০৫ জানুয়ারি ২০২৫, ২১ পৌষ ১৪৩১, ৪ রজব ১৪৪৬
`
কৃষি মন্ত্রণালয়ের পার্টনার প্রকল্প

ছুটির দিনে সারাদেশ থেকে খামারবাড়ি ডেকে এনে টাকা তুলছে প্রকল্প অফিস

অডিট ম্যানেজে দুই কোটি টাকারও বেশি তোলার টার্গেট!
হিসাবরক্ষক অফিসে টাকা উত্তোলন - ছবি : নয়া দিগন্ত

সারাদেশ থেকে জেলা-উপজেলা, কৃষি অঞ্চল ও হর্টিকালচার সেন্টারের হিসাবরক্ষকদের ঢাকায় ডেকে এনে অডিটের (নিরীক্ষা) জন্য দুই থেকে আড়াই শতাংশ হারে টাকা তুলছেন কৃষির সবচেয়ে বড় প্রকল্প পার্টনার প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক (পিডি)।

বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের অডিট সম্পন্ন করার জন্য সারাদেশ থেকে হিসাবরক্ষকদের খামারবাড়িতে প্রকল্প অফিসে ডাকা হয় শুক্রবার (৩ জানুয়ারি)। বিগত বছরে বরাদ্দকৃত অর্থের খরচের বিল ভাউচার বা প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিতে বলা হয় তাদের।

তবে প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা অডিট বা নিরীক্ষা সম্পন্নের জন্য খরচের নামে দুই থেকে আড়াই শতাংশ হারে টাকা নিচ্ছেন বলে সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা যায়। সেই হিসাবে দুই কোটিরও বেশি টাকা তোলার আয়োজন করেছে পার্টনার।

উল্লেখ্য, দেশের ৪৯৫টি উপজেলা, ৬৪ জেলা ছাড়াও ১৪টি কৃষি অঞ্চল এবং ৭২টি হর্টিকালচার সেন্টারের বেশ কিছু সেন্টারে পার্টনার প্রকল্পের কার্যক্রম রয়েছে।

শুক্রবার সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও কৃষির প্রাণ ফার্মগেটস্থ খামারবাড়ি তথা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর (ডিএই) প্রধান কার্যালয়ে বেশ সরগরম। প্রধান গেট পেরিয়েই প্রথম বিল্ডিংয়ের লিফট দিয়ে ৬ তলায় উঠতেই দেখা গেল শত শত মানুষ। কেউ বসে আছেন, কেউ দাঁড়িয়ে। ৬ তলায় পার্টনারসহ আরো তিনটি প্রকল্প অফিস। পুরো এই ফ্লোর জুড়ে মানুষের ভিড়। কারো হাতে বা কাঁধে ব্যাগ, কারো কাছে ফাইল। কেউ বসে আছেন, কেউ দাঁড়িয়ে। কেউ আবার কাগজপত্র ঠিক করছেন। সবাই ব্যস্ত, যেন চাকরির ইন্টারভিউ চলছে।

তাদের সাথে কথা বলে জানা গেল, কৃষি মন্ত্রণালয়ের আওতাভুক্ত পার্টনার (প্রোগ্রাম অন এগ্রিকালচার অ্যান্ড রুরাল ট্রান্সফরমেশন ফর নিউট্রিশন, এন্টারপ্রেনরশিপ অ্যান্ড রেসিলিয়েন্স ইন বাংলাদেশ) প্রকল্পে অডিট (নিরীক্ষা) চলছে। সকাল ১০টার পর শুরু হয়েছে এ কার্যক্রম। সারাদেশ থেকে জেলা, উপজেলা, জেলা, বিভিন্ন কৃষি অঞ্চলের সংশ্লিষ্ট এবং বিভিন্ন হর্টিকালচার সেন্টারের থেকে প্রতিনিধি এসেছেন সেখানে। শনিবারও আসবেন।

পার্টনার প্রকল্পের পিডি বা পিসি (প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর) রুমের পাশেই অ্যাকাউন্টস অফিসার মানিকের রুমের সামনে গিয়ে ঠেকেছে এই লাইন। দূর-দূরান্ত থেকে আগত বিভিন্ন কৃষি অফিসের প্রতিনিধিদের বেশির ভাগই হিসাবরক্ষক। পার্টনার প্রকল্পের সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে সিরিয়াল স্লিপ নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়েছেন।

ঘণ্টা দেড়েক পুরো ফ্লোর ঘুরে সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা হলো এই প্রতিবেদকের। তাদের মধ্যে ঢাকা বিভাগের এক জেলার উপজেলা হিসাবরক্ষক জানালেন (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক), ‘দুই শতাংশ হারে তার ৪০ হাজার টাকা হয়েছিল। ১ হাজার টাকা কম দিয়েছিলাম। কিন্তু, মানিক (অ্যাকাউন্ট্যান্ট) ধমক দিয়ে সেটাও নিয়ে নিলো।’

বরিশালের এক উপজেলার হিসাবরক্ষক জানালেন, ‘সাধারণত সরেজমিনে গিয়ে সংশ্লিষ্টরা অডিট করেন। কিন্তু ছুটির দিনে ঢাকায় আনা হয়েছে আমাদের। টাকাও দিতো হলো, ভোগানোও হলো।’

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের প্রথম বিল্ডিংয়ের ৬ তলার পুরো ফ্লোর জুড়ে মানুষ। কমপক্ষে ১৫ জনের সাথে নাম-পরিচয় গোপন রেখে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তাদের বেশির ভাগই জানান, পার্টনার প্রকল্প থেকে যে পরিমাণ বরাদ্দ দেয়া ছিল গত অর্থবছরে (২০২৩-২৪), তার দুই শতাংশ অডিটের জন্য দিতে হচ্ছে। তাদের দুয়েকজন জানালেন, কারো কারো কাছ থেকে আড়াই শতাংশ হারেও টাকা রাখছেন অ্যাকাউন্টস অফিসার মানিক।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত অর্থবছরে প্রায় শত কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল জেলা, উপজেলাসহ বিভিন্ন স্থানে। শুক্র ও শনিবার দুই দিনে সারাদেশ থেকে দুই শতাংশ হারে হলেও দুই কোটি টাকার বেশি তোলার আয়োজন করেছে পার্টনার প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।

জানা যায়, কৃষি মন্ত্রণালয়ভুক্ত সাতটি প্রতিষ্ঠান পার্টনার প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। যার প্রাক্কলিত মোট ব্যয় ৬ হাজার ৯১০ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। বেশির ভাগই বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট প্রকল্পটি বাস্তবায়নের লিড প্রতিষ্ঠান কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর। যার বরাদ্দ ৩ হাজার ৩৫৮ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে প্রকল্পের শুরুর বছর তথা ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এডিবি বরাদ্দ ছিল ৩৫০ কোটি ৮৩ লাখ টাকা।

জুলাই ২০২৩ থেকে জুন ২০২৮ পর্যন্ত ৫ বছর মেয়াদে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পটির আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয় ২০২৩ সালের ১১ অক্টোবর। তখনো প্রকল্পের বাজেট বরাদ্দ না হলেও রাজধানীর খামারবাড়িস্থ কেআইবি মিলনায়তনে জাঁকজমকপূর্ণভাবে প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক যাত্রার উদ্বোধন করেন তৎকালীন কৃষি সচিব ওয়াহিদা আক্তার। পরের দিন দৈনিক নয়া দিগন্ত পত্রিকায় ‘অনভিজ্ঞ কর্মকর্তার কাঁধে বিদেশী ঋণের কৃষি প্রকল্প’ শিরোনামে খবর প্রকাশিত হয়। প্রকল্পের কাজে অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও কৃষি সম্প্রসারণ অফিস তৎকালীন কুমিল্লা জেলার ডিডি মো: মিজানুর রহমানকে প্রকল্প পরিচালক (পিডি) বা পিসি (প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর) নিয়োগ দেয়া নিয়ে প্রশ্ন ওঠে শুরুতেই। তৎকালীন কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাককে ম্যানেজ করে তিনি প্রকল্প পরিচালক হন বলে জানা যায়। পরবর্তী সময়ে কৃষি সচিব ‘ওয়াহিদা আক্তারের লোক’ হিসেবে পরিচিতি পান মিজানুর রহমান।

জানা যায়, বিদ্যমান কৃষি ব্যবস্থাকে রূপান্তর করে বাণিজ্যিক কৃষিতে পরিবর্তন এবং খাদ্যশস্য উৎপাদনে বৈচিত্র্য এনে কৃষিপণ্যের রফতানি বৃদ্ধি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করার লক্ষ্যে বিশ্ব ব্যাংক ও ইফাদের অর্থায়নে কৃষি খাতের প্রথম মেগা প্রকল্প পার্টনার বিগত ১৮ এপ্রিল একনেকে অনুমোদন হয়। যার মেয়াদ জুলাই ২০২৩ থেকে জুন ২০২৮ পর্যন্ত।

অভিযোগ রয়েছে, পার্টনার প্রকল্পের শুরুর বছরের অগ্রগতি খুবই কম। এছাড়া, নানাখাতে অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। কৃষি খাতের সবচেয়ে এই গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের প্রথম অর্থবছরের অডিট বা নিরীক্ষা সম্পন্ন করতে সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করতেই এই বিপুল পরিমাণ অর্থ তোলার আয়োজন করা হয়েছে।

এ বিষয়ে শুক্রবার দুপুর ১২টা ৩৮ মিনিটে খামারবাড়ির ভেতর থেকেই মোবাইলে কথা হয় প্রকল্প পরিচালক মিজানুর রহমানের সাথে। তিনি জানান, অডিট শুরু হবে আগামী ১৫ জানুয়ারি। এজন্য সারাদেশ থেকে ডাকা হয়েছে। অডিটের সাথে সংশ্লিষ্ট এবং প্রকল্পের কনসাল্টেন্টরা ওদের নিয়ে বসেছে।

সবার কাছ থেকে দুই থেকে আড়াই শতাংশ হারে টাকা নেয়া হচ্ছে- এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘না-না। এসবের সাথে আমি নাই।’

অ্যাকাউন্ট্যান্ট মানিক এই টাকা নিচ্ছে জানালে তিনি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলেন, ‘অডিট করা আমার কাজ না। আমার অফিস আমার অডিট করবে। ফিল্ডের অডিট ফিল্ডের ওরা করাবে। এর সাথে আমার পারসোনালি সম্পর্ক নাই।’

এরপর তিনি আবার বলেন, ‘অডিট হলো যার যারটা (উপজেলা-জেলা) সে সে করাবে। আমরা চাচ্ছিলাম ফিল্ডে অডিট হোক। এখন ওরা বলেছে সেন্ট্রালে করার জন্য, এই হলো বিষয়।’

মিজানুর রহমান বলেন, ‘উপজেলাসহ আমাদের স্পট হয়ে যায় ছয় শ’র মতো। অতোগুলো জায়গায় ওরা (অডিট যারা করবে) তারা যেতে চাচ্ছে না। তাই গ্রুপে গ্রুপে করবে। এজন্য ডাকা হয়েছে। ৫-৬টা গ্রুপে তারিখ দেয়া হয়েছে (ঢাকায় আসার)।’

গড়ে ৪০ হাজার টাকা করে নেয়া হচ্ছে। তাহলে তো বিশাল অ্যামাউন্ট তোলা হচ্ছে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটার সাথে আমার ব্যক্তিগত কোনো সম্পর্ক নাই। এগুলোর সাথে নিজেকে জড়াতেও চাই না।’

তাহলে আপনার অ্যাকাউন্ট্যান্ট মানিক এ টাকা কীভাবে তুলছে?- জবাবে পিডি বলেন, ‘আপনি যেহেতু বলছেন, পারসোনালি আমি খোঁজ নেব।’

এর কিছুক্ষণ পর দুপুর ১২ টা ৫১ মিনিটে ফোন ব্যাক করেন পিডি মিজানুর। জানান, ‘আমি খোঁজ নিয়েছি। বলেছি, যাস্ট স্টপ। এসব বদমাইশি এখানে চলবে না। আসলে এসব আমার নলেজেও ওইভাবে ছিল না। বদমাইশগুলোকে আসলে সামাল দেওয়াই মুশকিল। আপনি বলেছেন, খুবই খুশি হয়েছি।’

আপনাদের নির্দেশনা ছাড়া একজন অ্যাকাউন্ট্যান্ট এসব করতে পারে?- জবাব কিছুটা এড়িয়ে যান। তিনি বলেন, ‘অডিট টিম বলছিল যে ৬০০টা জায়গায় যাওয়া কঠিন। দীর্ঘ সময় লাগবে। তাই তাদের ডাকা হয়েছিল।’

তবে, সন্ধ্যা নাগাদ খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কার্যক্রম আগের মতোই চলছে।

এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মো: ছাইফুল আলম বলেন, ঢাকায় ডেকে এনে টাকা তোলার বিষয়টি তার জানা নেই।


আরো সংবাদ



premium cement
ডেঙ্গুতে মৃত্যু নেই, হাসপাতালে ৬৬ রোগী মোটরসাইকেলের সমান টুনা মাছ, দাম ১৬ কোটি কুমিল্লায় ২৪ দিন ধরে ভিক্ষুকের আশ্রয়ে অন্তঃসত্ত্বা যুবতী বিদেশে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য সিলেট হচ্ছে সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র তিন সঙ্কট মোকাবেলায় এডিবির সহযোগিতা চান পরিবেশ উপদেষ্টা নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুমে যৌথ অভিযানে ৪ লাখ ইট জব্দ আবু সাঈদ হত্যা : বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭১ শিক্ষার্থী বহিষ্কার সুষ্ঠু, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে ইসি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ : সিইসি আরো পাঁচ ব্যাংকের এমডিকে ছুটি মার্কিন সৈন্যদের বহিষ্কারের হুমকি হন্ডুরাসের চুয়াডাঙ্গায় সুন্দরবন ও চিত্রা এক্সপ্রেস থামানোর দাবিতে ট্রেন থামিয়ে অবরোধ

সকল