উড়ে যায় স্মৃতিরা
- সাদ আমির
- ২৩ জানুয়ারি ২০২২, ০০:০০
শীতের দিনে মাহফিলের মতো এমন সুখের কোনো উৎসব হয় কি না আমার জানা নেই। মাহফিলের দিন সন্ধ্যায় আমরা হিম শীতল বাতাসে চাদর বা পশমি কাপড়ের কোট যা হোক গায়ে চাপিয়ে দৌড়ে যেতাম মঞ্চে। মঞ্চ তখন আমাদের দখলে। কুরআন মাজিদ তিলাওয়াত দিয়ে শুরু হতো মাহফিলের কার্যক্রম, তারপর একে একে গাওয়া হতো হামদ-নাত এবং ইসলামী সঙ্গীত।
মাগরিবের পর শুরু হতো মাহফিলের মূল পর্ব। ততক্ষণে মেলা সমান দোকানপাট বসে পড়েছে মাহফিলের আশপাশে। মঞ্চে শুরু হয়েছে আমন্ত্রিত অতিথিদের মূল্যবান বয়ান। জওয়ান-বুড়ো সব শ্রোতা বিশাল প্যান্ডেলের ভেতর বসে নীরব মনে সেই মূল্যবান কথাগুলো শুনছেন। শামিয়ানা ভেদিয়ে খানিক পর পর টুপটুপ করে ঝরে পড়ছে জমে থাকা শিশিরের বড় বড় ফোঁটা। বক্তার বক্তব্য শুরু হলে তখন আমাদের কোনো মাতব্বরি চলত না মঞ্চে, তাই মঞ্চের দায়িত্বরত ছাত্ররা ছাড়া বাকিরা বেরিয়ে এসে আশপাশের মেলা সমান দোকানপাটে ঘোরাঘুরি করতাম। সেই দোকানপাটে পাওয়া যেত বিভিন্ন রকম খেলনা- আমি ঘুরে ঘুরে কেবল লাল সরু আলোবিশেষ একটা টার্গেট লাইট কিনতাম। সেই টার্গেট লাইটের সাথে দিত কাশির ট্যাবলেটের মতো চ্যাপ্টা চ্যাপ্টা তিনটি ব্যাটারি আর বিভিন্ন প্রাণীর ছাপ বসানো কয়েকটি ল্যান্স। সেসব ল্যান্স পাল্টে পাল্টে লাগিয়ে, ওজুুখানার সাদা দেয়ালে টার্গেটের লাল আলো ফেলে আমি হাতি ঘোড়া আর প্রজাপতির প্রতিচ্ছবি দেখতাম। আরো দেখতাম লাল পরীর দুই পাখনা কিভাবে দুই দিকে মেলে আছে পাখির মতো।
সেইবার মাহফিলের দিনে হিম বাতাস বইছিল বিরতিহীন- সারাদিন রোদের দেখা ছিল না একটুও। মাহফিল চলছিল নিয়মানুসারে। শীতের রাত, তখন ১০টা বেজে ৪৫ মিনিট। আমাদের ঘিরে রেখেছে হিম বাতাস। কথা বললেই আমাদের মুখ দিয়ে বের হয় চাক চাক সাদা ধোঁয়া। দূর দিগন্তের যতদূর দেখা যায় শুধু কুয়াশা আর কুয়াশা। গাছের তলা কুয়াশায় ভেজা, শিশিরের অজস্র বিন্দু জমে আছে মাঠের বিছানো ঘাসে, ঝোপঝাড়ের মাথায় আর মাকড়সার বায়ুপায়ী জালে। সেই বিশাল কুয়াশার প্রান্তর ছুঁয়ে একটা সাদা প্রাইভেট কার দু’টি কমলারঙা আলোর লাইট জ্বালিয়ে এসে উপস্থিত হলো মাদরাসা থেকে একটু দূরে- মাঠের একপাশে। আমরা বুঝতে পারলাম; মাহফিলের প্রধান বক্তা, প্রধান মেহমান এসে গেছেন। আমাদের তখন আনন্দ আর উচ্ছ্বাসের শেষ নেই। স্বেচ্ছসেবকের মতো ভিড় ঠেলে প্রধান বক্তাকে আমরা মেহমানখানায় নিয়ে এসে বসতে দিলাম।
সময় গড়িয়ে যায়। অবশেষে প্রধান মেহমানের মূল্যবান কথা বলার পালা। তিনি আস্তে আস্তে এগিয়ে যান মঞ্চের দিকে। মঞ্চে উঠে নরম সোফায় বসেছেন- শ্রোতারা আরো আরো উৎসুক, আগ্রহ নিয়ে তার দিকে তাকাচ্ছে বারবার। মেহমান খুতবা পাঠ শুরু করে এক লাইন পড়েছেন মাত্র, এমন সময় শুরু হলো তুমুল ঝড়। শুরু হলো দৌড়াদৌড়ি। শ্রোতারা সব দৌড়ে যার যার বাড়িতে চলে যাওয়ার চেষ্টা করছে, আর মেহমান আবার সেই মেহমানখানায় ফিরে এসেছেন। তুমুল বাতাসে চির চির হয়ে পতাকার মতো পতপত করে উড়ছে প্যান্ডেলের শামিয়ানা আর পর্দাগুলো। মেলা সমান দোকানপাট থেকে আকাশের দিকে উড়ে যাচ্ছে গ্যাসের সাহায্যে ফোলানো লাল নীল হলুদসহ বিভিন্ন রঙের বেলুন। শ্রোতা আর মেহমানদের খাবার রান্না করার জন্য যেই চুলা জ্বালানো হয়েছিল, সেই জ্বলন্ত চুলার আগুন তুলার মতো উড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে বাতাসের সাথে। সবাই ভয়ে আকুপাকু করছে- তবে আমার ভালোই লেগেছিল সেদিনের ওমন লাগামহীন বাতাস আর সেসব উড়াউড়ি। বড় সুন্দর ছিল সেই দৃশ্য। ভয় ছিল না এমন নয়- আশঙ্কাভরা অনুভূতি। এই আশঙ্কার জাত আলাদা। হয়তো তা ভয়ও না- অন্য কোনো জগতের অনুভূতি।
লাগামহীন বাতাস এলোপাতাড়ি বয়ে এসে উড়িয়ে নিয়ে গেল একগাদা শুকনো পাতা। কোথাও থরোথরো কাঁপছে বুনোঝিঙের ফুল- বাতাসে দুলকে দুলকে দুলছে মাকড়সার জাল। আমি অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি আকাশের দিকে। অশরীরী হাওয়ায় আমার চিন্তাচেতনায় তখন বাস্তব আর অলীকের ভেদাভেদে জন্মাচ্ছিল প্রবল সন্দেহ। আমি ছাড়া সেই অবিশ্বাস্য কয়েক মিনিটের জোয়ার কেউ অনুভব করতে পেরেছিল কি না জানা নেই। সেসব স্মৃতি আজকাল লাল ফড়িঙের মতো হঠাৎ হঠাৎ আমি উড়তে দেখি- প্রবল ঝড় অথবা ধুলো উড়ার দিনে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা