২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

পরিতোষ

পরিতোষ -

রিকশা না পেয়ে ফুটপাথ ধরে রাতের কৃত্রিম আলোয় হেঁটে চলেছি একা। ঘড়িতে সময় সাড়ে ৭টা। মোটেই ভয় লাগছে না, ভয় লাগার কোনো কারণও নেই। এমন অনেক মানুষ আছে, যারা এই ফুটপাথেই রাতের পর রাত কাটিয়ে দিচ্ছে অনায়াসে। ুধা পেটের যন্ত্রণা তাদের নিত্যসঙ্গী। এ কেমন জীবন তাদের! আহা, জীবন! মানুষের জীবন যে কতটা তুচ্ছ, আজ তা খুব কাছে থেকে প্রত্য করলাম। একবার নয়- একাধিকবার। আর এ জীবনে বেঁচে থাকাও কারো ব্যক্তি ইচ্ছাধীন নয়, না হলে পৃথিবীতে সবাই বুঝি অমরত্বের বাসনা করত।
আমি আনিকা। বিকেলে ওয়ার্ড শেষ করে ফাহমিদা ম্যামের চেম্বারে গেছিলাম বিয়ের কার্ড দিতে। অপারেশন থিয়েটারে আছেন শুনে বাইরে অপো করতে লাগলাম। আর ভাবছিলাম আরেকটা জীবন ধরনির বুকে শ্বাস নিতে আসছে। এই অসুস্থ, নিষ্ঠুর, কোলাহল পৃথিবীতে একটা নিষ্পাপ প্রাণের আগমনের অপোর প্রহর গুনছিলাম। আমার তো ১০ মিনিটেই তর সইছিল না। তাহলে গত ১০টা মাস ধরে অনাগত শিশুটির মা কতটা ধৈর্য নিয়ে অপো করে গেছেন নিজের শরীরের ভেতর আগলে রেখে। একবার ‘মা’ ডাক শোনার জন্য পরম যত্নে লালন করেছেন আত্মাটিকে। কতবার কল্পনায় এনে ওর মুখটি অনুভব করেছেন। মাতৃত্ব বুঝি একেই বলে। সব মেয়ের জীবনের সবচেয়ে আকাক্সিত কষ্টকর আনন্দের মুহূর্ত বুঝি এটিই।
কিছুণ পর খবর এলো যে অতিথির আগমনের প্রতীায় এতণ ব্যাকুল হয়েছিলাম, সে পৃথিবীর আলো দেখার আগেই মায়ার বাঁধন ছেড়ে ওপারে পাড়ি জমিয়েছে। স্বজনদের কান্নায় ভারী বাতাস হৃদয়টা আন্দোলিত করল। নিজের ভেতরেও বোবাকান্নার শব্দ শুনতে পেলাম। এমনটা কি না হলে হতো না! ভাঙা কাচের টুকরোর মতো স্বপ্ন, আশা ভেঙে শেষ হয়ে গেল অভাগিনীর।
নিজেকে কিছুটা শক্ত করলাম। মৃত্যুর ওপর তো আর কারো হাত নেই। পুরো সৃষ্টিজগত যিনি অত্যন্ত সুনিপুণভাবে পরিচালনা করছেন, তিনিই তো জীবনবিধাতা। আমরা দু’দিনের অতিথি হয়ে এসে মায়ায় লেপ্টে যাই। কিন্তু যে আত্মা পৃথিবীতে আসতেই পারেনি, তার জন্য যদি এত মায়া থাকে, তাহলে সেই একই মাটির গড়া মানুষ হয়ে কিভাবে এত সহজে দীর্ঘ ভালোবাসার বন্ধনগুলো ছিন্ন করে ঠুনকো করে ফেলেছি বিশ্বাস, দূষিত করেছি সমাজ। কিভাবে!
এসব ভাবতে ভাবতে দেখলাম ম্যাডাম চেম্বারে ঢুকছেন। আমারও ডাক এলো। বিয়ের কার্ডটা দিয়ে কথা শুরু করলাম। কথা হলো একটু আগের ঘটনা নিয়েও। ম্যামকে কিছুটা বিমর্ষ মনে হলো; কিন্তু সেটা নিজের মধ্যেই চেপে রাখার চেষ্টা করছেন। বিষয়টি যে আমি টের পেয়েছিলাম, তা তিনি বুঝতে পারলেন। বললেন, ‘ডাক্তারের মুখের দিকে তাকিয়ে রোগীরা তাদের চোখের জল মোছার জন্য আশ্রয় খোঁজে। তাই ডাক্তারদের কাঁদতে নেই। ভবিষ্যৎ ডাক্তার হচ্ছো, এমন অনেক দুঃস্বপ্নের সাী হবে।’
খানিক বাদে একজন ভদ্রলোক এলেন। তার স্ত্রীর রিপোর্ট দেখাতে এসেছেন। প্রথমবারের মতো বাবা হচ্ছেন শুনে এক অকৃত্রিম, বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস ফুটে উঠল চোখে মুখে। এই মুহূর্তটার অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়, কারো কাছে শুনেও অনুভব করা যায় না। কবি বলেছিলেন, ‘পৃথিবীটা রঙ্গমঞ্চ, আমরা সবাই অভিনেতা’। এ েেত্র কথাটি পৃথিবীর সবচেয়ে চরম মিথ্যে কথা মনে হলো।

ভদ্রলোক চলে যাওয়ার পর আর কয়েকজন রোগী দেখে ম্যাম চললেন আরেকটি অপারেশনের জন্য। ওটিতে আরেকজন অপো করছেন। যাওয়ার আগে আমাকে বিদায় দিলেন আর জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু করার জন্য শুভকামনা জানালেন। আমিও বিদায় বলে বের হয়ে চলে এলাম। কিন্তু নিজেকে মানাতে পারলাম না। অজানা এক কৌতূহলী আকর্ষণে থেকে গেলাম। বাইরে বসে অপো করতে লাগলাম।
মনের মধ্যে নানান চিন্তা ঘোরপাক খাচ্ছিল। একটু আগের ঘটনাটা মন থেকে এখনো সরাতে পারিনি বলেই হয়তো কিছুটা ভয় আর শঙ্কা ঘিরে ধরেছিল। মনে মনে দোয়াও করতে লাগলাম, একটি সুস্থ ফুটফুটে শিশুর কান্নার শব্দ শোনার জন্য।
সৃষ্টিকর্তার অপার করুণায় এবার কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি, নিরাশ হতে হয়নি অনাগত সন্তানের জন্য অগণিত রাত নির্ঘুম কাটানো সেই গর্ভধারিণী মাকে। পুত্র সন্তান, তাই আজানের ধ্বনি শুনিয়ে তাকে স্বাগতম জানালেন তার বাবা। শিশুটিকে দেখে আনন্দে উদ্বেল হলাম, তাই কোলে নিয়ে আদর করার লোভ সামলাতে পারলাম না। যাক, শেষ বেলাতে এই খুশিটুকু সঙ্গী করে ফিরতে পারব।
হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে দেখলাম অনেকটা দেরি হয়ে গেছে। তাই রিকশা না পেয়ে হাঁটা ধরলাম। মনটা তখনো যেন হাসপাতালেই পড়ে রইল। নিয়তি বড়ই অদ্ভুত! এক মায়ের কোল খালি হলো, তো আরেক মায়ের ঘর আলো করে সন্তান এলো।
মেডিক্যাল কলেজে গত পাঁচ বছরে অনেক কিছু শিখেছি। কিন্তু আজ নতুন একটি জিনিস শিখলাম। খুব ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারলাম, ডাক্তারি পেশায় আবেগের কোনো মূল্য নেই। এক রোগীর মৃত্যুর যন্ত্রণা বুকে নিয়েই এগিয়ে যেতে হয় আরেক রোগীর জীবন বাঁচানোর সংগ্রামে। এটা আরেক মনস্তাত্ত্বিক লড়াই। কিন্তু দিনশেষে সাফল্য-ব্যর্থতার আনন্দ বা অশ্রু কিছুটা হলেও ছুঁয়ে যায় ব্যক্তিজীবনকেও, যা কখনো কেউ বুঝতে পারে না। আসলে বুঝতে দেয়া হয় না। তাই তো পেশাগত জীবনে আমরা কসাই, পাষাণ শব্দগুলো শুনে থাকি।

 

 

 


আরো সংবাদ



premium cement