুর্নীতির অভিযোগে বিতর্কের মুখে পড়েছেন পুলিশের সাবেক এই আইজিপি।
সম্প্রতি বাংলাদেশের একটি সংবাদপত্রে বেনজীর আহমেদের বিপুল সম্পত্তির সংবাদ প্রকাশিত হয়।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অনুসন্ধানে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও সংসদ সদস্য সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন দুদকে আবেদন করেন। পরে অনুসন্ধান শুরু করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। বিপুল সম্পদ থাকার প্রাথমিক প্রমাণ পেয়ে দুদক আদালতে এসব সম্পদ জব্দের আবেদন করে।
আইনজীবীদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী এখন পর্যন্ত আদালত বেনজীর আহমেদ এবং তার স্ত্রী ও তিন মেয়ের নামে যেসব সম্পদ জব্দ বা ‘ফ্রিজ’ করার নির্দেশ দিয়েছেন তার মধ্যে আছে ঢাকার গুলশানে চারটি ফ্ল্যাট, ৩৩টি ব্যাংক হিসাব, তিনটি শেয়ার ব্যবসার বিও অ্যাকাউন্ট, প্রায় ৬২১ বিঘা জমি, ১৯টি কোম্পানির শেয়ার এবং ৩০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র।
এরই মধ্যে আদালত জব্দকৃত সম্পত্তি দেখাশোনার জন্য রিসিভারও নিয়োগ দিয়েছেন।
এছাড়া গোপালগঞ্জে তার মালিকানাধীন সাভানা রিসোর্ট ও ন্যাচারাল পার্কের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে জেলা প্রশাসন। এই রিসোর্টের চেয়ারম্যান বেনজীর আহমেদের স্ত্রী জিশান মীর্জা। চারটি ফ্ল্যাটের মধ্যে তিনটিই স্ত্রীর নামে এবং আরেকটি মেয়ের নামে।
দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তারা আদালতের কাছে লিখিতভাবে বেনজীর আহমেদ, তার স্ত্রী এবং মেয়েদের নামে থাকা স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের হিসাব জমা দিয়েছেন।
অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যদের গত ২৮ মে তলব করেছিল দুদক। প্রথম দফায় হাজির না হয়ে সময় আবেদন করলে ১৫ দিন সময় দিয়েছিল দুদক। কিন্তু দ্বিতীয় দফা তলবে এ সপ্তাহেও দুদকে হাজির হননি তারা।
পরে দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, তারা লিখিতভাবে বক্তব্য জমা দিয়েছেন। এখন নির্ধারিত সময়ের মধ্যে দুদকের তদন্তকারী দল প্রতিবেদন জমা দেবে। সেই প্রতিবেদন পাওয়ার পর কমিশন পরবর্তী সিদ্ধান্ত দেবে।
‘ছাগল কাণ্ডে’ বিতর্কে রাজস্ব বোর্ডের সাবেক সদস্য মতিউর রহমান
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট ছিলেন ড. মতিউর রহমান।
সম্প্রতি ঈদুল আজহার আগে মুশফিকার রহমান ইফাত নামে এক তরুণ ১৫ লাখ টাকার ছাগল ‘কিনে’ আলোচনায় আসে। পরে সামাজিকমাধ্যম ও গণমাধ্যমে খবর ছড়িয়ে পড়ে যে ওই তরুণ মতিউর রহমানের ছেলে। যদিও তিনি সংবাদমাধ্যমের কাছে তা অস্বীকার করেছেন।
তবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একজন সংসদ সদস্য সংবাদমাধ্যমকে জানান মতিউর রহমানের দ্বিতীয় স্ত্রীর ছেলে ইফাত।
এরপরই মতিউর রহমানের বিপুল সম্পদের সংবাদ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হতে থাকে। একই সাথে প্রকাশিত হয় দেশে ও বিদেশে তার সন্তান ও পরিবারের সদস্যদের বিলাসবহুল জীবনের খবর।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, মতিউর রহমান এবং তার স্ত্রী, ছেলে-মেয়েসহ পরিবারের সদস্যদের নামে এখন পর্যন্ত ৬৫ বিঘা জমি, আটটি ফ্ল্যাট, দুটি রিসোর্ট ও পিকনিক স্পট এবং দুটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে।
এছাড়াও শেয়ারবাজারে ছেলে ও মেয়ের নামে কোটি কোটি টাকার শেয়ার রয়েছে।
গণমাধ্যমে মতিউর রহমান ও তার পরিবারের বিপুল পরিমাণ সম্পদে তথ্য প্রকাশের পরই তাকে সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়।
একইসাথে ভ্যাট আপিলেট ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে সংযুক্ত করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার। তবে রোববার জারি করা ওই প্রজ্ঞাপনে কোনো কারণ উল্লেখ করা হয়নি।
এদিকে, অবৈধ সম্পদ অর্জন, হুন্ডি এবং বিদেশে অর্থ-পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক। এরই মধ্যে তিন সদস্যের একটি দল ও গঠন করা হয়েছে বলে দুদক সচিব মিজ ইয়াসমীন জানিয়েছেন সাংবাদিকদের।
একইসাথে মতিউর রহমান, তার প্রথম স্ত্রী এবং ছেলের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে আদালত। তবে বাংলাদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে তাদের দেশত্যাগের খবর প্রকাশিত হয়েছে।
সরকারি চাকরিবিধি অনুযায়ী, সরকারি চাকরিজীবীদের কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া ব্যবসা করার কোনো সুযোগ নেই।
অথচ মতিউর রহমান শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের যে ব্যবসার সাথে জড়িত তার জন্য অনুমতি নেননি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে। ফলে তিনি সিকিউরিটিজ আইন লঙ্ঘন করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
সাবেক ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়ার বিপুল সম্পদ
সাবেক আইজিপি বেনজির আহমেদের দুর্নীতির অভিযোগের আলোচনার মধ্যেই গণমাধ্যমে সাবেক ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়ার সম্পদের খবর প্রকাশিত হয় সংবাদপত্রে।
২০১৯ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর অবসরে যান ডিএমপির সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া।
ওই খবরে বলা হয়, সাবেক এই পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রীর নামে ঢাকায় একটি বাড়ি ও দুইটি ফ্ল্যাট, ছেলের নামে একটি বাড়ি, মেয়ের নামে ফ্ল্যাট রয়েছে। ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জে তার স্ত্রী ও সন্তান ও পরিবারের অন্যদের নামে বিপুল পরিমাণ জমি রয়েছে।
যদিও সাবেক এই কর্মকর্তা প্রথম আলো পত্রিকার কাছে দাবি করেছেন, তার সব সম্পদই বৈধ আয়ে কেনা।
প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, সরকারি এসব কর্মকর্তারা প্রত্যেকেই নিজ নামে ছাড়াও স্ত্রী, সন্তান এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের নামে সম্পত্তি করেছেন।
দুর্নীতির অভিযোগে সহযোগী অপরাধীদের শাস্তি কী?
বাংলাদেশে দুর্নীতির যেকোনো অভিযোগের বিচার হয় ২০০৪ সালের দুর্নীতি দমন কমিশন আইন অনুযায়ী।
এই আইনে সম্পদের তথ্য গোপন এবং জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে বিচার করা হয়।
আইনটিতে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের ধারায় বলা হয়েছে, যদি দেখা যায় কোনো ব্যক্তির নিজ নামে বা তার পক্ষে অন্য কোনো ব্যক্তির নামে অসাধু উপায়ে অর্জিত কোনো স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তি দখলে রয়েছে বা মালিকানায় রয়েছে যেটি তার জ্ঞাত আয়ের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ - তাহলে সেটি তদন্তের আওতায় আসবে।
একইসাথে সে ওই সম্পত্তির দখল সম্পর্কে আদালতের কাছে সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিতে ব্যর্থ হলে তা জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হবে।
এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সাজা ১০ বছরের কারাদণ্ড এবং ন্যূনতম সাজা তিন বছরের কারাদণ্ড। এছাড়া অর্থদণ্ড এবং ওইসব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার বিধানও রয়েছে এই আইনে।
এছাড়া সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগে সর্বোচ্চ সাজা তিন বছরের কারাদণ্ড।
আইনজীবীরা বলছেন, এসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হলে আদালত আইনানুযায়ী সর্বোচ্চ সাজাই দিতে পারবে। একইসাথে অপরাধ ঘটানোতে সহায়তাকারী হিসেবে স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে এবং পরিবারের অন্যদেরও এই শাস্তি দেয়ার বিধান রয়েছে।
দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘দণ্ডবিধির ১০৯ ধারা অনুযায়ী অপরাধ সংঘটনের সহায়তাকারী হিসেবে তাদেরকেও মূল অপরাধীদের মতোই শাস্তি দেয়ার বিধান রয়েছে।’
‘তবে দণ্ড নির্ধারণ করা আদালতের বিচারিক এখতিয়ার। বাংলাদেশের বিচারিক আদালতে সাধারণত এসব মামলার সহযোগী অপরাধীদের তিন থেকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেয়ার রেওয়াজ রয়েছে,’ জানান তিনি।
ফলে দুর্নীতিতে সহায়তাকারীদেরও সর্বোচ্চ শাস্তি দেয়া যায়। তবে এটি আদালতের বিচারিক এখতিয়ার।
অর্থ পাচার আইনে যে শাস্তি
বাংলাদেশে অর্থ পাচার মামলার বিচার করা হয় ২০১২ সালের মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন অনুযায়ী।
এই আইনে যে ব্যক্তি অর্থ পাচার করে সেই ব্যক্তি এবং সহায়তা বা ষড়যন্ত্রকারী প্রত্যেকেরই সমান সাজা সুনির্ধারিতভাবে বলা হয়েছে।
এতে সর্বোচ্চ সাজা ১২ বছরের কারাদণ্ড এবং ন্যূনতম চার বছরের কারাদণ্ড দেয়ার বিধান রাখা হয়েছে। এছাড়াও অপরাধের সাথে সংশ্লিষ্ট সম্পত্তির দ্বিগুণ মূল্যের সমপরিমাণ অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করার বিধানও রয়েছে।
একইসাথে দণ্ডিত ব্যক্তির সম্পত্তিও রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করার বিধান রাখা হয়েছে।
সূত্র : বিবিসি
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা