২১ নভেম্বর ২০২৪, ৬ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

খেজুর রসের স্মৃতি

-

শীতের সাথে যেন খেজুরের রসের এক চমৎকার মিতালী। মধুর সখ্য গড়ে উঠেছে। শীত ও খেজুর রস অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। কনকনে শীতের কুয়াশামাখা ভোরে এক গ্লাস ঠাণ্ডা কাঁচা রস এনে দেয় শরীরে সজীবতা। গ্রামের শীতের সকাল খেজুরের রস ছাড়া যেন জমেই না। গ্রামের পাকা রাস্তা ও মেঠোপথের দুই ধারে সারি সারি খেজুর বীথিকায় ঝুলতে থাকে মাটির হাঁড়ি। সে এক দারুণ দৃশ্য। স্বাদে-গন্ধে এক অতুলনীয় পরিবেশ। পাখিরাও তার স্বাদ থেকে বঞ্চিত হয় না। গাছের সাদা অংশে, মাটির হাঁড়িতে ঠোঁট ঢুকিয়ে চুকচুক করে পান করে নেয় মিষ্টি রস।

আমাদের তারানগর গ্রামের শহর আলী দাদার রস যে একবার খেতো, মজা পেতো, সে আর ভুলতে পারত না। বারবার ফিরে আসত তার রস খেতে। শৈশবের সব স্মৃতি এখনো জ্বলজ্বল করে ওঠে। শহর দাদা ছিলেন এক দক্ষ গাছি, চমৎকার ভঙ্গিতে মুগ্ধকর দৃশ্যের অবতারণা ঘটিয়ে গাছের পরিচর্যা করতেন। বাঁশের কঞ্চি দারুণ করে সাজিয়ে গাছগুলোতে বাঁধতেন সারি সারি মাটির কলস। বাদুড়ের উপদ্রব থেকে বাঁচতে গাছগুলোয় ঝোলাতেন টিনের ঝুড়ি। সুতা ধরে কিছুক্ষণ পরপর টান দিতেই বাদুড় দল দিতো উড়াল। এভাবেই কষ্ট করে স্বাদের রস সংগ্রহ করতেন শহর দাদা। সকাল হলেই সেই রস পান করার জন্য এলাকার ছোট-বড় সবাই লাইন ধরত। ঘুম থেকে উঠে আমিও চলে আসতাম। মানুষের পান-প্রতিযোগিতা দেখতাম। এতেই যেন তৃপ্ত হতাম। আমি তো ছোট, ছোটদের কাছে টাকা থাকতে নেই। তাই গাছের নিচে কেউ না থাকলে অন্য বালকদের সাথে আমিও হা করে থাকতাম এক দুই ফোঁটা মুখে পড়তেই সুমিষ্ট অনুভব করতাম। আহা; কী স্বাদ! কী অমৃত!

আরেক দিন সাহসী বড় ভাইকে নিয়ে গেলাম। বড় ভাই তো খাওয়া শুরু করলেন। একেবারে তৃপ্ত হয়েই নিঃশ্বাস ছাড়লেন। অতঃপর আমাকেও কয়েক গ্লাস পান করালেন। আহ; কী স্বাদ! কী মিষ্টি! এটিই ছিল জীবনের প্রথম খেজুর রস খাওয়া। যেন এখনো তার রেশ মুখে লেগে আছে। তখন থেকেই প্রতিদিন সকালে আম্মুকে ফাঁকি দিয়ে দুই ভাই মজা করে রস খেতাম। এভাবেই কয়েক সপ্তাহ কেটে যায়। কিন্তু আমার চিন্তা, ভাইয়া! টাকা দেবেন কোত্থেকে! কিভাবে দেবেন! তিনি আমাকে শুধু অভয় দেন। চুপ কর তুই, এত চিন্তা করিস না। মজা করে শুধু মধুর রস খা। চিন্তা না করার বিষয়টি পরে একদিন বুঝতে পারি। পশ্চিমপাড়া শাহাবুদ্দিন দাদার ধান ভাঙানোর মেশিন থেকে দুই ভাই ধান ভাঙিয়ে বাড়ি ফেরার পথে হঠাৎ দেখি, ভাইয়া শহর দাদার বাড়ি ওঠেন। দাদী কুলো নিয়ে বের হলেন। ভাইয়া! আমাকে বলে চুপ, কিছু বলবি না। একদম চুপ। বলেই বস্তা থেকে চাল বের করা শুরু করেন। দাদী ঝাড়তে থাকেন আর মাপতে থাকেন। এভাবেই একসময় পরিশোধ হয় রস খাওয়ার বকেয়া টাকা। আম্মু হয়তো এখনো জানেন না, লুকিয়ে চাল-বিক্রি কাণ্ড রস আস্বাদন গল্প। শীত আসলেই মনে পড়ে সেই স্মৃতিগুলো। কিন্তু এখন আর বেঁচে নেই প্রিয় শহর আলী দাদা ও তার খেজুর গাছগুলো। আল্লাহ তায়ালা তাকে দুধ ও মধুর নহরে রাখুন। তবে সেই দাদী এখনো বেঁচে আছেন।


আরো সংবাদ



premium cement