২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

স্মৃতিময় ফেব্রুয়ারি

স্মৃতিময় ফেব্রুয়ারি -

ফেব্রুয়ারি মানে ভিন্নরকম আয়োজন। ফেব্রুয়ারি মানে তারুণ্যের জোয়ারে ভাসা। ফেব্রুয়ারি মানে ভাষার সুরে গেয়ে ওঠা। ফেব্রুয়ারি মানেই নতুন বইয়ের গন্ধে মেশা। এ দিনে কাছের বন্ধুরা অনেকেই বাড়ি থেকে ঘুরে আসে। কিন্তু দূরে বলে আমাদের আর যাওয়া হয় না। ঢাকার বাতাসেই নিজেদের খুঁজে ফিরি। কখনো ফুটওভারব্রিজের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে লম্বা জ্যামের লাইন পরিদর্শন করি, কখনো বা পিচঢালা রাস্তায় শান্ত মনে একাকী হাঁটি। আবার কখনো লেকের পাড়ে বন্ধুরা মিলে আড্ডা দিয়ে আসি। ক্যাম্পাসের ছাদে গিয়ে যে একটু শহরটাকে দেখব, একটু মুক্ত বাতাসের ঘ্রাণ নেবো, এম্বাসি পাড়ায় সে সুযোগ কোথায়!
কিন্তু আজ গেট ফ্রি থাকবে। হিমেল, কৌশিক, ফাহিম, চার বন্ধু মিলে বই মেলাতে যাওয়ার প্ল্যান করলাম।
বইয়ের নেশাটা ছোটবেলা থেকেই; বর্তমানে আরো তীব্র হয়েছে। স্কুল জীবনে সর্বপ্রথম মা আমার হাতে বই তুলে দেন আর কোলে বসিয়ে গল্প শোনাতেন। সেই থেকে গল্প-প্রবন্ধের নেশায় ডুবছি। আজো সে নেশার ঘোর কাটেনি। দিন দিন আরো নেশাগ্রস্ত হচ্ছি। মন্দ নেশা নয়, বই পড়ার নেশা। প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি এলে এ নেশাটা যেন আরো বেড়ে যায়। ছোটবেলায় বাবার মুখে বইমেলা শব্দ দু’টি শুনতে শুনতে মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মেলাতে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। তাই বলে আমার বই পড়া থেমে থাকেনি। আমি বারবার বইয়ের শহর ঘুরে দেখতে চেয়েছি। পৃষ্ঠার ভাঁজে ভাঁজে বারবার নিজেকে মেলে ধরেছি। নতুন বইয়ের গায়ে আলাদা একটা গন্ধ লেগে থাকে। মেলাতে গেলে সে গন্ধটা অনুভব হয়।
ক্যাম্পাসের গেট থেকে বেরিয়ে উবারে কল করলাম। দীর্ঘ জ্যাম ঠেলে ৪টা নাগাদ মেলায় এসে পৌঁছলাম। শ’খানেক স্টল ঘুরে একটি বই কিনেছিলাম। সাত দিন সময় লাগিয়ে খুব যতেœ বইটি পড়েছিলাম। একটি বই যে ব্যক্তিকে কতটা গভীর থেকে ভাবাতে পারে ‘আনোয়ারা’ না পড়লে হয়তো সেটি আমি বুঝতাম না। আমার পড়া শ্রেষ্ঠ বই এটি!
মেলা ঘুরে যখন পেটের ক্ষুধায় ভুগছি তখন সামনে পড়ল ফুচকার দোকান। কিন্তু দাম শুনে আর খাওয়ার ইচ্ছে হলো না। সবাই মিলে পরামর্শ করলাম বারিধারা এসে হালিম খাব।
সি ব্লকের দুই নম্বর রোডের দোকানে খুব ভালো হালিম পাওয়া যায়। পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে মসলার ঘ্রাণে জিবে পানি চলে আসে।
বাস থেকে নেমে সোজা অ্যাম্বাসির পথ ধরে হাঁটতে শুরু করলাম। বইয়ের ব্যাগগুলো সব আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে ওরা সবাই মোবাইলে ডুব দিচ্ছে। সবার হাতেই স্মার্ট ফোন। অনবরত মেসেজের টুং টুং শব্দে কান বিরক্ত হয়ে আসছে। আমি শুধু দেখছি তাকিয়ে। স্কচটেপ দিয়ে জোড়া দেয়া পুরোনো নোকিয়া ফোনটাই যে আমার সঙ্গী। তাই আমার চোখ শুধু এদিক-সেদিক ঘুরছে। সন্ধ্যার আকাশ দেখছি প্রাণ খুলে। রাতের তারা গুনছি বড্ড আনমনে। আকাশে লাল-নীল বাতি জ্বেলে বিমান ওড়ছে। অফিসের ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে বাসায় ফিরছে নানা পেশার মানুষ।
পায়ের জুতাটা খুলে ফেললাম। খালি পায়ে ঢাকার পিচঢালা রাস্তায় হাঁটার অভিজ্ঞতা অন্যরকম। জুতা হাতেই কিছুদূর হাঁটলাম। এটা দেখে ফাহিম আমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। ওর চাহনিতে অনেক অভিযোগ। হাজারো প্রশ্ন ওর চোখে। কী যেন ভেবে বেশি কিছু বলল না। শুধু বলল, ‘মানুষ কী ভাববে’ আমি বললাম, যা ইচ্ছে ভাবুক, ভাবার স্বাধীনতা সবার আছে। আমার দু’টাকার জুতা নিয়ে মানুষের এত ভাবার কী আছে!
ফাহিম, তোর সাথে বাবা কথায় পারা যাবে না। যা ইচ্ছে কর তুই।
হাঁটতে হাঁটতে ২ নম্বর রোডের মোড়ে চলে এলাম। এসেই দেখি যুগলদের মেলা বসেছে। দু’জন দু’জন করে হাতে হাত রেখে গল্প করছে। কারো হাতে বাদামের প্যাকেট, কারো হাতে ফুচকার প্লেট। কেউ বা পাঞ্জাবি-শার্ট, কেউ বা শাড়ির আঁচল বেঁধে এসেছে। ফেব্রুয়ারিজুড়েই এমন চিত্র অস্বাভাবিক কিছু নয়! রাস্তার ওপারে ক’জন বসে গিটারে সুর তুলেছে। অদূরে ক’জন সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছে। চায়ের চুমুকেও আছে একদল। আমরা যে কোন দলে সেটাই বুঝতে পারছি না।
দু’পা বাড়ালেই সামনে হালিমের দোকান। চুলায় গরম তেলে ডালপুরি আর পেঁয়াজু ফুলে উঠছে। দোকানের সামনে দু-চারজনের ছোট্ট একটা লাইন। ভেতরে অবশ্য দু-একটা চেয়ার বাদে সবই প্রায় ফাঁকা। এসব দোকানের এটিই বৈশিষ্ট্য। বড় বড় রেস্টুরেন্টের মতো এখানে কেউ সেজেগুজে খেতে আসে না। রাস্তার ওপর দাঁড়িয়েই গরম হালিমে মুখটা পুড়িয়ে ফেলেন। চায়ের চুমুকে চুমুকে খোশগল্পে মজে যান সবাই। এখানে কোনো কৃত্রিমতা নেই। আছে সরলতা। জীবনের আনন্দটা এখানেই। নাটকীয়তার এই শহরে দিন শেষে যেন বাস্তব জীবনে ফিরে আসা।
আজ কৌশিকের ট্রিট। ওর বাবা আজই বিকাশে টাকা পাঠিয়েছেন। ক্লাস ফাঁকি দেয়ার অর্থদণ্ড থেকে ওকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলাম। মাঝে মধ্যেই এমনটা হয়; কিন্তু এবার আর ছাড় দিচ্ছি না। তাই বেচারা বাধ্য হয়েই ট্রিট দিচ্ছে। তা না হলে ওর থেকে খাওয়াটা এত সহজ ব্যাপার নয়।
কৌশিক, ‘মামা, চারটে হালিম আর পুরি দিয়েন এখানে’। আমরা বাইরে যাচ্ছি না; ভেতরে বসেই খাব। খেতে খেতে নানা রকম গল্প জমে উঠেছে বন্ধুদের মাঝে। আগামী বছর কে কোথায় থাকবে এ নিয়েও কথা হলো। বিয়ের টপিকটাও ছিল ছোট্ট করে। এ বয়সে এটা ছাড়া বুঝি গল্প জমে ওঠে! এ গল্প না হয় অন্য দিন হবে। আজ যে বাবা জলদি উঠতে হবে। এরই মধ্যে মসজিদে আজান শুরু হলো।
হিমেল, জলদি শেষ কর; না হলে ‘ইকবাল সাহেবের’ হাত থেকে কেউ রেহায় পাব না। সিট কেটে একদম বান্দরবান পাঠিয়ে দেবে। খাওয়া শেষ করে দৌড়ে চলে। কিন্তু বিপত্তিটা ঘটল কৌশিককে নিয়ে। ও তো দৌড়াতে পারবে না এখন। বাধ্য হয়েই রিকশা ডাকতে হলো! এক রিকশায় চারজন, বুঝতেই পারছেন, কোনোরকমে ক্যাম্পাসের গেটে এসে নামলাম। এবার শুরু হলো দারোয়ানের প্রশ্ন পর্ব। ‘কোথায় গেছিলেন বাপজানেরা? আজানের পরে তো ভেতরে ঢুকন যাইব না’। হিমেলের সাথে দারোয়ানের বেশ খাতির। মাঝে মধ্যে চা-পান খাইয়ে খাতির জমিয়েছে। ওর অনুরোধে দারোয়ান আমাদেরকে ঢুকতে দিলো। ভেতরে ঢুুকেই সোজা সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় চলে গেলাম। লম্বা একটা শ্বাস নিলাম। যা ভয় পেয়েছিলাম!
এবার একটু হাঁপ ছেড়ে বাঁচা গেল। সত্যিই দৌড় ঝাঁপের মধ্য দিয়েই দারুণ একটা সন্ধ্যা উদযাপন করলাম। ভালো লাগার মুহূর্তগুলো এভাবেই টিকে থাকুক সবার মাঝে!


আরো সংবাদ



premium cement