২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

সব ছেড়ে চলে যাব থাকব মায়ের আঁচলে

-

গ্রাম অপরূপ সৌন্দর্যের ছাপ যার সারা গায়ে! গ্রামের প্রতিটি স্থানই আমার কাছে একেকটি দর্শনীয় স্পট, আমাজন-সাজেকের চেয়েও আকর্ষণীয় স্পট। বিশ্বাস করুন, এই অতি ক্ষুদ্র জীবনে পড়াশোনার তাগিদ যদি না থাকত! তাহলে কোনো দিন পায়রা নদীর কোলঘেঁষা গ্রামটি ছেড়ে এই কংক্রিটের নির্দয় শহরে আসতাম না, কখনোই আসতাম না, জীবিকার তাগিদেও না।

বাল্যকালে ভাবতাম মানুষ কেমন করে নিজ জন্মভূমি ছেড়ে দূরে থাকে! আমি তো নিজ গ্রাম ছেড়ে পাশের গ্রামেও এক দিন থাকতে পারি না! মাধ্যমিকের পাঠ গুছিয়ে যখন ঢাকায় উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হওয়ার তোড়জোড় করছিলাম তখন শুধু একটি কথাই ভাবতাম- এই গ্রাম, গ্রামের পাশ দিয়ে বহমান ‘পায়রা নদী’, নদীতটে বাঁধা সারি সারি ডিঙি নৌকা, ফসলের মাঠ, হলদে সুপারিসহ দাঁড়িয়ে থাকা সুপারির বাগান, গ্রীষ্মকালে ধুলোয় ধূসরিত আর বর্ষাকালে কর্দমাক্ত মেঠোপথ, গ্রামের মানুষের সহজ সরল চেহারা, এসব ছেড়ে কীভাবে থাকব যান্ত্রিক শহর ঢাকায়?
কিন্তু এখন বায়ু ও শব্দদূষণের সূতিকাগার, যান্ত্রিক শহর ঢাকাই আমার ঠিকানা। যখন ঘুমাতে যাই কিংবা একটু চিন্তা করার ফুরসত পাই, এই মহা ব্যস্ততার নগরীতে আবার চিন্তা করার অবকাশও তেমন একটা পাওয়া যায় না! তখন আমার সব কল্পনা একত্র হয়ে চলে যায় আমার জন্মস্থান গ্রামের দিকে। তখন ভাবতে থাকি আমার টিনের ঘরের কথা, শীতকালে টিনের বেড়ার ফাঁক দিয়ে শিরশিরে ঠাণ্ডা হাওয়া ঢুকলে শীতে কুঁকড়ে-মুকড়ে যেতাম, বর্ষাকালে বৃষ্টির ঝমঝম বোলে ঘুমটা হতো কড়া, শ্রাবণের জলোচ্ছ্বাসে কখনো ঘরের মেঝেতে পায়রা নদী থেকে আগত ঘোলাটে পানিও দেখতে পেতাম, বন্যার পানির কারণে রান্নাও বন্ধ থাকত কখনো আবার গ্রীষ্মকালের প্রচণ্ড রোদে চালের টিন ঠা-ঠা করা ঝাঁঝালো গরমও মন্দ লাগত না আমার কাছে। এখন ঢাকাতেও বর্ষাকাল আসে, বৃষ্টি হয় কিন্তু ইট-পাথরের কৃত্রিম বিল্ডিংয়ের দেয়াল ভেদ করে বৃষ্টির আঁশ আমার পর্যন্ত পৌঁছে না। না পাই শীতের কুয়াশার কোনো অনুভূতি, না পারি কড়া রোদে বা গরমে পুরো শরীরে ঘামের স্রোত বহাতে। এখানে বর্ষা, শীত, গ্রীষ্ম সব মৌসুমই সমান। কোনোটার আলাদা কোনো অনুভূতি নেই। মনে পড়ে হাফেজ মহিব্বুল্লার জোরালো কণ্ঠের কুরআন পাঠক তিনি আমাদের মসজিদের ইমাম সাহেব, মনে পড়ে বার্ধক্যের ভারে নত রুস্তুম মুন্সিকে, যিনি দূর থেকে আমাকে দেখলেই দাঁড়িয়ে যান জড়িয়ে ধরেন বুকে, মনে পড়ে আ: গনি হাওলাদারকে, বাড়িতে গেলেই সুস্থতার দোয়া চাইতেন তিনি, আজ তিনি কবরে এ জন্য তার আর দোয়া চাওয়া হবে না আমার কাছে! এভাবে জেলে আ: খালেক বয়াতি, কৃষক আনিসুর মুন্সি, গ্রাম্য ডাক্তার মনিরুল, দোকানদার মোজাম্মেল- এদের কথাও কি কম মনে পড়ে! এলাকার বৃদ্ধ-জওয়ান-বালক থেকে শুরু করে এলাকার সব মাকেই মনে পড়ে। একেক সময় একেকজনের চেহারা ভেসে ওঠে চোখের সামনে। তখন বুকটা কেমন যেন ধক করে ওঠে।

সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে মাকে। সকালে ঘুম থেকে জাগানো, তিন বেলা খাবার খেতে ডাকা, সব কাজের কথা সময়মতো মনে করিয়ে দেয়া, আমার পোশাক-বই-ব্যাগ সব কিছুর অক্ষরে অক্ষরে খোঁজ রাখা- এগুলো সবই করতেন তিনি। এখন কেউ আমাকে সকালে খাবার খেতে ডাকে না, কাজের কথা মনে করিয়ে দেয় না, কোনো কিছুর খবর কেউ রাখে না! যখন বাড়িতে যাই মনে চায় আর ঢাকায় যাব না, মায়ের কাছেই থাকব। কিন্তু নিয়তির টানে ঢাকায় আসতে হয় পুনরায়। ঢাকায় ফেরার সময় মা পাশের বাড়ির বাঁশঝাড় পর্যন্ত এগিয়ে দিতে আসেন। এরপর মা দাঁড়িয়ে থাকেন বাঁশতলায়। আমি চলতে থাকি... দু’কদম সামনে গিয়ে পেছনে ফিরে দেখি মা ভেজা চোখ আঁচল দিয়ে মুছছেন। ধানক্ষেত, মেঠোপথ পাড়ি দিয়ে বাসস্ট্যান্ড বা লঞ্চঘাটের দিকে। বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত পাড়ি দিয়ে মেঠোপথে পৌঁছে আরেকবার তাকাই পাশের বাড়ির বাঁশঝাড়ের দিকে, দেখি মা এখনো ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছেন, হয়তো বা এখনো আঁচল দিয়ে ভেজা চোখ মুছছেন। এরপর নদীর কোল ঘেঁষে চলা সর্পিল আকৃতির মেঠো পথে হাঁটতে থাকি। তালুকদার বাড়ির মোড়ে এসে আরেকবার তাকাই মায়ের দিকে, দেখি এখনো তিনি দাঁড়িয়ে। মোড় ঘুরে বাম দিকের রাস্তাটিতে নামতেই আর বাঁশঝাড় দেখি না, দেখি না মাকে। তখন আমার চোখ দিয়ে মনের অজান্তেই অশ্রু ঝরা শুরু হয়। বাসে বা লঞ্চে আসতে আসতে কয়েক দফা অশ্রু বিসর্জন দেই আর ভাবি- কিছু দিন ঢাকায় থাকলে সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে। কিন্তু না, স্বাভাবিক হয় না, হয় নাই! আমি আজও কাঁদি, এখনো কাঁদি মা ও মাটির জন্য। কাঁদি আর ভাবি- ‘সব ছেড়ে চলে যাব, থাকব মায়ের আঁচলে।’


আরো সংবাদ



premium cement