২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

বোকা জামাই

-


রতনের বিয়ের সবে ছয় মাস অতিক্রান্ত হয়েছে। নতুন জামাইয়ের তকমাটা এখনো ওর গা থেকে মুছে যায়নি। নতুন শ্বশুরবাড়িতে এখনো খুব বেশিবার যাওয়া হয়নি তার। বিয়ের পর সব মিলিয়ে স্ত্রী সুমিকে নিয়ে বার তিনেক শ্বশুরবাড়িতে গেছে সে। তাই জামাই আদর ভালোই পায় সে। খুব সহজ সরল একটি ছেলে রতন। গ্রাম্য পরিবেশে বেড়ে ওঠা রতনের মধ্যে কোনো চতুরতার ছাপ নেই। বোকাসোকা মতো একটা ভাব। খুব বেশি সাজিয়ে গুছিয়ে কথাও বলতে পারে না। সেজন্য পরিবার ও সমাজের বিভিন্ন স্থানে তাকে নানাভাবে হেয় প্রতিপন্ন হতে হয়।
আজকের তথাকথিত আধুনিক সভ্যসমাজে এ রকম সহজ-সরল নির্লোভরা যথাযোগ্য মর্যাদা পায় না। আদর সম্মান সবই এখন মেকি সভ্যদের দখলে। বিয়ের পর প্রথম শীত এটি। শ্বশুরবাড়ি থেকে শাশুড়ি জামাই মেয়েকে নিমন্ত্রণ করেছেন শীতের পিঠাপুলি খাওয়ার জন্য। নতুন জামাই বলে কথা। তা ছাড়া এটি বাঙালি সমাজের চিরায়ত একটি প্রথা। এই সময়টিতে গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে জামাই-মেয়েরা আসেন। শ্বশুর-শাশুড়িরা সাধ্যমতো আদর-আপ্যায়ন করে থাকেন। এ ছাড়াও পাড়া-প্রতিবেশীরা জামাই-মেয়েদের নিমন্ত্রণ করে খাওয়ান। গ্রাম বাংলার এই প্রথা যুগের পর যুগ ধরে এই চলে আসছে। অতিথিপরায়ণতায় বাঙালিদের সুনাম বিশ্বজোড়া।

পৌষপার্বণের ঠিক আগের দিন রতন ওর নতুন স্ত্রী সুমিকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ির উদ্দেশে রওনা হয়। স্ত্রী সুমির পরামর্শে রতন দু’হাত ভর্তি মিঠাই-মিষ্টান্ন, ফল-ফলাদি আরো অনেক কিছু নিয়ে সন্ধ্যার কিছু আগে শ্বশুরবাড়িতে পৌঁছে যায়। জামাই-মেয়ে শ্বশুরবাড়িতে আসায় সবাই বেশ খুশি। রাতে খাওয়া দাওয়া আপ্যায়নে বেশ সমাদর করা হয় জামাইকে। মাছ, গোশত, সবজিসহ অনেক রকম পদ। শেষপাতে দেয়ার জন্য সুস্বাদু মিষ্টি পায়েস তৈরি করেন শাশুড়ি। চিনি দিয়ে তৈরি পায়েস দেখতে সাদা ফেনা ভাতের মতো। রতনের মা বাড়িতে প্রায়ই ফেনা ভাত রান্না করেন। যা খেয়ে খেয়ে রতনের এক রকম অরুচি হয়ে গেছে। খাওয়া শেষে শাশুড়ি যখন রতনের পাতে ফেনা ভাতের মতো পায়েস দিতে গেলেন তখন রতন বোকা বোকাভাবে শাশুড়িকে বলল, না মা আমি এটি নেবো না। এটি আমার মা বাড়িতে প্রতিদিন রান্না করেন। রোজ রোজ খেয়ে খেয়ে আমার বিরক্তি এসে গেছে। আর ভালো লাগে না। নেবো না, নেবো না করতে করতে কিছুটা পায়েস রতনের পাতে পড়ে যায়। অজ্ঞতাবশত একটুখানি মুখে যেতেই এর স্বাদে অবাক হয়ে যায় রতন। এ তো সাধারণ ফেনাভাত নয়! এ যে অমৃতসম পায়েস। জীবনে সে কখনো এত সুস্বাদ পায়েস খায়নি। রাতে শুয়ে শুয়ে শুধু তার পায়েসের কথাই মনে হচ্ছিল। কিছুতেই এর স্বাদ ভুলতে পারছে না সে।

যেন মুখে একদম লেগে আছে। অনেক রাতে সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে ঠিক তখন রতন পায়েসের খোঁজে রান্নাঘরে ঢুকে হাঁড়িসমেত পায়েস অমৃতের মতো গ্রোগ্রাসে গিলতে থাকে। খাওয়ার সময় কোন দিকে যেন খেয়াল নেই তার। হঠাৎ হাত থেকে পায়েসের হাঁড়ি পড়ে যায়। হাঁড়ি পড়ার শব্দে সবার ঘুম ভেঙে যায়। বিড়াল ভেবে সবাই হেই হেই করতে করতে রান্নাঘরে এসে দেখে তাদের জামাই রতন কালিঝুলি পায়েস মাখানো মুখে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সবার চক্ষুস্থির। কী করবে বা কী বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না কেউ। এ যে ওদের জামাই। তাই নীরবে সবাই ঘরে চলে যায়। রতনের স্ত্রী সুমি এসে টানতে টানতে ওকে ঘরে নিয়ে যায়।
সবার সামনে লজ্জায় ওর মাথা হেট হয়ে গেছে। সারারাত ধরে স্ত্রীর কথার প্রহারে রতনকে নাজেহাল হতে হয়। তবুও রতনের মুখে কোনো কথা নেই। নির্বাক হয়ে শুধু স্ত্রীর কটুবাক্যগুলো হজম করে। মহা অন্যায় করে ফেলেছে যে সে। সকাল হতেই শ্যালক-শ্যালিকারা এ ব্যাপারটি নিয়ে ঠাট্টা তামাশায় মেতে ওঠে। কথাগুলো খুব গায়ে লাগে সুমির। একটু বেলা হতেই সমস্ত এলাকাতে হাস্যকর ব্যাপারটি ব্যাপকভাবে চাউড় হয়ে যায়। লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করে সুমির। সেখানে আর এক মুহূর্ত নয় রতনকে টানতে টানতে শ্বশুরবাড়ি চলে আসে সুমি। সেই থেকে বোকা জামাইয়ের হাস্যকর গল্পটি এলাকার সবার মুখেমুখে ফেরে।

 


আরো সংবাদ



premium cement

সকল