৪০তম বিসিএসে নিয়োগ পাওয়া ২৫ এএসপিকে নিয়ে কী হচ্ছে
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ০৫ জানুয়ারি ২০২৫, ২০:০৩
৪০তম বিসিএসের পুলিশ ক্যাডারে নিয়োগ পাওয়া ২৫ জন সহকারী পুলিশ সুপার বা এএসপির মধ্যে অন্তত ২১ জনকে চাকরি থেকেই বাদ দেয়ার চেষ্টা চলছে বলে তাদের মধ্যে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে ওই ২১ জন কর্মকর্তার পরিবার বিষয়টি মানবিক দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ করে আইজিপির কাছে আবেদন করেছেন।
এর আগে অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহে শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে রাজশাহীর চারঘাটে সারদা পুলিশ একাডেমিতে চূড়ান্তভাবে নিয়োগের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত ও প্রশিক্ষণরত ২৫২ জন উপপরিদর্শককে (এসআই) অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।
তাদের বিরুদ্ধে কুচকাওয়াজ অনুশীলনে সকালের নির্ধারিত নাশতা না খেয়ে হৈচৈ করে বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টির অভিযোগ করা হয়েছিল।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী তখন সাংবাদিকদের বলেছিলেন যে- ‘রাজনৈতিক পরিচয় নয়, শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে ২৫২ জন এসআইকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।’
এরপর পহেলা জানুয়ারি আরো আট এসআইকে অব্যাহতি দিয়ে একাডেমি থেকে বের হয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। তাদের বিরুদ্ধে মাঠে নির্দেশনা না মেনে উচ্চ স্বরে হইচই করার অভিযোগ আনা হয়েছিল।
এখন বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম কোটামুক্ত বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বুনিয়াদী ও বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণসহ চাকরি স্থায়ীকরণের সব শর্ত পূরণ করেও উৎকণ্ঠা আর অনিশ্চয়তার প্রহর গুনছেন সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) পদমর্যাদার ২৫ জন কর্মকর্তা।
অথচ একই বিসিএসে নিয়োগ পাওয়া অন্য ক্যাডারের সদস্যরা গত সরকারের আমলেই তাদের কাজে যোগ দিয়েছেন এবং তারা বহালও আছেন।
পুলিশের নতুন এসব কর্মকর্তাদের বিষয়ে নতুন করে যে পুলিশ ভেরিফিকেশন করা হয়েছে তা নিয়েও অনেক অভিযোগ উঠছে। যদিও এই ভেরিফিকেশনের ভিত্তিতেই ২১ জনকে চাকরি থেকে বাদ দেয়ার বিষয়টি প্রায় চূড়ান্ত হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়েছে।
যদিও এসব কর্মকর্তাদের চাকরি থেকে বাদ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে রাজশাহীতে বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমির প্রিন্সিপাল ও অতিরিক্ত আইজিপি মো: মাসুদুর রহমান ভুঁইয়া বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ‘এসব এএসপিরা সারদাতেই প্রশিক্ষণরত রয়েছেন এবং এ বিষয়ে অন্য আর কোনো খবর তার কাছে নেই’।
প্রসঙ্গত, প্রশিক্ষণ শেষে গত ২০ অক্টোবর এসব এএসপিদের সমাপনী কুচকাওয়াজ বা পাসিং প্যারেড হওয়ার হওয়া থাকলেও ১৯ অক্টোবর রাতে সেটি বাতিল করা হয়। পরে ২৪ নভেম্বর আবারো তারিখ দিয়ে সেটিও স্থগিত করা হয়।
এসব কর্মকর্তাদের পরিবারের পক্ষ থেকে তাদের বিষয়টি মানবিক দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ করে শনিবার আইজিপির কাছে আবেদন করেছেন।
বিস্তারিত কী জানা যাচ্ছে
সারদায় প্রশিক্ষণে থাকা বেশ কয়েকজন শিক্ষানবিশ এএসপির সাথে বিবিসি বাংলার কথা হয়েছে। প্রশিক্ষণরত থাকায় তারা তাদের নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করেছেন।
তাদের একজন বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, নতুন করে যে ভেরিফিকেশন করা হয়েছে সেখানে তার ‘দূর সম্পর্কের আত্মীয় এক আওয়ামী লীগ নেতাকে তার পরিবারের সদস্য হিসেবে দেখানো হয়েছে’ বলে তিনি জানতে পেরেছেন।
অন্য আরেকজন জানিয়েছেন তিনিসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে যে ‘তাদের ক্যাম্পাস জীবনে ছাত্রলীগের নেতাদের সাথে হাঁটতে কিংবা কথা বলতে দেখা গেছে’ নতুন ভেরিফিকেশনে এমন রিপোর্ট দেয়া হয়েছে বলে তারা জানতে পেরেছেন।
‘আসলে যাদের টার্গেট করা হয়েছে তাদের নামে যা খুশি তাই বলা হচ্ছে। আর এটা হচ্ছে শুধু ৪০তম বিসিএসে পুলিশ ক্যাডারে যারা যোগ দিয়েছেন শুধু তাদের নিয়েই।’
‘অথচ অন্য ক্যাডারের সবাই আগের সরকারের আমল থেকেই চাকরিতে যোগ দিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন’ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন ওই কর্মকর্তাদের একজন।
তবে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ২০১৮ সালে সরকারি চাকরিতে কোটাবিরোধী আন্দোলনের জের ধরে সরকার সব কোটা বাতিল করে দেয়ার পর ৪০তম বিসিএস ছিল প্রথম বিসিএস পরীক্ষা।
সেই পরীক্ষার সবগুলো ধাপ উত্তীর্ণ হয়ে ২০২২ সালের ৪ ডিসেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগদান করেছিলেন পুলিশ ক্যাডারে উত্তীর্ণ হয়ে এএসপি পদের জন্য নিয়োগপ্রাপ্তরা।
এরপর দিন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এসব কর্মকর্তার চাকরি পুলিশ সদর দফতরে ন্যস্ত করার পরের তিন মাস তারা পুলিশ স্টাফ কলেজে বিভিন্ন প্রশিক্ষণে অংশ নেন।
এরপর পুলিশসহ সব ক্যাডারের ৬০২ জন সাভারে পিএটিসিতে ছয় মাসের বুনিয়াদী প্রশিক্ষণ নেন। পুলিশ ক্যাডারদের পাঠানো হয় রাজশাহীতে পুলিশ একাডেমিতে। সেখানে ৪০তম বিসিএসের ৬৮ জন ও ৩৮তম বিসিএসের তিনজন। অর্থাৎ মোট ৭১ জন এক বছর মেয়াদী বেসিক ট্রেনিং কোর্স শুরু করেন।
পরে এসব পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে চারজন ৪১তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারে নিয়োগ পেয়ে চলে গেলে প্রশিক্ষণরত এএসপির সংখ্যা দাঁড়ায় ৬৭ জনে। পরে একজন ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ায় আর প্রশিক্ষণ চালিয়ে যেতে পারেননি।
সবমিলিয়ে ৬৬ জন শিক্ষানবিশ এএসপি প্রশিক্ষণের ছয় মাস শেষে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন ও পরে এক বছর মেয়াদী প্রশিক্ষণ কোর্স শেষ করার পর চলতি বছরের ২০ অক্টোবর তাদের সমাপনী কুচকাওয়াজ হওয়ার কথা ছিল, যা ১৯ অক্টোবর বাতিল করা হয়।
‘আগের রাতে কালচারাল অনুষ্ঠান ছিল। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ও আইজিপিসহ সংশ্লিষ্টরা রাজশাহীতে পৌঁছে গেছিলেন। কিন্তু হুট করে কালচারাল অনুষ্ঠান, ফরমাল ডিনার ও পাসিং আউট সব বাতিল করার কথা আমাদের জানানো হলে আমরা বিস্মিত হই। কারণ চাকরি স্থায়ীকরণের সব শর্ত আমাদের পূরণ হয়ে গিয়েছিল,’ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন একজন শিক্ষানবিশ কর্মকর্তা।
পরে জানা যায়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের একজন সমন্বয়কের ফেসবুকে দেয়া এক পোস্টের জের ধরে সমাপনী কুচকাওয়াজ ‘অনিবার্যকারণ বশত’ স্থগিতের কথা জানায় কর্তৃপক্ষ। পোস্টে ওই সমন্বয়ক প্রশিক্ষণ শেষ করা কর্মকর্তাদের ‘ছাত্রলীগ ক্যাডার’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
এরপর ২৪ নভেম্বর আবারো পাসিং আউট বা সমাপনী কুচকাওয়াজের তারিখ নির্ধারণ করে সেটিও বাতিল করা হয়।
‘নিয়মানুযায়ী প্রশিক্ষণ শেষ হওয়ার পর একাডেমিতে কর্মকর্তাদের রাখার সুযোগ নেই। কেউ শৃঙ্খলা ভঙ্গ করলে একাডেমির ম্যানুয়াল অনুযায়ী নানা ধরনের শাস্তির বিধান আছে। কেউ ৩/৪ বার একই ভুল করলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া যায়। কিন্তু এসব কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে এর কিছুই ঘটেনি,’ বলছেন ওই কর্মকর্তা।
এলোমেলো হাঁটা, হৈ চৈ ও কটূক্তির অভিযোগ
পাসিং আউট বা সমাপনী কুচকাওয়াজ স্থগিতের ‘নজিরবিহীন ঘটনা’টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনার পর এসব কর্মকর্তাদের মধ্যে ২৫ জনকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয় কর্তৃপক্ষ।
এর মধ্যে ২১ জনের বিরুদ্ধে ২৬ নভেম্বর প্রশিক্ষণ মাঠে 'দৌড়ানোর নির্দেশ সত্ত্বেও এলোমেলোভাবে হাঁটা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির' অভিযোগ আনা হয়। পাশাপাশি 'ওস্তাদজির (ট্রেইনার) নির্দেশে অমান্য করে তর্কে লিপ্ত হওয়া ও কটূক্তির অভিযোগ’ও আনা হয় তাদের বিরুদ্ধে।
আর বাকি চারজনের বিরুদ্ধে ২৪ নভেম্বর মুভি নাইটের সময় (প্রশিক্ষণার্থী পুলিশ কর্মকর্তাদের তাদের পেশার সাথে সম্পর্কিত শিক্ষামূলক সিনেমা দেখানো হয়) পাসিং আউট নিয়ে হৈ চৈ করা ও দুর্ব্যবহারের অভিযোগ আনা হয় কারণ দর্শানোর নোটিশে। এর মধ্যেই এসব কর্মকর্তাদের নিয়ে আবারো পুলিশ ভেরিফিকেশন করা হয়।
যাদের কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয়েছে তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন বিবিসি বাংলার কাছে দাবি করেছেন, ‘নোটিশে যেসব অভিযোগ করা হয়েছে এসব ঘটনাই ঘটেনি’। তাদের দাবি, ‘তাদের টার্গেট করা হয়েছে বলেই এসব কাল্পনিক অভিযোগ এনে’ চাকুরিচ্যুত করতে যাচ্ছে কর্তৃপক্ষ।
যদিও এ ধরনের চেষ্টার ব্যাপারে কোনো তথ্য নেই বলে জানিয়েছেন পুলিশের কর্মকর্তারা।
জানা গেছে, ৪০তম বিসিএসে পুলিশ ক্যাডারে যারা নিয়োগ পেয়েছিলেন তাদের মধ্যে ১১ জন সনাতন ধর্মাবলম্বী। আর তাদের সাথে একই সাথে প্রশিক্ষণে থাকা ৩৮তম বিসিএসের তিনজনের মধ্যে একজন সনাতন ধর্মের।
সবমিলিয়ে এই ১২ জনের মধ্যে নয়জনকেই কারণ দর্শাওনোর নোটিশ দিয়ে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ আনা হয়েছে। আর বাকি ১৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো তারা ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন।
শোকজপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা জানান, শুক্রবার তারা জানতে পেরেছেন যে ২৫ জনের মধ্যে ২১ জনকে চাকরি থেকে বাদ দেয়ার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে ফাইল পুলিশ সদর দফতরে পাঠানো হয়েছে। তবে পুলিশ সদর দফতর কিংবা সারদা পুলিশ একাডেমিতে এ তথ্যের সত্যতা বিবিসি যাচাই করে দেখতে পারেনি।
সূত্র : বিবিসি
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা