২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

সময়

সময় -

চঞ্চলা কিশোরীর মতো শপিংমলের এক্সেসরিজ সেকশনের ফ্লোরজুড়ে চক্কর কাটছিল মেয়েটি।
নামীদামি শপিংমল। এখানে আসেই সব বড়লোকেরা। কী দারুণ দারুণ সব ব্যাগ, চুড়ি, মালা...আর কী দারুণ সব ইয়ারিং। সেই ছোটবেলা থেকেই ইয়ারিংয়ের দিকে ঝোঁকটা তার বড্ড বেশি। মধ্যবিত্ত বাবার দেয়া হাতখরচের টাকা বাঁচিয়ে মাসে দু’মাসে কিছুমিছু কিনত। কিন্তু সেসবও সব ফুটপাথ থেকে। চটকদার, বাহারি নকশা... কিন্তু ভেতরে সব ফাঁপা। ওপরের সৌন্দর্যটা মেকি, দু’দিনও সেই চটকের মেয়াদ থাকত না। মেয়েটা তবু অনেক ভালোবাসা নিয়ে গুছিয়ে রাখত সবকিছু। সেই ইয়ারিংগুলো তার কাছে অমূল্য ছিল।
বিয়ের পর স্বামী আর তার নিজের স্বল্পবেতন দিয়ে টেনেটুনে সংসার চালাতে হয়। ইয়ারিং পরতে এখনো ভালো লাগে। ফুটপাথের জায়গায় উঠে এসেছে সাদামাটা শপিংমল। দুই তিন মাসে অনেক কষ্টের পয়সা বাঁচিয়ে এখনো কিছু কেনা হয় বটে, কিন্তু এরকম দামি শপিংমল থেকে কিছু কেনার স্বপ্ন এখনো অধরা।
তবু এখানে প্রায় নিয়মিতই আসে সে। এসে একা একা ঘুরতে ভালো লাগে। হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখতে ভালো লাগে অবিশ্বাস্য সুন্দর সব ইয়ারিং! কানের কাছে ধরে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে থাকে। ইস! এই ইয়ারিংগুলো পরলে তার চেহারাটাই কেমন পালটে যায়! কী দারুণ সুন্দর লাগে ওকে দেখতে! এত দাম! আহা! কবে যে বেতনটা আরেকটু বাড়বে!
ইচ্ছেমতো ইয়ারিং কিনে নিজের ভাণ্ডার ভরিয়ে ফেলবে সেদিন!
বাইশ বছর পরের কথা।
সেদিনের সেই মেয়েটি এখন নামকরা একটি ফার্মের উচ্চপদস্থ এক্সিকিউটিভ। প্রতিদিন বিশাল গাড়িতে চড়ে অফিস যাওয়ার পথে সে এখনো ক্লান্ত তৃষ্ণার্ত চোখে তাকিয়ে থাকে শপিংমলটার দিকে।
শহরে ব্যাঙের ছাতার মতো নামীদামি আরো কত শপিংমল গজিয়ে উঠেছে! এই শপিংমলটি এখন ওগুলোর তুলনায় ম্লান, পিছিয়ে পড়া। বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজনের জন্য উপহারসামগ্রী কিনতে নতুন মলগুলোতেই যাওয়া হয় এখন।
তবু কী মনে করে আজ ড্রাইভারকে পুরনো এই শপিংমলটার পার্কিংয়ে গাড়িটা পার্ক করতে বলল। গাড়ি থেকে নেমে ধীরকুণ্ঠিত পদক্ষেপে ভেতরে প্রবেশ করল সে।
আজ সে মধ্যবয়সী এক নারী। চেহারা বেশভূষা চলনবলনে বয়স এসে অনিবার্য ছোবল হেনেছে। হিজাবের অন্তরালে ঢেকে রাখা সাদাপাকা চুলগুলো ওকে প্রতিনিয়তই পলাতক সময়ের কথা মনে করিয়ে দেয়।
হাঁটতে হাঁটতে কসমেটিক্স আর এক্সেসরিজের সেকশনে চলে আসে সে। ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকে সবকিছু। অনেকটা আগের মতোই আছে। খুব বেশি পরিবর্তন ঘটেনি এখানে। আজ থেকে বাইশ বছর আগে যেমন ছিল, এখনো অনেকটা একইরকম। সেই লম্বা কাঁচের বক্সগুলোর ভেতরে সারি সারি ইয়ারিং। সামনে দাঁড়ানো সেলস গার্লগুলোও আগের মতোই অল্পবয়সী। শুধু তাদের চেহারাগুলো বদলে গেছে। একটা ইয়ারিং একটু পছন্দ হতে হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখে সে। কানের কাছে ধরতে গিয়ে হাত আটকে যায় কাপড়ের বন্ধনে। একটু যেন হোঁচট খায় মনে মনে। এখানে তো... কান থাকার কথা!
অকস্মাৎই বুঝি মনে পড়ে যায়, কান ঢাকা পড়ে আছে হিজাবের আড়ালে। বয়স হয়েছে, সময় পেরিয়ে গেছে অনেক... মূল্যবোধগুলো এখন অন্যরকম হয়ে গেছে। হাতে ধরে রাখা ইয়ারিংটার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে নিজের অজান্তে। বক্সের পেছনে স্কচটেপ দিয়ে সেঁটে রাখা দামের ট্যাগটা দেখে। এর চেয়ে মূল্যবান কত কিছুই এখন প্রায় নিয়মিতই কেনা হয় তার।
ইয়ারিংয়ের বক্সটা সেলসগার্লকে ফিরিয়ে দিতেই মেয়েটি হাসিমুখে জিজ্ঞেস করে, ‘ম্যাম, পছন্দ হয়নি? অন্য কিছু দেখাব?’
সে মুখ খোলে। ক্লান্ত স্বরটা নিজের কাছেই কেমন অপরিচিত শোনায়। নাকি দুর্বোধ্য! ম্লান হাসি হেসে স্বগতোক্তির মতোই সে বলে ওঠে, ‘নাহ্! আরেকটু ক্লাসি কিছু চাচ্ছিলাম!’

 


আরো সংবাদ



premium cement