২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

ভোরের কান্না

-

তখন মধ্য দুপুর। আকাশে কিঞ্চিত মেঘ করেছে, কিন্তু এখনই বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। মেঘের ছায়ায় রোদের তাপ কিছুটা কমেছে। তাই হাঁটতে একটু আরাম লাগছে। প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে হেঁটে চলেছে তুষার। ঘেমে একাকার অবস্থা। পথে একটি চায়ের দোকান থেকে এক গ্লাস পানি খেয়ে আবার হাঁটা শুরু করল। রাস্তা যেন শেষ হতে চায় না। প্রচণ্ড ক্লান্তিতে ঝিমিয়ে আসে শরীর। কিন্তু কোনো উপায়ও নেই, হাঁটতেই হবে।
গন্তব্যে পৌঁছে তুষার দেখে তিয়াশা তার জন্য অপেক্ষা করছে। একপলকে থমকে যায় দু’চোখ, একদৃষ্টে চেয়ে থাকে ওর দিকে। গুনে গুনে ১৩ দিন পর তিয়াশার সাথে দেখা হলো তুষারের। কি জানি, হয়তো এটিই শেষ দেখা। ঘামার্ত শরীরে পরিশ্রান্ত তুষারকে দেখে তিয়াশা জিজ্ঞেস করে, এ কী অবস্থা তোমার?
তুষার কোনো উত্তর দেয় না। ব্যাগ থেকে টিস্যু বের করে তুষারের মুখের ঘাম মুছে দেয় তিয়াশা। মেয়েটা তাকে অসম্ভব ভালোবাসে। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে শত কষ্ট, ব্যথা ভুলে থাকা যায়। সে পাশে থাকলে হাজার বছর বাঁচতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু সেটা বোধ হয় সম্ভব হবে না। ওরা আজ দু’জন দু’জনকে বিদায় বলতে এসেছে।
তিয়াশার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। সামনের সপ্তাহে বিয়ে। ছেলে কানাডায় থাকে। বিদেশে চলে যাওয়ার প্রবল ইচ্ছা আর বাড়ির জোরাজুরিতে তিয়াশা ‘না’ করতে পারেনি। চোখের সামনে এমন ঝকঝকে ভবিষ্যৎ রেখে কোন পাগলে চাইবে সদ্য প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি পাওয়া ছেলেকে বিয়ে করতে। হয়তো তিয়াশা ভুলটা করতে চায়নি। তাই হাসিমুখে তিন বছরের ভালোবাসার সম্পর্কের উপসংহার লিখে ফেলেছে।
তুষারের অবচেতন মনের এসব ভাবনার মাঝে হঠাৎ তিয়াশা বলে, এই নাও, তোমার পছন্দের খেজুরের গুড়ের পায়েস। আজ আমি নিজে রান্না করেছি।
তুষার পায়েসের বাটিটা পাশে রাখে। তিয়াশা বায়না করে ওর সামনেই খাওয়ার জন্য। তুষার বলে, আর মায়া বাড়াতে চাই না। বাসায় গিয়ে খেয়ে নেব।
তিয়াশা আর কিছু বলে না। তুষারও চুপচাপ।
মেঘ একটু একটু করে বাড়ছে। সময় গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেছে। বৃষ্টির আশঙ্কায় মানুষের আনাগোনাও কমে যেতে শুরু করেছে। নীরবতা ভেঙে তুষার বলে, তোমার ফ্লাইট কবে?
সামনে ২৫ তারিখ।
তুমি তো একা থাকতে ভয় পাও। বিদেশে একা থাকবে কিভাবে?
একা কোথায়! শ্বশুর-শাশুড়ি তো আছেন।
সত্যিই তো। একা কেন হবে! একা তো সে নিজে। এই জগত সংসারে তার মতো একা কে আছে। আপন বলতে যে ছিল, সেও আজ...।
তুষার দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তার জীবনে একেক করে সব কিছু শেষ হয়ে যাচ্ছে। সৎমায়ের সংসারে টিকতে না পেরে শহরে চলে আসে। অনেক পরিশ্রম করে পড়ালেখা শেষ করেছে। তিন মাস আগে একটি চাকরি পেয়েছিল, তাও চলে গেছে মাসখানেক আগে। সমাজের ভাষায় সে এখন শিক্ষিত বেকার।
ধারদেনা করে কিছুদিন চলেছে। এখন সেই অবস্থাও নেই। গত পাঁচদিনে দু’টি টোস্ট আর আড়াই শ’ মুড়ি খেয়ে আছে। ক্ষুধার তীব্র জ্বালা পেটে নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে চাকরির জন্য। এই শহরে তার কোনো মামা-চাচা নেই, তাই আর চাকরিও জোটে না।
জীবনের ওপর চরম বিরক্তি আর হতাশা চলে এসেছে তুষারের। বেঁচে থাকার সব ইচ্ছাই সে হারিয়ে ফেলেছে। গত তিন রাত সে একটুও ঘুমোতে পারেনি। গভীর রাতের দুশ্চিন্তা আর চোখের জলের স্রোত বয়ে চলছে সকাল অবধি।
আকাশ কালোমেঘে ঢেকে গেছে। তিয়াশাকে এবার বিদায় বলতেই হচ্ছে। যাবার বেলায় শুধু একবারই পিছু ফিরে তাকাল।
পিছুটান ভুলে আবার হাঁটতে শুরু করে তুষার। বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। তিয়াশার দেয়া পায়েসের বাটিটা নিয়ে ভিজতে ভিজতে হেঁটে চলছে। হঠাৎ একটা গাড়ি এসে পেছন থেকে ধাক্কা দিয়ে বসে। বাটিটা হাত ছিটকে পড়ে যায়। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে থাকে তুষার। তার এবেলাতেও খাওয়ার মতো কিছু থাকল না।
কাকভেজা শরীরে যখন বাসায় ফিরে এলো ততক্ষণে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আসার পথে অনেক সাধের মোবাইলটা বিক্রি করে সব ধার শোধ করে এসেছে। পকেটে পড়ে থাকা শেষ ১০টি টাকা দিয়ে কিনেছে বিষ। রঙিন জীবনের এমন নির্মম বাস্তবতা তাকে আত্মহননের পথ বেছে নিতে বাধ্য করল। কতদিন হয়ে গেল পেটভরে কিছু খায়নি সে। একটু পেটভরে ভাত খাওয়ার জন্য তার আকুলতা দুর্ভিক্ষকে বুঝি হার মানাবে।
কিন্তু, এটি তো ছিয়াত্তরের মন্বন্তর কিংবা শিল্পাচার্যের আঁকা ছবির ‘৪৩ নয়, নয় এটা উনিশ’শ চুয়াত্তরও। তাহলে কেন ক্ষুধার যন্ত্রণায় কাতর হয়ে তিলে তিলে শেষ হওয়া তুষাররা নিজেদের চিরতরে শেষ করে দেবে!
বলা হয়ে থাকে, ভোরবেলা নাকি মানুষ কাঁদতে চায় না। অশ্রুসিক্ত নির্ঘুম তিমির রাতগুলোও চায় আঁধার পেরিয়ে পরের সকালটা হোক আলোকিত, শুরু হোক নতুনের উদ্যম। বেদনার সমুদ্র পেরিয়ে রাতের সব কালোর সাথে চোখের জল মুছে ফেলে, আবার বুক চিতিয়ে লড়াই করার হুঙ্কার, সাহস দিয়ে যায় একটি সকাল। কিন্তু, কিছু স্বপ্ন ভোরের আলোতেই নিভে যায়। ফুঁঁপিয়ে ডুকরে কেঁদে বালিশ ভেজানো কান্নার রেশ যখন রয়ে যায় সকাল পর্যন্ত, প্রভাতের রক্তিম আভাও যখন দেখাতে পারে না আলোর দিশা- স্বপ্ন দেখা তখন বিলাসিতা। ভোরের কান্না জীবনকে শোনায় অন্য গল্প, যে গল্পের শেষটা এমনই।

 


আরো সংবাদ



premium cement