২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

আমার এক প্রতিবন্ধী বোনের আত্মকথা

আমার এক প্রতিবন্ধী বোনের আত্মকথা -

আমরা এক ভাই চার বোন। দুই বোন আমার বড়। বাকি দুই বোন আমার ছোট। বড় দুইজন জেনারেল লাইনে পড়ালেখা করেছে। আর সেজো বোন মাদরাসা থেকে হিফজ শেষ করেছে। আমার তিন বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। ছোটজন এখনো অবিবাহিত। তার নাম ছুমাইয়া। দেখতে খুবই সুন্দর। যে কেউ দেখলে পছন্দ করে ফেলবে। ওর আকার আকৃতি, গঠন-প্রকৃতি দেখলে বুঝতেই পারবে না যে, ও একজন মানসিক প্রতিবন্ধী। ওর সমস্যা হলো- স্পষ্টভাবে কথা বলতে পারে না এবং জ্ঞান-বুদ্ধি খাটিয়ে কোনো কাজ করতে পারে না। বরং স্মৃতিবিভ্রাট বিভিন্ন কাজ করে ফেলে।
যা স্বাভাবিক একজন সুস্থ মস্তিষ্কের অধিকারী মানুষ করতে পারে না। এমন সব কাজ সে করে ফেলে। এ পর্যন্ত চিকিৎসার জন্য ওকে নিয়ে অনেক দৌড়ঝাঁপ করেছি, তবে কোথাও কোনো প্রতিকার পাইনি। বরং সর্বত্র ব্যর্থই হয়েছি। জন্মগত সমস্যা সারিয়ে তোলার ক্ষমতা কার রয়েছে? একমাত্র আল্লাহ ছাড়া!
আমার বাবা একজন সরকারি চাকরিজীবী। তিনি ওর জন্য স্বতন্ত্র অ্যাকাউন্ট করে টাকা জমা রেখেছেন। সরকারিভাবে প্রতি মাসে ওর জন্য প্রতিবন্ধী ভাতাও নির্ধারিত রয়েছে। সবচেয়ে আশার কথা হলো, বাবার ইন্তেকালের পর চাকরির সম্পূর্ণ বেতন আমার বোন পাবে। আলহামদুলিল্লাহ। একজন প্রতিবন্ধী সন্তান প্রতিপালন করা কত কঠিন, তা কখনো কাউকে ভাষায় বোঝানো সম্ভব নয়। শুধু জন্মদাতা মা বলতে পারেন। সারাটি জীবন এই প্রতিবন্ধীকে নিয়ে কষ্ট করতে হয়। কোথাও যেতে একে নিয়ে টানাহেঁচড়া করতে হয়। খাইয়ে দেয়া, গোসল পর্যন্ত করিয়ে দিতে হয় এই প্রতিবন্ধীকে। এমনকি টয়লেট করার বুঝ-জ্ঞানও একজন প্রতিবন্ধীর থাকে না। শুধু এতটুকুই নয়! বরং এই প্রতিবন্ধীকে নিয়ে কোথাও যাতায়াত করা যে কত কষ্টসাধ্য ব্যাপার, তা কেবল একজন প্রতিবন্ধী সন্তানের মা বলতে পারবেন। যখন আমার প্রতিবন্ধী বোনকে নিয়ে মা কোথাও রওনা করেন, আশপাশের লোকজন ভিন্ন নজরে তাকিয়ে থাকে। অবাক পলকে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে।
গাড়িতে ওঠানামার বেলায় অনেক বেশি কষ্ট পোহাতে হয়। এত সবের পরও আমার মা কখনোই ওর প্রতি বিতৃষ্ণা হয়ে পড়েন না। অবজ্ঞা আর তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখেন না। জীবন মানে প্রতিটি মানুষের এক পরীক্ষার স্থল। এখানে পরীক্ষার মাধ্যমে প্রতিটি মানুষকে পরকালের নাজাতের মাধ্যম গ্রহণ করতে হবে। প্রতিটি মানুষের পরীক্ষার বিষয়বস্তু এক রকম নয়। বরং ব্যক্তিভেদে প্রত্যেকের পরীক্ষার বিষয়বস্তু আলাদা আলাদা। কারো জীবনে কষ্টের লেশমাত্র নেই, তাদের জীবনে ধনসম্পদের কোনো কমতি নেই, টাকা-পয়সার রয়েছে যথেষ্ট আস্তানা!
তাদের জীবনে পরীক্ষার বিষয়বস্তু হবে এসব ধনসম্পদ ও টাকা-পয়সা। আবার আরেকজন মানুষের জীবনে গরিবানা অবস্থা জায়গা করে নিয়েছে। সারা জীবন কষ্টই তার ঠিকানা। এমন সব সামানাই তার পার্থিব জীবনের পরীক্ষার বিষয়বস্তু। আবার কারো কারো জীবনে প্রতিবন্ধী সন্তানের মাধ্যমে চলতে থাকে পরীক্ষা। আমার সেই প্রতিবন্ধী বোনের বিয়ে ঠিক হয়েছে।
আগামীকাল তার বিয়ের তারিখ। একজন বুঝমান সচেতন ছেলের সাথেই তার বিয়ে ঠিক হয়েছে। ছেলেটি অবশ্য আর্থিকভাবে একটু গরিব। সে সব কিছু জেনেবুঝে আমাদের সাথে আত্মীয়তা করার বিষয়টি মেনে নিয়েছে। আর আমরাও বোনের জীবন ও নিজের সতিত্বের দিক বিবেচনা করে রাজি হয়েছি।
বোনের বর্তমান বয়স উনিশ ছুঁই ছুঁই। ওর জন্য সবাই দোয়া করবেন। যাতে ওদের দাম্পত্য জীবন সুখময় হয়। আল্লাহুম্মা আমীন।


আরো সংবাদ



premium cement