২১ নভেম্বর ২০২৪, ৬ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

ঝুম বৃষ্টি ও হলুদ সোনালু ফুল

-

আমরা শৈশবে ইন্টারনেট ও আধুনিক ডিভাইস কোনো কিছুই হাতের নাগালে পাইনি। সত্যি বলতে আমাদের সেই অজপাড়া গাঁয়ে ইলেকট্রিসিটিই তো পৌঁছায়নি তখনো। নিয়মিত স্কুলে যাওয়া বাড়িতে এসে পড়তে বসা আর অবসর সময়ে টুকটাক দুষ্টমি আর গল্প করেই কাটত আমাদের দিন। বৃষ্টির দিনে প্রায়ই স্কুলে যাওয়া হতো না। ছাতা নেই বই ভিজে যাবে। বৃহৎ আকারের কচুপাতা, কলাপাতা আর পলিথিন ব্যাগ মুড়ি দিয়ে যে দু-একজন স্কুলে যেত তারাও রক্ষা পেত না পিছলে পড়া থেকে। সে এক ভিন্ন দিনের গল্পই বটে।

এমনই এক বৃষ্টির দিনে দুপুরের খাবারের পর মা প্রচণ্ডরকম ধমক দিলেন ঘুমানোর জন্য। সকাল থেকেই বৃষ্টি হচ্ছে। কখন থামবে তার নাম নিশানাও নেই। এই বৃষ্টির দিনে সারা দিন শুয়ে বসে কাটানোর পর আমার যে মোটেই ঘুম আসছে না সেটা মাকে কী করে বোঝাই। তাছাড়া মায়ের কথা অমান্য করার সাহসও ছিল না তখনো। বাধ্য হয়ে জানালার পাশ ঘেঁষে শুয়ে পড়লাম। আমি শুয়ে শুয়ে তাকিয়ে আছি বাহিরের দিকে। আমাদের ঘরের সামনেই ছোট উঠান। তারপর রাস্তা এবং রাস্তার পাশ ঘেঁষেই গরু ঘর। এই বৃষ্টি বর্ষার দিনে গরুগুলোরও বেহাল দশা। বাইরে বের করার সুযোগ নেই। তখনো বৃষ্টি হচ্ছে। কি সুন্দর ছন্দের তালে, কোন সে দূর মেঘ হতে পড়েই যাচ্ছে একের পর এক। যেন তাদের পতনে কোনো ব্যত্যয় নেই। প্রতিটি বৃষ্টি ফোঁটাই যেন যথাযথ সুশৃঙ্খল। এই বৃষ্টির ভরদুপুরে কেউ বাড়ির বাইরে নেই। তাই রাস্তা দিয়ে কেউই যাওয়া-আসা করছে না। রিমঝিম বৃষ্টির আওয়াজে আমাদের ঘরের সবাইই তখন ঘুমে বিভোর। আমার তবুও ঘুম আসছে। বৃষ্টি না হলেও হয়তো আমি এখানেই বসে থাকতাম। জানালার পাশে বসে তাকিয়ে থাকতাম দূরে কোথাও। এমনটা প্রায়ই হতো। আমার তো তেমন কিছুই করার মতো ছিল না। তাছাড়া আমি ছিলাম পুরোদস্তুর ঘরকুনো। এখন যে নেই তাও কিন্তু নয়। এই একটা দোষের কারণে কত যে বকা শুনেছি তারও হিসাব নেই।
শোয়া হতে উঠে বসলাম। জানালা দিয়ে আমার ছোট হাত দুটো বের করে দিলাম বৃষ্টি ছোঁয়ার জন্য। সেই নির্জন বৃষ্টির দুপুরে আমি ইচ্ছা মতো বৃষ্টিতে ভিজালাম দুই হাত। আর মন ভরে দেখতে লাগলাম সুন্দর প্রকৃতি।

পরের দিন সকালে বৃষ্টি হয়নি। তবে আকাশ ভীষণ মেঘলা। যেকোনো সময়ই হুটহাট বৃষ্টি নামতে পারে। সত্যি বলতে কি এমন দুর্যোগময় দিনে ছাত্ররা দূরে থাক স্কুলের শিক্ষকরাও ক্লাসে আসতেন না ঠিক মতো। আগেই বলছি অজপাড়া গ্রাম। কার খবর কে রাখে। সে দিন স্কুল ছুটি হলো দুপুর ১টার আগেই। বাড়িতে এসেই গোসল করার জন্য খালে নেমে পড়লাম। শুধু গোসল নয় রান্নাবান্না থেকে শুরু করে আমাদের দৈনন্দিন সব কাজই খালের পানি দিয়ে করা হতো। আর খাওয়ার জন্য ছিল স্কুলের পাশের টিউবওয়েলের পানি। গোসল করতে নেমেই দেখি উত্তর-পশ্চিম আকাশে ভীষণ কালো মেঘ। হালকা হালকা বাতাস বইছে। মনে হলো তখনই শুরু হবে কালবৈশাখী তাণ্ডব। সে এক ভয়ঙ্কর অবস্থা। হঠাৎই চোখে পড়ল সব খাল হলুদ পাপড়িতে ভরে গেছে। আমি তো ভীষণ অবাক। হঠাৎই ফুলের বৃষ্টি শুরু হলো না তো। কোথাও তো ফুল গাছ নেই। এই ফুল এলো কোত্থেকে। একটু পরেই ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়। আমি উঠে ঘরে চলে আসি।
বিকেলে বৃষ্টি কমলে আমি খুঁজে পেলাম। আমাদের বাড়ি হতে কয়েকটি বাড়ি পরে খালের লাগোয়া একটি ‘সোনালু ফুল’ গাছ। সে দিন বাতাসে খালের পানিতে ঝরে পড়ছিল হলুদ ফুলগুলো। তখন তো নাম জানতাম না। গ্রাম্য ভাষায় কি নাম ছিল সেটাও ভুলে গেছি। তারপর থেকে প্রায়ই খেয়াল করতাম। খালের ভরা পানিতে ভেসে যাচ্ছে কিছু চকচকে হলুদ সোনালু ফুল।


আরো সংবাদ



premium cement