২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

যেখানে আঁকা হয় যাপিত দিন

যেখানে আঁকা হয় যাপিত দিন -

ডায়েরি জীবনের পরম বন্ধু। স্মৃতির বিশ্বস্ত দর্পণ। যেখানে জমা রাখা হয় ফেলে আসা দিনের সাতকাহন। লিখে রাখা হয় যাপিত জীবনের গল্প। চিত্রায়িত করা হয় বিষাদময় জীবনের দীর্ঘশ্বাস। জীবনের সুখের হিল্লোল, অপার মুগ্ধতার রেশ, জোছনাপ্লাবিত রাত, ঘন বৃষ্টির বিকেল, সুনসান নীরবতায় ছাওয়া শীতের সন্ধ্যা সব কিছুর কথাই ডায়েরিতে ঠাঁই পায়। লিখে রাখা হয় ডায়েরির বুকে এলোমেলো অক্ষরে মনের মাধুরি মিশিয়ে। কিছু দিন পর যখন ধূলির আস্তরণ সরিয়ে পুরনো ডায়েরিটা খোলা হয় তখন কাঁচা হাতের ধূসর স্মৃতির লেখাগুলো চোখের তারায় ভেসে ওঠে ঝকমকিয়ে। কখনো আনন্দের উচ্ছ্বাসে ভেসে ওঠে মন। কখনো বিষাদের গল্প পড়ে হৃদয় ভেঙে যায় বেদনায়। তবুও মানুষ ডায়েরি লিখে। পরম বন্ধু বানিয়ে রাখে নিত্যদিনের লেখা ডায়েরিকে। যেখানে জমা হয় তার জীবনের দুঃখ-বেদনার সাতকাহন।
ছোট থেকেই ছিলাম একটু দস্যু প্রকৃতির। সারা দিন বনবাঁদাড়ে ঘুরে ফেরাই ছিল তখনকার দিনের বড় নেশা। কিতাব বিভাগের শিক্ষকরা আমার চঞ্চলতা ও দস্যিপনা কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিলেন। বিশেষ করে আমাদের প্রিয় শিক্ষক ময়মনসিংহের উস্তাদ। আমার মেধাটা যাতে বিফলে না যায়। হেলায় খেলায় নষ্ট না করে দিই সে জন্য তিনি অনেক কিছুই করেছেন। তিনিই আমাকে হাতে-কলমে ডায়েরি লেখা শিখিয়েছেন। নিজের টাকা দিয়ে খয়েরি রঙের ঝকঝকে একটি ডায়েরি কিনে দিয়েছিলেন আর বলেছিলেন, ‘এখানে সারা দিনের কেচ্ছা-কাহিনী লিখবি। সারা দিন যা যা ঘটে নিজের ভাষায় এখানে তুলে ধরবি।’ আমিও সুবোধ বালকের মতো মাথা নেড়ে মেনে নিলাম। কিন্তু, লেখা কী এতই সহজ! কোনোভাবেই লেখা আসত না। লেখা আসবে কোত্থেকে! আমি তো তখন কিছুই জানতাম না। না জানতাম শব্দ, না বাক্য গঠন। সব কিছুতেই কাঁচা। মাঝে মধ্যে শিক্ষক খাতা নিয়ে চেক করতেন। কি লিখেছি! কেমন লিখেছি।

সম্ভবত সময়টা তখন করোনাকালীন। সবাই ঘরবন্দী। তখই শুরু হয় আমার ডায়েরি লেখার নতুন অধ্যায়। এর আগে লিখলেও টুকটাক লেখা হতো অনিয়মিতভাবে। ধারাবাহিকতা ঠিক থাকত না। কিন্তু দীর্ঘ দিনের করোনা সময়ে প্রতিদিনই লেখা হতো ডায়েরির পাতায়। শিশিরে ভেজা ঘাস, শূন্যতায় খাঁ খাঁ করে ওঠা মাঠ, ডাহুকের ডাক, দোয়েল-কোয়েলের কিচিরমিচির, সকাল-সন্ধ্যায় পাখিদের ডানা ঝাপটানোর সিম্ফনি, বর্ষায় গলা ভরা নদী, থইথই জলরাশি, নদীর ঘাটের ডিঙি নৌকা, মাঝির সুফিগানের সুর, কৃষকের ঘাম ঝরানো খাটুনি, সন্ধায় দাদাদের গঞ্জ থেকে প্রত্যাবর্তন। কামলাদের হাতে আতপ চালের পোটলা, মায়ের রান্নাবান্না সব কিছুর কথাই লিখে রাখতাম ডায়েরির সাদাটে পাতায়। কী যে ভালো লাগত তখন। কারণ, দু’কলম লিখতে পারার যে সুখ তা শুধু যারা লিখিয়ে তারাই বুঝতে পারবে। এখনো তো এমন হয় পুরনো ডায়েরিগুলো খুলে ধরলে কখনো আনন্দে চিকচিক করে ওঠে মন। কখনো শোকে, ক্লিষ্টে চোখ থেকে খসে পড়ে বেদনার তপ্ত জল। কখনো আশ্চর্য্যরে সাথে নিজে নিজেই বলে উঠি- এমন করে লিখতে পারতাম আমি! এই স্মৃতি কবেকার! সত্যিই ডায়েরি লিখলে জীবনের অনেক কিছুই সংরক্ষিত থাকে। স্মৃতি হাতড়িয়ে বাঁচা যায় দীর্ঘ জীবন। স্মৃতির পাতা থেকে খুঁজে নেয়া যায় মুঠো মুঠো সুখরাশি।


আরো সংবাদ



premium cement