২১ নভেম্বর ২০২৪, ৬ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

জী ব নে র বাঁ কে বাঁ কে

-

আবছা আবছা মনে পড়ে এক শুক্রবারের বিকেলের কথা। মধ্যপাইকপাড়ার এক বাসায় গোল হয়ে ১২ জন ভদ্র মতো আপু বসেছিলেন। আপু বৃত্তের কেন্দ্রে একটি ট্রে। পিরিচে মাল্টা কাটা আর বাটিতে চানাচুর মাখা। প্রায় সবার সামনে ডায়েরি।
এ ধরনের গেট টুগেদারকে হালাকা বা তাফসির প্রোগ্রাম বলে। দারস হচ্ছিল সূরা মাউনের। সেদিন সেই তাফসির ক্লাসে আমাকে নিয়ে গেল আমার বোন যুননুন। আমি সবার সাথে বসলাম। দেখলাম একটি সুন্দর মতো বড় আপু কথা বলছেন। সত্যি বলতে, কথার চেয়ে বেশি খেয়াল করতাম হিজাব পরা! তখন আমি নতুন চার কোনা হিজাবকে তিন কোনা করে তিনটি সেফটিপিন দিয়ে পরার কানুন শিখছি বোন যুননুনের কাছ থেকে। যদিও বিশেষ আয়ত্ত করতে পারিনি তখনো। এক টুকরো কাপড় আমাকে কুপোকাত করে ফেলে। তাফসির ক্লাসের সেই আপুটা এক্কেবারে প্রফেশনালদের মতো টিপটপভাবে হিজাব পরা ছিলেন। যারপরনাই পরিপাটি একজন মানুষ। তিনি আস্তে ধীরে, সুন্দর গল্প দিয়ে, রূপক দিয়ে, বাস্তব ঘটনা দিয়ে সূরা মাউনের অর্থ বুঝিয়ে দিলেন। আর তিনি আমাদের বিনু আপু। গুছিয়ে কথা বলাও যে একটি আর্ট- প্রেজেন্টেশন স্কিল বলতেও যে আলাদা কোনো বিষয় আছে, প্রথম বুঝেছি বিনু আপুর কথা শুনে। আপুর কখনোই অ্যাটেনশন সিক করতে হয় না, সবাই এমনিতেই চুপ হয়ে যায় আপু কথা শুরু করলে।
আমি গান গেয়েছি বিনু আপুর উসিলায়।

আপুদের গাড়িতে চেপে গানের রিহার্সেলে যেতাম। দূর কলাবাগান, আমি পড়ি ক্লাস সেভেনে। আম্মু তো ইহজীবনেও একা যেতে দেবেন না। মাত্র স্কুলফেরত আমি হুলুস্থূলে কয়েক লোকমা ভাত গিলে দৌড়ে আনসার ক্যাম্প চলে যেতাম। আপু সেখান থেকে পিক করত আমাকে। এক্সাইটিং দিনকাল আর কাকে বলে! সমস্ত দিনের যাবতীয় আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু ছিল দুপুর বিকেলের এই সময়।
আপুদের গাড়িতে পুরান দিনের সাইমুমের গান বাজত। পাশাপাশি আপুও গুনগুন করতেন! ভাবতাম, আপু কি ১০০টা গান গাইতে জানেন! জিজ্ঞেস করতেন, ‘এই গানটি পারো জাহরা?’ আমি তো পারি না?আমার কাছে আপুর গান-কথা, আপুর হিজাব পরা সব কিছুই ম্যাজিকাল লাগত! তখন আবার নাকে মুখে হুমায়ূন পড়তাম। আমি ভাবতাম, বিনু আপু হুমায়ূন আহমেদের নায়িকা-ইসলামিক ভার্সন!
একবার আমার স্কুল থেকে ফিরতে দেরি হলো। বেশ ভালোই দেরি। খেয়ে গোছল করে আনসার ক্যাম্প আসতে আসতে আপুদের গাড়ি আমার জন্য অনেকটা সময় অপেক্ষা করে কলাবাগানের দিকে চলে গেছে। দেরিতে গেলে নতুন গান ধরা যায় না- সময় পাওয়া যায় না। দোষ পুরোটাই আমার, আমি দেরি করেছি। কিন্তু বয়স কম ছিল তাই হয়তো বেশিই মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। ফোনে আপু জানালেন, তারা অনেক দূর চলে গেছেন। আমার গলার স্বর কান্নাকান্না হয়ে গেল। সত্যি বলতে, বয়স আরেকটু বেশি হলে কখনোই এমন করতাম না।
বাসায় ফিরে এলাম। কাপড় ছাড়তে ছাড়তে আবার আরেকটি ফোন এলো। ‘জাহরা, দ্রুত আনসার ক্যাম্পে আসো। আমরা গাড়ি উল্টো ঘুরিয়েছি।’
আমি তখন হতবাক, নির্বাক-খুশিতে ডগমগ, খুশির যত পদ প্রকরণ আছে তার সব!
ভোঁ দৌড়ে ফেরত গেলাম। আপুর সাথে রিহার্সেলে গেলাম। যথারীতি আমার জন্য আপুরও দেরি হলো। কিন্তু এ বিষয়ে পরবর্তীতে একটি শব্দও আপু আমাকে বলেননি।
কাঁধের উপর এ রকম মানুষগুলোর ঋণ নিয়ে ঘুরে বেড়াতে অন্য রকম আরাম লাগে!


আরো সংবাদ



premium cement