২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

ফাগুন দিনে

ফাগুন দিনে -

গাড়িটা নার্সারির কাছে থামতেই ১৯ বছরের একটি ছেলে এগিয়ে এসে দরজা খুলে খুব সম্মানের সাথে বলল, ‘আপা আসুন’। ভেতরে প্রবেশ করতেই কেউ একজন ডাক দিলো, সুরুজ তাকে সেই সুন্দর গাঁদা আর চন্দ্রমল্লিকা দেখাও।
নূপুর চমকে মানুষটির দিকে তাকাল। সে কিছু বলল না। লোকটি কিভাবে বুঝল যে সে গাঁদা আর চন্দ্রমল্লিøকা ফুল পছন্দ করে! অযথা জিজ্ঞেস করা ঠিক মনে হলো না। নূপুর এগিয়ে গিয়ে ফুল দেখতে লাগল। এবার গাঁদা ফুলের সাথে আরো কিছু ফুলও নিলো। গাড়িতে ফুল রেখে টাকা বের করল। লক্ষ করে দেখল, সেই মানুষটি কিছু দূরে দাঁড়িয়ে তার গাড়ির দিকে খুব মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে আছে। নূপুর তাকে উপেক্ষা করে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। গাড়িতে বসতে যাবে এমন সময় পেছন থেকে একটা আওয়াজ এলো, নূপুর।
চমকে ফিরে তাকাল। মানুষটি তার নাম ধরে ডাকছে। এগিয়ে কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, নূপুর আমাকে চিনতে পারছ না?
সাথে সাথে নূপুরের মুখ থেকে সাড়া বের হলো না।
আমি শোয়াইব...।
নূপুরের মুখে চেনার রেখা ফুটেনি, তাই মানুষটি আবার বলল, নবম শ্রেণীর শোয়াইব, রেবার ভাই।
পুরানো স্মৃতিতে নূপুরের মানসিকতা চালানো শুরু। কথাগুলো মনে পড়তেই মুখে হাসির রেখা জায়গা করে নেয়। সে বলল, রেবা কোথায়?
খুব দূরে। অস্ট্রিয়াতে।
আর তুমি এখানে..?
হ্যাঁ, আমি অনেক কাজ করেছি কিন্তু কোনোটাই আমার ভালো লাগেনি। এরপর শুরু করেছি নিজের নার্সারি ব্যবসা। এখন আমি পুরো এলাকা কভার করছি।
বয়সের পরিবর্তন আমার মধ্যেও এসেছে, তারপর আমাকে চিনলে কী করে?
মুখের কিছু রেখা বদলে গেছে, সৌন্দর্য এখনো আছে। আমি তোমাকে দুই বছর ধরে দেখছি, এই ঋতুতে তুমি এসে, গাঁদা আর চন্দ্রমল্লিকা গাছ নিয়ে চলে যাও। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ এখানে গোলাপ ও ডালিয়ার জন্য আসে।
আমার সাথে কথা না বলে তুমি কিভাবে বুঝলে যে আমি শুধু গাঁদা আর চন্দ্রমল্লিকা চাই?
শোয়াইব দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল, তোমার বাগান থেকে গাঁদা ও চন্দ্রমল্লিকা চুরির শাস্তি এমনই হয়েছিল যে, সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত গাঁদা আর চন্দ্রমল্লিকা গাছ লাগাচ্ছি।
নূপুরের বাবার বড় সরকারি কোয়ার্টার ছিল, দীর্ঘ রাস্তার পর গেট। প্রতি বছর রাস্তার দু’পাশে খুব যত্ন করে একটি গাঁদা ও একটি চন্দ্রমল্লিকা গাছ লাগাত নূপুর। কেউ তার ফুল ছিঁড়ে নেয় কি না দেখার জন্য শীতের সকালে সে বাইরে লুকিয়ে বসে থাকত। কেউ ফুল তুলতে এলে তাকে খুব বকাঝকা করত। ছোট শিশু থাকলে শাস্তি হিসেবে কিছু ফুলের গাছ লাগিয়ে নিত। একবার শোয়াইবও ফুল ছিঁড়তে এসে ধরা পড়ল। তাকেও শাস্তি হিসেবে ফুলের গাছ লাগাতে হয়েছে। জায়গাটা ছোট হোক বা বড়, একটা ছেলে একটা মেয়েকে বকা দিলে সেটাই আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। সেখানেও একই ঘটনা ঘটল। শোয়াইবের সাথে তার বোন রেবারও খুব খারাপ লাগল। সে নূপুরকে অনেক বকল। কিন্তু নূপুর তার কথায় অনড় ছিল- ‘যদি তোমার ফুলের প্রতি অনুরাগ থাকে, তাহলে ফুলগাছ লাগাও।’ পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠলে নূপুর বাইরে দেখল ১০টি গাঁদা ও চন্দ্রমল্লিকা, উপরে একটি চিঠি আগে থেকেই রাখা ছিল। নূপুর খুব রেগে গেল। কিন্তু কারো নাম ছিল না, বুঝেও কিছু করতে পারেনি সে।
এই যে কোথায় হারিয়ে গেছো...?
নূপুর ভাবনা থেকে ফিরে মৃদু হাসল। শোয়াইব বলল, আমি তোমায় খুব কড়া ভাষায় গালি দিয়েছিলাম কাগজে। তুমি বলেছিলে, ‘ফুলের প্রতি যদি তোমার এত ভালোবাসা থাকে তবে তা লাগাতে শেখো’। তখন বুঝলাম ফুল লাগানোর জন্য ঘরে অল্প জায়গার প্রয়োজন হয়।
নূপুর বলল, আমি ফুল পছন্দ করি, তাই শীতকালে কিছু চারা নিই। এগুলো ভালোভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় না, সময়ের সাথে সাথে চারাগাছের মৃত্যু হয়।
শোয়াইব বলল, তোমার এখনো ফুলের প্রতি ঝোঁক আছে; কিন্তু এখন তোমার গাছের যতœ নেয়ার সেই মনোভাব নেই যার কারণে আমি মালী হয়েছি।
এ কথার পর আর কিছু বলা হয়ে উঠে না নূপুরের। মানুষটির দিকে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে থাকল শুধু, তারপর আরো মুহূর্ত তাকিয়েই থাকল...।

 


আরো সংবাদ



premium cement