০১ জানুয়ারি ২০২৫, ১৭ পৌষ ১৪৩০, ১৮ জমাদিউস সানি ১৪৪৫
`

ক্যাডার কর্মকর্তারা বিধি ভাঙলে সরকারের কী করার ক্ষমতা আছে?

বাংলাদেশ সচিবালয় ভবন - ছবি : বিবিসি

বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকার ঘোষিত জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সম্ভাব্য সুপারিশ ঘিরে বেশ অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে বিসিএস ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্যে। এক দিকে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা ও অন্য দিকে বাকি ২৫টি ক্যাডারের মধ্যে পাল্টাপাল্টি অবস্থান নিয়ে এরই মধ্যে সরকারের মধ্যে বেশ অস্বস্তিও দেখা যাচ্ছে।

এমন পরিস্থিতিতে শুক্রবার রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেছেন, ‘যারা আন্দোলনের নামে চাকরিবিধি লঙ্ঘন করছে তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে। এবং তা এক সপ্তাহের মধ্যেই নেয়া হবে।’

এরপরই প্রশ্ন উঠেছে, সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে চাকরি বিধি অনুযায়ী কি ব্যবস্থা নেয়া যায়? তা সম্ভব কি না?

সরকারি চাকরি বিধিমালার বিভিন্ন ধারা অনুযায়ী, সরকারের কোনো সিদ্ধান্ত বা আদেশের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে প্রতিবাদ বা বিরোধিতা করলে আইন অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ রয়েছে।

জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশের পর সরকার কি ব্যবস্থা নিতে পারে, এমন প্রশ্নে সাবেক সচিব আবু আলম শহীদ খান বলেছেন, ‘কোনো ধারায় যদি অপরাধ হয়ে থাকে তাহলে শোকজ করার বিধান আছে। তবে তা করার আগে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সংকটের সমাধান করা যেতে পারে।’

এরই মধ্যে বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের বাইরে বাকি ২৫ ক্যাডারের সমন্বয়ে গঠিত আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ আগামী ৩ জানুয়ারি ঢাকায় একটি সমাবেশের ডাক দিয়েছে বলেও জানা গেছে।

এর আগে জনপ্রশাসন সংস্কারের কমিশনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তারা সংবাদ সম্মেলন, সারা দেশে কলম বিরতিসহ কিছু কর্মসূচিও পালন করেছে।

আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদের সমন্বয়ক ড. মুহম্মদ মফিজুর রহমান বলেছেন, ‘আমরা হালকা কর্মসূচি দিয়ে সারা দেশের কর্মকর্তাদের শান্ত করেছি। চেষ্টা করছি যাতে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি না হয়।’

তবে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন বা বিএএসএ বলছে, ‘আপাতত তারা কোনো কর্মসূচি পালন করবে না। এখনো সরকারের দিকে তাকিয়ে আছে তারা।’

সরকারের হুঁশিয়ারি

অন্তর্বর্তী সরকার ঘোষিত জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন চলতি মাসের মাঝামাঝি তাদের সম্ভাব্য কিছু সুপারিশের কথা তুলে ধরে সাংবাদিকদের কাছে।

সেখানে উপসচিব পদে পদোন্নতিতে প্রশাসন ক্যাডারের ৫০ শতাংশ এবং অন্য সব ক্যাডার থেকে ৫০ শতাংশ কোটা রাখা কিংবা উপসচিব পদে পদোন্নতিতে পরীক্ষা চালু এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকে ক্যাডারে না রেখে আলাদা কমিশন করার কথাও জানানো হয় সম্ভাব্য সুপারিশে।

গণমাধ্যমে এসব খবর আসার পর থেকেই প্রশাসন ক্যাাডারের কর্মকর্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখাতে থাকে। সংস্কার কমিশনের সাথে বৈঠকও করে তারা।

সাবেক ও বর্তমান আমলারা ঢাকায় একটি সমাবেশ করে সেখান থেকে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন প্রধানের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে অপসারণের দাবিও করেন তারা। কোনরকম আলোচনা ছাড়াই এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে জানিয়ে প্রতিবাদে নামে বাকি ২৫টি ক্যাডার নিয়ে গঠিত 'আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ'। এরই মধ্যে তারা কলম বিরতি, সংবাদ সম্মেলনসহ বেশ কিছু কর্মসূচিও পালন করেছে।

প্রশাসন ও অন্য ক্যাডার কর্মকর্তাদের এই প্রতিবাদের পর সরকারের মধ্যে এক ধরনের অস্বস্তি তৈরি হয়। যারা এই ধরনের আন্দোলনের নেমেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার হুশিয়ারি দেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম।

শুক্রবার রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘যারা আন্দোলনের নামে চাকরি বিধি লঙ্ঘন করছে তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে। আমলাদেরকেও আমরা বলছি, এখন সময় জনগণকে সেবা দেয়ার। আমাদের গণতান্ত্রিক ট্রানজিশন সেটাকে সঠিকভাবে করতে সহায়তা করার।’

সংস্কার কমিশনের সুপারিশ ঘিরে সরকারি কর্মকর্তাদের প্রতিক্রিয়া নিয়ে তিনি এ সময় বলেন, ‘একটা সংস্কারের মত নিয়ে আসলে তারা যে রিঅ্যাকশনটা দেখিয়েছে এটা আমরা মনে করি নৈতিকভাবেও ঠিক হয়নি। এবং তারা বিধিও লঙ্ঘন করেছে।’

উপদেষ্টা নাহিদ বলেন, ‘বিগত রেজিমেও যে আমলারা লুকিয়ে আছে নানাভাবে এখনো, তাদেরকেও আমরা চিহ্নিত করেছি। এবং বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় এসেছে, তাদের বিরুদ্ধেও খুবই দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া হবে।’

কী ব্যবস্থা নিতে পারে সরকার?

সরকারের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের এই বক্তব্যের পর প্রশ্ন উঠছে এসব সরকারি সিদ্ধান্তর প্রতিবাদ জানালে তাদের বিরুদ্ধে কী ধরনের ব্যবস্থা নেয়া যায়?

বাংলাদেশের সরকারি চাকরিজীবীদের আচরণ বিধিমালায় বেশ কিছু ধারা রয়েছে। যেখানে সরকারের সিদ্ধান্ত বা আদেশের বিরোধিতা করলে কী ব্যবস্থা নেয়া যায় তা নিয়েও বলা রয়েছে।

বাংলাদেশের সরকারি চাকরিজীবীদের কর্মচারি (আচরণ) বিধিমালা ১৯৭৯ থেকে ৩০-এর এ ধারা অনুযায়ী, সরকারি চাকরিজীবীরা সরকার বা কর্তৃপক্ষের কোনো আদেশ বা সিদ্ধান্ত পরিপালনে প্রকাশ্যে বিরোধিতা বা কোনো উপায়ে ব্যহত করতে পারবে না।

একই অনুচ্ছেদেরে বি উপ-ধারায় বলা আছে, সরকার বা কর্তৃপক্ষের কোনো আদেশ বা সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কোনো অসন্তোষ বা ক্ষোভ প্রকাশ বা আন্দোলনে অংশগ্রহণ বা অন্যদের অংশগ্রহণে সহায়তা করা যাবে না।

সি উপধারায় বলা আছে, সরকার বা কর্তৃপক্ষকে কোনো সিদ্ধান্ত পরিবর্তন, রূপান্তর, সংশোধন বা বাতিলের জন্য অসঙ্গত প্রভাব বা চাপ প্রয়োগ করা যাবে না।

এছাড়াও সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে বা সরকারি কর্মচারীদের বিভিন্ন অংশের অভ্যন্তরে কোনো উপায়ে অসন্তোষ, ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি বা সৃষ্টির চেষ্টা করা যাবে না।

একই চাকরি বিধিমালার ৩২ ধারায় বলা আছে, এই বিধি ভঙ্গ করলে তা আইন অনুযায়ী অসদাচরণ বলে গণ্য হবে এবং এ জন্য তারা শৃঙ্খলামূলক কার্যক্রমের আওতায় আসবেন।

জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ফিরোজ মিয়া বলেন, ‘এখন সরকারি কর্মকর্তারা যা করছেন সরকার চাইলে তাদের অসদাচরণের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করতে পারে। বিভাগীয় মামলায় করে যেকোন দণ্ডও দিতে পারেন। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে এখনই সে পর্যন্ত যাওয়ার যাওয়ার প্রয়োজন নাও হতে পারে।’

পাল্টাপাল্টি অবস্থান

জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের বক্তব্যের পর পদ-পদোন্নতিসহ চাকরি সংক্রান্ত বিভিন্ন দাবিতে এখন পরস্পরবিরোধী অবস্থান নিয়েছেন বিসিএসের বিভিন্ন ক্যাডারের কর্মকর্তারা। যে কারণে এসব বিষয় নিয়ে সরকারি চাকরিতে আন্ত:ক্যাডার দ্বন্দ্বও বাড়ছে।

এরই মধ্যে ২৫টি ক্যাডারের সমন্বয়ে গঠিত আন্ত:কাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ কিছু কর্মসূচি পালন করছে। আগামী ৩ জানুয়ারি ঢাকায় সমাবেশের ডাকও দিয়েছে তারা। তবে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা সংস্কার ইস্যুতে সচিবের সাথে বৈঠকের পর জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সাথেও বৈঠক করেছেন গত ২৬ ডিসেম্বর।

সাবেক ও বর্তমান আমলারা ঢাকায় একটি সমাবেশ করে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন প্রধানের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে অপসারণের দাবিও করেছিলেন। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের হুঁশিয়ারির পর বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন বলছে, ‘তারা নতুন করে কোনো ধরনের প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করবে না।’

এই সংগঠনটি অভিযোগ করছে, বাকি ২৫ ক্যাডারের কর্মকর্তারা সমাবেশসহ বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি পালন করে বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে চায়।

বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো: আনোয়ার উল্ল্যাহ বলেন, ‘আমরা আন্দোলন বা কোনো কর্মসূচি পালন করছি না। তবে বাকি ২৫ ক্যাডারের কর্মকর্তারা সিবিএর মতো মোর্চা তৈরি করে আন্দোলনে নেমে বিশৃঙ্খলা করছেন।’

ক্যাডার বৈষম্য দূর করার দাবিতে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ এরই মধ্যে ঢাকায় মহাসমাবেশ কর্মসূচি ঘোষণা করলেও এই সংগঠনটি মনে করছে সরকারের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম যে হুঁশিয়ারি দিয়েছে সেটি প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যেই দিয়েছেন।

আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদের সমন্বয়ক ড. মুহাম্মদ মফিজুর রহমান বলেন, ‘আমরা এ পর্যন্ত সরকারের সাথে কোনো দ্বন্দ্বে যাইনি, যাবও না। আমার মনে হয় যারা হুমকি দিয়েছে কটুকথা বলেছে, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনকে আল্টিমেটাম দিয়েছে, উপদেষ্টা তাদের উদ্দেশ্য করে হুঁশিয়ারি দিয়েছে!’

তিনি বলেন, ‘আমাদের বিশ্বাস, আমরা চাকরিবিধি লঙ্ঘন করিনি।’

আলোচনায় সমাধানের তাগিদ

পদ পদোন্নতি না বেশ কিছু দাবিতে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচির মধ্যে সরকারের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের হুঁশিয়ারির পর প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা নতুন করে কোনো কর্মসূচি পালন করবেন না বলে জানিয়েছেন। তবে, এখনো পর্যন্ত ঢাকায় মহাসমাবেশ কর্মসূচি পালনের ব্যাপারে অনড় বাকি ২৫টি ক্যাডারের কর্মকর্তারা।

জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পরিস্থিতিতে সরকারের কাজকর্মে ব্যাঘাত ঘটছে। তাই এই ইস্যুটি আলোচনার মাধ্যমে সমাধানেরও পরামর্শ দিচ্ছেন কেউ কেউ।

সাবেক সচিব আবু আলম শহীদ খান বলেন, ‘এ পর্যায়ে এমন কোনো কর্মসূচিতে যাওয়া যাবে না, যা সরকারকে বিব্রত করে। তা কোনো পক্ষেরই নেয়া উচিত হবে না। এটা আলাপ আলোচনার মধ্যে দিয়ে সমাধান করা উচিত।’

বিধান অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যায়, তবে এখনই তা না করে বিকল্প উপায়ে সমাধানের কথা বলছেন জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা।

জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ফিরোজ মিয়া বলেন, ‘ক্যাডার সার্ভিসের লোকেরা তাদের প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে এগুলো সার্ভিস শৃঙ্খলা পরিপন্থী। কারণ একজন ক্যাডার কর্মকর্তা এই ধরনের আচরণ করতে পারেন না।’

তাহলে এক্ষেত্রে সমাধান কী? এমন প্রশ্নে ফিরোজ মিয়া বলেন, ‘সরকার উভয় পক্ষকে কড়া বার্তা দিতে পারে, এই কাজ বন্ধ না করলে সরকার তাদের বিরুদ্ধে আইনিব্যবস্থা নিতে পারে। সরকার কঠোর বার্তা দিলে তারা এ থেকে বিরত থাকতে পারেন।’

তবে আগামী ৩ জানুয়ারি ঢাকায় ২৫টি ক্যাডার কর্মকর্তাদের কর্মসূচি ঘিরে এক ধরনের উত্তেজনা দেখা যাচ্ছে।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement
সমালোচনার মুখে যোগদান করেননি রাবির ২ সহকারী প্রক্টর সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় সোয়া কোটি ব্যক্তিকে সেবা দেয়া হচ্ছে : প্রধান উপদেষ্টা একবার ব্যবহারযোগ্য সব ধরনের প্লাস্টিক পণ্য নিষিদ্ধ করল দুবাই ফরাসি সেনাবাহিনীকে দেশ ছাড়তে বলল আইভরি কোস্ট দীপ্ত টিভির কর্মকর্তা তামিম হত্যা : প্লেজেনের সিইওসহ ২ জন কারাগারে আগামীর পৃথিবী তরুণদের হাতে : মঈন খান তৃতীয়বারের মতো এআইপিএসের বর্ষসেরা আর্জেন্টিনা রাবিতে ১ শতাংশে নামল পোষ্য কোটা সচিবালয়ে আগুনের তদন্তে সন্তুষ্ট সরকার বাংলাদেশে পরমতসহিষ্ণু রাজনীতির ধারক ও বাহক জাতীয় পার্টি : মোস্তফা সস্ত্রীক সাবেক ডিএমপি কমিশনার ফারুকের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

সকল