‘প্রাণের মেলায় প্রাণের মানুষ’
- নূরুন্নাহার নীরু
- ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০০:০০
বাঙালির প্রাণের মেলা বললে একটি ছবিই হৃদয় ভূমে ভেসে ওঠে আর সেটি হচ্ছে যুগ যুগ ধরে বহমান বইমেলা। যে মেলার টানে জেলা-উপজেলা-গ্রামগঞ্জ থেকেও ছুটে আসে বইপ্রেমী প্রাণের মানুষ। একসময় এ মেলা যদিও রাজধানী ঘিরেই চলে আসছিল কিন্তু বেশ ক’বছর ধরে জেলা শহরগুলোতেও উদযাপিত হচ্ছে সাড়ম্বরে। প্রাণের মেলা কেন? দেশের অগণিত কবি-লেখক-সাহিত্যিক এই একটি মেলার দিকেই মুখীয়ে থাকেন সারা বছর ধরে। প্রস্তুতি নিয়ে বছরান্তে স্বীয় প্রতিভা বিকাশের অন্যতম মাধ্যম এ মেলায় স্থান করে নিতে পেরে স্বস্তির শ্বাস ফেলে। আর বিকশিত প্রতিভার জীবন্ত স্বাক্ষর আত্মজসম প্রকাশিত বইটি পাঠকের হাতে তুলে দিতে পারে। যে বইয়ের গন্ধ শুঁকে তৃপ্ত হয় কবির হৃদয়। পাশাপাশি উদ্বুদ্ধ হয় পাঠক হৃদয়ও। সে জন্যই বোধ করি এটি প্রাণের মেলা। এই বইমেলা আসে বছরে একবারই। এই ফেব্রুয়ারিতে আমাদের ভাষার মাসে।
এ মাসেই জেগে ওঠে বাঙালির তনুমন তারুণ্যের উদ্দীপনায়। কি বুড়ো কি শিশু পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠে মেলা প্রাঙ্গণ। মাসের শুরু থেকেই জাতিগতভাবে জেগে ওঠে একটা উৎসবের আমেজ। টান টান উত্তেজনায় অবিরাম চলে প্রস্তুতি পর্ব। যারা বই প্রকাশ করবে, স্টল ভাড়া নেবে তাদের মধ্যে পড়ে যায় বাড়তি হুড়োহুড়ি। অন্য দিকে পাঠক পর্যটক দর্শক সবাই একটু সচেতন হয়ে যায় পকেটের বাড়তি জোগান নিয়ে।
এক সময় এ প্রাণের মেলাটি শুধু বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে কয়েকটি স্টল নিয়ে বসত। ক্ষুদ্র সে পরিসরেই চলত বই বিকিকিনি, গল্প-আড্ডা, ঘুরাঘুরি, চটপটি-ফুচকার রসনাস্বাদন। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী, কবি-সাহিত্যিক, গুণীজন, জনগণ সব শ্রেণীর মানুষেই ভরে উঠত ছোট সেই মেলা। সেই সাথে চলত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। তবে এখনকার বইমেলা আর আগের মতো ছোট প্রাঙ্গণে নেই। বেড়েছে পরিধি। বাংলা একাডেমি চত্বর ছাড়িয়ে বিশাল সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। সেখানে চিরায়ত সে সবই আছে বরং আরো একটি বাড়তি যোগ ঘটেছে ফাস্টফুডের পসরায় দোকানিদের রমরমা ব্যবসায়। ভোজনপিয়াসী বাঙালিও বই কিনুক আর না-ই কিনুক এক কাপ চা অন্তত না পান করে প্রস্থান করতে নারাজ। বেঁচে থাকুক বইমেলা বেঁচে থাকুক খাবার পসরা।
রকমারি বই, খাবার দাবার ছাড়াও মেলার বিশেষ আকর্ষণ সজ্জাপ্রিয় রমণীদের জটলা। ছাত্রজীবন থেকেই আমার একটা অভ্যেস ছিল সুন্দরী পরিপাটি শাড়ি পরিহিতা রমণীদের দিকে তাকিয়ে দেখা- সে একবারের জন্য হলেও। মনের মতো হলে তো ফ্যাল ফ্যাল করেও তাকিয়ে থেকেছি কত! কী আশ্চর্য কোনো পুরুষকে তো এভাবে দেখি না? সত্যিই নারীও প্রকৃতির একটি উপভোগ্য অংশ। দেখি আর ভাবি, এই রমণীরা আমার চোখেই যদি এত সুন্দর হয় তবে পুরুষের চোখে না জানি কী! আর কেনোই বা বৈপরিত্বের টানে অহরহ পদস্খলন ঘটছে এ সমাজে! সে জন্যই কি মহান সৃষ্টিকর্তা নারীর সৌন্দর্যকে ঢেকে রাখার হুকুম করেছেন! তাই বুঝি আল-কুরআন বলছে, ‘তোমরা জাহেলি যুগের মতো সাজগোজ প্রদর্শন করে বেরিও না।’ (৩৩ : ৩৩)
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন একবার দলবেঁধে বান্ধবীরা ঘুরছিলাম বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণের স্টলগুলোতে। আমার বেশি ঝোঁক ছিল ইতিহাসভিত্তিক অথবা জীবনীমূলক বইয়ের দিকে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তা-ই দেখছিলাম। হঠাৎ বান্ধবীদের চাপা উত্তেজনা- ‘ত্রিরত্ন একসাথেই ঘুরছে’। হ্যাঁ ঠিক তাই। পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখলাম ‘ত্রিরতœই বটে!’ আশির দশকের স্বনামধন্য আফজাল-ফরীদি-সুবর্ণা। প্রায়ই তিনজনকে এক সাথেই দেখা যেত ভার্সিটি চত্বরে। দেখেছি ফকির আলমগীর, সহপাঠী ইলিয়াস কাঞ্চনকেও। আরেকবার দেখেছি সে সময়ের বিটিভির প্রথম ধারাবাহিক ‘সকাল-সন্ধ্যার’ শাহেদ-শিমু খ্যাত পীযূষ ও আফরোজা বানুকে। একবার অভিনেতা পরলোকগত আরিফুল হক সাহেবের সাথে কথা বলারও সুযোগ হয়েছিল। সুযোগ হয়েছিল স্বনামধন্য কবি আসাদ চৌধুরীকে দেখার। যার ভরাট কণ্ঠের আবৃত্তিতে মুগ্ধ হতো শ্রোতামণ্ডলী। এই তো সেবার করোনার আগে আগে দেখা পেলাম প্রিয় অভিনেত্রী তানভীন সুইটি, শিলা ও আসিফ নজরুলসহ আরো অনেককে। এ যেন মেলার বাড়তি আকর্ষণ। চোখ যেন খুঁজে খুঁজে এই প্রিয় মানুষগুলোকেই পেতে চায়। সাম্প্রতিক সময় থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিরাট প্যাভিলিয়নে রাখা প্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদের ম্যুরালটি মনে করিয়ে দেয় যেন আগত দর্শকদের মনোবৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে নিমগ্ন লেখক। আরো একটা কিছু লিখবেন যেন। এভাবেই বেঁচে থাকুক কীর্তিমানরা। শ্রদ্ধাবনত হয়ে আসে হৃদয়ানুভূতি।
এবার অতিমারী কোভিড-১৯-এর কারণে প্রাণের মেলা শুরু হয়েছে ফেব্রুয়ারির অর্ধেকে এসে। তবু বাড়ছে উপচেপড়া ভিড়। বই বেচাকেনাও খারাপ নয়। মনে হলো পরপর দুই বছরের বিরতিতে ছাড়া পাওয়া মানুষ ছুটছে প্রাণের মেলায় প্রাণের মানুষগুলোর সান্নিধ্য পেতে। সত্যিই প্রাণের মানুষ! এ মেলায় যেমন প্রাণের মানুষ পাওয়া যায় তেমনি প্রাণের মানুষ হয়েও ওঠা যায়- একটু সদিচ্ছা থাকলেই। মনে পড়ে ’১৯-এর বইমেলায় দেখা হয়েছিল আমার ভক্ত দুই পাঠকের সাথে। তারা খুঁজে খুঁজে এসে আমার স্টল থেকে আমার বই কিনে নিয়েছিল কিন্তু তারা আমার এতটাই প্রাণের যে আমি জোর করেই তাদের আপ্যায়ন করিয়ে তৃপ্ত হয়েছিলাম। তারা অভিভূত হয়েছিল। যত না বিক্রি হয়েছে তার চেয়ে বেশি খরচা গেছে। তাতে কী! শুধু আমার লেখনীকে ভালোবেসে ওরা সুদূর রংপুর থেকে এসেছে আবার রাতেই ফিরে যাবে। মনে পড়ে ঝড়ের কবলে পড়া গোপালগঞ্জ থেকে আসা নবযৌবনা এক সুন্দরী রমণীর অসহায়ত্বের কথা। বিশ্বস্ত অভিভাবকের মতো এগিয়ে গিয়ে নিজ আলয়ে হিফাজতে রেখেছিলাম সে রাতটা কোন জানি মায়ের সে কন্যাকে। এমনি ছোট ছোট আরো অনেক ঘটনা।
হয়তো আরো কারো জীবনেও আছে- সবই প্রাণের মানুষ বলেই সম্ভব। স্টল থেকে স্টল ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ দেখা একটি ৯-১০ বছরের ছোট্ট ছেলের সাথে। ছেলেটি কারো হেল্পিংহ্যান্ড হয়ে এসেছে মেলায়। বেচাকেনার ফাঁকে ফাঁকে ঘুরে ঘুরে এ বই ও বই দেখছে। একটি শিশুতোষ বইয়ের দিকেই ওর চোখ আটকে আছে দেখে কৌতূহলী মন আমার জানতে চাইল- কার সাথে এসেছে? কোন স্টলে বসেছে? পড়তে জানে কি না? কোন ক্লাসে পড়ছে? উত্তরে বুঝতে পারলাম প্রতিদিন কত বই বিক্রি হচ্ছে কিন্তু ওর ভাগ্যে জুটছে না একটিও। হৃদয়ের আক্ষেপ প্রশমনে আমিই হাত বাড়িয়ে কিনে দিলাম একটি পছন্দের বই। মনে হলো ওরাও তো পাঠক! আনন্দের আতিশয্যে উজ্জ্বল হয়ে উঠল ওর মুখটি। ভীষণ ভালো লাগল নিজেকে। আমিও যেন হয়ে যেতে পারলাম ওর ছোট্ট হৃদয়ে একজন প্রাণের মানুষ। আমার মতো হয়তো আরো অনেকের জীবনেই আছে কোনো না কোনো স্মৃতিময় ঘটনা।
বেঁচে থাকুক আমাদের প্রাণের মেলা প্রাণের মানুষসমেত।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা