অধরা স্বপ্নের নির্মম মৃত্যু
- হাসান জুনাঈদ
- ০৩ জুলাই ২০২২, ০০:০০
নদীর পাড়ের মানুষদের জীবনটা বড় সংগ্রামের। নদীর সাথে সংগ্রাম করেই বেঁচে থাকে তারা? উত্তাল ঢেউয়ের বুক কাঁপানো গর্জন ত্রাসের সৃষ্টি করে জনমানুষের মনে। এ বুঝি ভেঙে যাবে পাড়টা। ভাসিয়ে নিয়ে যাবে ঘরবাড়ি। নদীতে তলিয়ে যাবে বাপ-দাদাদের স্মৃতিচিহ্নটুকু। রাক্ষুসী নদীটার এ ভাঙন-ভাঙন খেলা, বিষিয়ে তুলেছে ছগির মাঝির জীবন। ভয়, শঙ্কা আর উৎকণ্ঠায় জীবন হয়ে উঠেছে বিভীষিকাময়। তবু তার নদীর পাড়েই থাকতে হয়। না থেকে উপায় কী? যাবে কোথায় সগির মাঝি? ভিটেমাটি বলতে ওই পাড়ের জায়গাটুকুই। সেই ছেলেবেলায় নয়নপুর থেকে এখানে এসেছিল বাবার সাথে। তারপর আর যাওয়া হয়নি কোথাও। এখানেই কাটিয়েছে শৈশব, কৈশর আর যৌবনের উচ্ছল-প্রাণবন্ত সময়। এখন তার প্রৌঢ় বয়স। নদীর পাড়ের এ জায়গাটার সাথে কেমন একটা মায়া জড়িয়ে গেছে তার। তাই কোথাও যেতেও ইচ্ছে করে না।
২.
এক ছেলে, এক মেয়ে আর স্ত্রীকে নিয়ে ছোট্ট সংসার তার। বয়সের ভারে নুব্জ্য মাঝি আর নৌকা বাইতে পারে না। পারে না মাছ মারতেও। তাতে কী? তার ছেলেই এখন নৌকা বায়, মাছ মারে। এতেই চলে যায় তাদের সংসার। তবে ক’দিন ধরে অসুখে পেয়েছে সগির মাঝির ছেলেটাকে। তাই নদীতে যেতে পারছে না। বন্ধ হয়ে গেছে মাছ শিকার। খাবারের ব্যবস্থাও নেই কোনো। উনুন জ্বলছে না ঘরে। কিন্তু এভাবে আর ক’দিন? এমন করে তো আর সংসার চলে না। তাই সগির মাঝিই নদীতে যেতে চাইল। নৌকা বেয়ে কিংবা মাছ শিকার করে যদি কিছু টাকা আয় করা যায়, সেটাই বা মন্দ কিসে?
ভাবনার ঘোর কাটতেই, জাল আর নৌকা নিয়ে নদীতে নেমে পড়ল সগির মাঝি।
৩.
নৌকাটা মাঝির নিজের হলেও জালটা তার ধার করা। পাশের বাড়ির করিম মাঝির কাছ থেকেই নিয়েছে জালটা। বিনিময়ে কিছু পয়সা অবশ্য নেয় করিম মাঝি। কখনো কখনো সেটাও সম্ভব হয় না, কিছু মাছ দিয়ে তবেই খুশি করতে হয় করিম মাঝিকে। অনেক দিন থেকেই সগির মাঝি ভাবছিল একটা জাল কেনার কথা। কিন্তু তা আর হলো কই? যা রোজগার ছেলে করে, তাতে পেট চালানোই দায়,তার ওপর জাল কেনার টাকা জোগাড় করা! তবুও মাঝি আশায় বুক বাঁধে। ছেলেটার অসুখ সারলেই এবার ওকে জাল কেনার কথা বলবে। অল্প অল্প করে টাকা জমিয়ে ব্যবস্থা করবে জাল কেনার।
এসব ভাবতে ভাবতে বেলা গড়িয়ে যায় অনেক। টাটানো সূর্যটা তখন ঠিক মাথার ওপর। তীব্র তাপে গা বুঝি পুড়েই যাবে তবুও জাল ফেলে মাঝি। সময় বয়ে যায়। খানিক বাদে- জালে কিছু একটা লেগেছে বলে টের পায় মাঝি। জাল তুলতে জোরে টান দেয়, কিন্তু জালে মাছ উঠে না। উঠে আসে কিছু ভাঙা টিনের টুকরো। মাঝি তাই জালটা নৌকায় তুলে আনে পরিষ্কার করার জন্য। আর তখনই ঘটে বিপত্তি। টিনের টুকরো ছাড়াতে গিয়ে, ছিঁড়ে যায় জাল! খুব বেশি না ছিড়লেও চিন্তিত দেখায় মাঝিকে। কারণ জালটা যে অন্যের। করিম মাঝি খুব করে বলেছিল, আমার জালের যেন ক্ষতি না হয় সগির মিয়া! সগির মাঝি জোর দিয়ে বলেছিল কিছুই হবে না দেইখো। এখন কী জবাব দিবে সে? চিন্তিত মাঝির চোখ বেয়ে নামে অশ্রুধারা। মাছ মারতে আর ইচ্ছে হয় না মাঝির। মাছ তো পেলই না, জালটাও গেল ছিঁড়ে। ভাগ্যটাই খারাপ। স্বগতোক্তির মতো কথাগুলো বলে, বাড়ির দিকে নৌকা বাইতে লাগল সগির মাঝি।
৪.
করিম মাঝি রাগ করেছে খুব। ধমকে সগির মাঝিকে বলেছে-‘আমার এতো সখের জালটা ছিঁড়ে ফেললা মাঝি! তোমার কাছে আর জাল দিমু না।’ সগির মাঝি পা ধরে বলেছে, করিম ভাই! তোমার জালটা না হলে যে, না খেয়ে মরতে হবি। আল্লাহর দোহায়, এমনডা কইরো না।’
আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে। করিম মাঝির গলা খানিকটা নরম শোনায়। তবে একটা শর্ত আছে, আমারে নতুন জাল কিনে দিতে হবে। যদি শর্ত মানো, তাইলে তোমারে জাল দিবার পারি। পুরানডা তুমি নিয়া যাইও তখন। করিম মাঝির শর্ত শুনে মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে সগির মাঝির। ঘরে অসুস্থ ছেলে, নেই খাবার, তার ওপর জাল কেনার টাকা জোগাড় করার কোনো উপায় খুঁজে পায় না মাঝি। তবুও শর্ত মেনে নেয়। আর করিম মাঝির কাছ থেকে আরেকটা জাল নিয়ে ঘরে ফিরে সে।
৫.
ছেলেটা সুস্থ হয়নি। তাই আবারো সগির মাঝিই বের হয় জাল নিয়ে। ক্ষুদা, ক্লান্তি, আর চিন্তায় বড় অসহায় দেখায় মাঝিকে। বড় একটা খেপ দিতে পারলে ভালো হতো। বেশি মাছ ধরতে পারলে টাকাও বেশি রোজগার হতো। ছেলেটার জন্য নেয়া যেত কিছু পথ্যও। সেই ভাবনা থেকেই, মাঝি আজ কিছুটা দূরে যেতে চাইল মাছ ধরতে।
নৌকা বাইতে বাইতে অনেক দূর চলে এলো মাঝি। ঠিক নদীর মাঝখানে। এদিকে তেমন কাউকে দেখা যাচ্ছে না। আরো দূরে, প্রায় নদীর শেষ মাথায় দু-একটা নৌকা চোখে পড়ে। এমন মানবশূন্য সুনসান-নীরব জায়গা পেয়ে বেশ খুশি হলো সগির মাঝি। এতদিনে একটা জায়গা পাওয়া গেল মাছ ধরার। যদিও এমন নীরব জায়গায় কিছুটা ভয় ভয় লাগছে। তবে দ্রুত মাছ ধরে ফিরে যাওয়ার প্রবোধ দিয়ে-মনকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছে সে।
বিসমিল্লাহ বলে মাঝি জাল ফেলল নদীতে। কিছুক্ষণ পর জাল তুলতেই দেখল রাশিরাশি মাছ। চোখজোড়া চকচক করে উঠে মাঝির। নৌকা বেয়ে এতদূর আসার ক্লান্তি, নিমিষেই উবে যায়। মাছগুলো ডুলি আর বোলে নেয় ঝটপট। তারপর আরেক খেপ দিতে আবারো জাল ফেলে নদীতে। কিন্তু হঠাৎ মাঝির কানে ভেসে আসে ট্রলারের শব্দ। তাকিয়ে দেখে তার নৌকার দিকেই আসছে ট্রলারটি। প্রথমে ভড়কে যায় মাঝি। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নেয়। এ দিনদুপুরে আমারে মারবার কে আইব? এ ভেবে নিশ্চিন্ত হয় সে। কিছুক্ষণ পর কী ঘটতে যাচ্ছে- মোটেও বুঝতে পারেনি সগির মাঝি। তাই আবারো মাছ শিকারে ব্যস্ত— হয়ে পড়ল।
ট্রলারটি মাঝির নৌকার কাছে আসতেই দেখতে পায় ট্রলারভর্তি পুলিশ! ভয়-শঙ্কায় প্রায় জমে যায় মাঝি। নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ভেবে পায় না, কেন তার নৌকার দিকে ছুটে আসছে পুলিশবাহী ট্রলার।
মাঝির নৌকার কাছে এসেই-দু’জন পুলিশ প্রায় লাফিয়ে উঠে যায় মাঝির নৌকায়। অবস্থার আকস্মিকতায় বিহ্বল হয়ে যায় মাঝি। মুখে তার কথা সরে না। কিছুক্ষণ পর খানিকটা ধাতস্থ হয়ে মাঝি জিজ্ঞেস করে, আমার অপরাধ কী স্যার? জবাবে পুলিশ বলে-এড়িয়া ক্রস করে মাছ শিকার ও জাটকা ধরার অপরাধে তোমাকে গ্রেফতার করা হলো! জবাবে কিছুই বলতে পারে না মাঝি। শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। মাঝির চোখের সামনে তখন ভেসে উঠে- অসুস্থ ছেলের মুখ, খাবারের অপেক্ষায় থাকা মেয়ে-স্ত্রীর ক্ষুদাক্লিষ্ট চাহনি, আর করিম মাঝিকে দেয়া কথা-না রাখতে পারার কঠিন পরিণতির দৃশ্যপট!
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা