অপরাধের হটস্পটগুলো চিহ্নিত, ২৪ ঘণ্টা নজরদারি : সেনা সদর
কমেছে চাঁদাবাজি-মব জাস্টিস-হত্যা, বান্দরবানে ২০ শ্রমিককে অপহরণ করেছে দুষ্কৃতিকারীরা- নিজস্ব প্রতিবেদক
- ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২০:১৫

সেনাসদর মিলিটারি অপারেশনস ডাইরেক্টরেটের কর্নেল স্টাফ কর্নেল মো: শফিকুল ইসলাম বলেছেন, অপরাধের হটস্পটগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলো ২৪ ঘণ্টা নজরদারির আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। এছাড়াও শুধু মব জাস্টিস নয়, চাঁদাবাজি, চুরি, রাহাজানি ও হত্যা আগের চাইতে কমেছে।
তিনি জানান, গত দুই মাস আগে চাঁদাবাজির অভিযোগ ছিল ২৫০টি কিন্তু বর্তমানে তা কমে ১২০টিতে নেমেছে। চুরি ৮৫০’র মতো হতো, বর্তমানে ৬০০’র নিচে নেমে এসেছে। হত্যাকাণ্ড ছিল ৩৫০, বর্তমানে তা ১২০-এ নেমে এসেছে। এসব বিষয়ে সেনাবাহিনীর কর্মতৎপরতা অব্যাহত রয়েছে।
সোমবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে ঢাকা সেনানিবাসে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে গত ৫০ দিনে সেনাবাহিনীর কার্যক্রমের পরিসংখ্যান তুলে ধরে তিনি এসব তথ্য জানান।
এক প্রশ্নের জবাবে কর্নেল মো: শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘অপরাধের হটস্পটগুলো চিহ্নিত করেছি। হটস্পটগুলো সার্বক্ষণিক ২৪ ঘণ্টা নজরদারির আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। এর মাধ্যমে মব জাস্টিসসহ চাঁদাবাজি, চুরি ও হত্যা আগের চেয়ে কমে এসেছে। অদূর ভবিষ্যতে আরো কমে আসবে।’
বান্দরবানের লামায় বেশ কয়েকজন শ্রমিক অপহরণ হয়েছে। তাদের উদ্ধারের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সেনাবাহিনীর পরিসংখ্যান অনুযায়ী লামা থেকে ২০ জনের মতো শ্রমিককে গুম করা হয়েছে। দুষ্কৃতিকারীদের কোনো একটি দল অপহরণ করেছে। তাদেরকে উদ্ধারে সেনাবাহিনীর পাশাপাশি পুলিশ, বিজিবি, আনসার বাহিনীরও অভিযান চলমান রয়েছে। অপহরণকারীরা একটি নম্বর দিয়েছে, হয়তো টাকা চেয়েছে তারা। শ্রমিকদের উদ্ধারে সেনাবাহিনীর কার্যক্রম চলমান।’
পার্বত্য অঞ্চলে কুকি-চিনের দৌরাত্ম্যের প্রশ্নে কর্নেল মো: শফিকুল ইসলাম বলেন, সেনাবাহিনীর পেট্রোলিংয়ের কারণে কুকি-চিনের দৌরাত্ম্য কমাতে পেরেছি। গতকালও (রোববার) কুকি-চিনের দুটি ক্যাম্প (আস্তানা) ধ্বংস করেছি। এছাড়াও কুকি-চিনের অত্যাচারে বাড়িছাড়া ১১টি বম পরিবারকে সম্প্রতি সেনাবাহিনীর সহায়তায় তাদের গ্রামে আনা হয়েছে। কুকি-চিনের বিরুদ্ধে আভিযানিক কার্যক্রম চলমান রয়েছে।’
ঢাকার মোহাম্মদপুর ও বনানীতে সেনাবাহিনীর কিছু বিপথমী সদস্য ও কিছু অবসরপ্রাপ্ত অফিসার ডাকাতির সাথে জড়িত ছিল তাদের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। এ বিষয়ে উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। সেখানে আইনের আওতায় তাদের বিচার করা হবে। আর যারা অবসরপ্রাপ্ত সদস্য তাদের দেশের প্রচলিত আইনের আওতায় বিচার করা হবে। কোনো অন্যায়কে সেনাবাহিনী কখনো প্রশ্রয় দেয় না। সেনাবাহিনী সব সময় সততার সাথে আছে এবং থাকবে। জনগণের আস্থার জায়গায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে পাশে পাবেন।’
সেনাবাহিনী জনগণের আস্থার জায়গা অর্জন করতে কোন কোন পন্থা অবলম্বন করছে, এমন প্রশ্নের জবাবে কর্নেল মো: শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘দেশের মানুষের পাশে থেকে সেনাবাহিনী সব সময় নিরপেক্ষ পন্থা অবলম্বন করে কাজ করে। জনগণের আস্থার জায়গায় সেনাবাহিনী সব সময় কাজ করছে।’
সেনাবাহিনী মাঠে কাজ করতে গিয়ে কোনো চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সেনাবাহিনী কোনো চ্যালেঞ্জ ফেস করছে না। তবে আমরা দীর্ঘ ছয় মাস বাইরে নিয়োজিত রয়েছি। অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে সমন্বয় করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছে সেনাবাহিনী।’
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা ধরনের গুজব ছড়াচ্ছে, এসব গুজব মনিটরিংয়ে সেনাবাহিনীর কোনো তৎপরতা আছে কি-না জানতে চাইলে শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেকারোর মত প্রকাশের সুযোগ রয়েছে। সবার মত প্রকাশ করবে। সেনাবাহিনী কাউকে বাধা দিচ্ছে না। তবে কে, কেমন, কী মত প্রকাশ করছে তা কতটুকু বস্তুনিষ্ঠ এর বিচারের দায়ভার সাংবাদিকদের উপর দিয়ে দিতে চাই।’
তিনি বলেন, ২৮ ডিসেম্বর থেকে ১৬ ফেব্রুয়ারি গত ৫০ দিনে সেনাবাহিনীর কার্যক্রমের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, আইনশৃংখলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনী ১৭২টি অবৈধ অস্ত্র এবং ৫২৭ রাউন্ড গোলাবারুদ উদ্ধার করেছে।
এ সময়কালে দেশের বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে (মূলত গাজীপুর, আশুলিয়া ও সাভার এলাকায়) ৮৮টি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি এবং এ ধরনের পরিস্থিতি থেকে উদ্ভূত ৩০ বার মূল সড়ক অবরোধ নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনী সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে। কারখানাগুলোকে চালু রাখার জন্য মালিকপক্ষ, শ্রমিকপক্ষ, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, শিল্পাঞ্চল পুলিশ, বিজিএমইএসহ সংশ্লিষ্ট সকলের সমন্বয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ফলশ্রুতিতে, বর্তমানে দেশের ২ হাজার ৯৭টি গার্মেন্টস কারখানার মধ্যে গুটি কয়েক (বেক্সিমকো গ্রুপ, সাউদার্ন ডিজাইনার’স লিমিটেড, স্বাধীন গার্মেন্টস প্রাইভেট লিমিটেড ও সেলফ ইননোভেটিভ ফ্যাশন লিমিটেড) ছাড়া সব কারখানাই চালু রয়েছে।
শিল্পাঞ্চল ছাড়াও সেনাবাহিনীর সদস্যরা গত এক মাসে ৪২টি বিভিন্ন ধরনের বিশৃংখল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেছে, যার মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সংক্রান্ত ঘটনা ছিল ১৪টি, সরকারি সংস্থা/অফিস সংক্রান্ত ৩টি, রাজনৈতিক কোন্দল ৯টি এবং অন্যান্য বিভিন্ন ধরনের ঘটনা ছিল ১৬টি।
সেনাবাহিনী কর্তৃক সুষ্ঠুভাবে সম্পন্নকৃত উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটনা
কর্নেল মো: শফিকুল ইসলাম আরো বলেন, গত ৩১ ডিসেম্বর ইংরেজি নববর্ষ উৎযাপনের লক্ষ্যে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী অন্যান্য সকল আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে সমন্বয় করে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছে।
গত ১৭ জানুয়ারি রাজধানীর হাজারীবাগে অবস্থিত ফোনিক্স লেদার কমপ্লেক্সে সংঘটিত অগ্নিদুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসকে সর্বাত্মক সহযোগিতা দিয়েছে।
বিশ্ব ইজতেমা সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ইজতেমা ময়দানে তুরাগ নদীর উপরে পাঁচটি ব্রিজ স্থাপন, বোম ডিসপোজাল দলসহ প্রয়োজনীয় সংখ্যক জনবল মোতায়েন ও পর্যাপ্ত সংখ্যক সেনা সদস্য যে কোনো উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য ২৪ ঘণ্টা প্রস্তুত রয়েছে।
এছাড়াও, রাজধানীর সংস্কার কর্মকাণ্ড যেমন- এন্টি পলিথিন অপারেশন ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে পরিচালিত খাল পুনরুদ্ধার অভিযানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সর্বাত্মক সহযোগিতা দিচ্ছে।
তিনি বলেন, গত এক মাসে যৌথ অভিযানে ৩৩৪ জন মাদক কারবারি ও মাদকের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অবৈধ মাদকদ্রব্য, যেমন- ইয়াবা, ফেনসিডিল, অবৈধ মদ ইত্যাদি উদ্ধার করা হয়েছে।
সব মিলিয়ে গত এক মাসে বিভিন্ন ধরনের অপরাধের সাথে সম্পৃক্ত মোট ২ হাজার ১৪২ জন ব্যক্তিকে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
কর্নেল শফিকুল ইসলাম বলেন, এসকল কাজের পাশাপাশি সেনাবাহিনী দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখা, বিদেশী কূটনীতিক ব্যক্তি ও দূতাবাসগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি-শৃংখলা বজায় রাখা এবং কক্সবাজার জেলায় এফডিএমএন ক্যাম্প এলাকার নিরাপত্তা বিধান করার দায়িত্বও সার্বক্ষণিকভাবে পালন করে যাচ্ছে।
সেনা সদরের এই কর্মকর্তা আরো বলেন, আইনশৃংখলা রক্ষার পাশাপাশি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিভিন্ন সময়ে যারা আহত হয়েছেন, তাদের সুচিকিৎসার জন্য সেনাবাহিনী অদ্যাবধি ৩ হাজার ৮৫৯ জনকে দেশের বিভিন্ন সিএমএইচে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে, যার মধ্যে ৪১ জন এখনো চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
দেশের বিরাজমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা, দেশের জনগণের জানমাল এবং রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ ও স্থাপনার নিরাপত্তা প্রদানসহ সার্বিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। সেনাবাহিনী প্রধানের দিক-নির্দেশনাকে অনুসরণ করে দেশের ৬২টি জেলায় সেনাসদস্যরা আইন-শৃংখলা রক্ষায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী, স্থানীয় প্রশাসন, বিভিন্ন সংস্থা, গণমাধ্যম এবং সাধারণ জনগণের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে সার্বক্ষণিক সক্রিয়ভাবে দায়িত্ব পালন করছে। এই সমন্বয় ও পারস্পরিক সহযোগিতা আরও বৃদ্ধি করে কর্মধারা অব্যাহত রাখতে সেনাবাহিনী অঙ্গীকারাবদ্ধ বলেও উল্লেখ করেন কর্নেল শফিকুল ইসলাম।