২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`
দৃষ্টিপাত

আহতদের চিকিসা ও পুনর্বাসন

-

চিকিৎসা মানুষের মৌলিক অধিকার। এ অধিকার কারো দয়া দাক্ষিণ্যের বিষয় নয়; বরং রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত প্রত্যেকটি মানুষের মৌলিক অধিকার। এ অধিকার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। বিশেষ করে গত ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আগে ও পরের এক দফা আন্দোলনে সারা দেশে পুলিশ ও আওয়ামী সন্ত্রাসী কর্তৃক ছাত্র-জনতা থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ যারা আহত হয়েছেন তাদের সবার চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। ছাত্র-জনতার এ বিজয় অর্জন করতে গিয়ে কত মানুষ যে আহত হয়েছেন তার সঠিক পরিসংখ্যান আমাদের জানা নেই। সরকার পতনের পরও অনেক মানুষ আহত হয়েছেন। তবে আশার কথা হচ্ছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সাবেক জ্যেষ্ঠ সচিব মোহাম্মদ হুমায়ুন কবিরকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করেছে আহত ব্যক্তিদের সঠিক সংখ্যা বের করার জন্য। এটি একটি ভালো উদ্যোগ। আহত মানুষ এখনো ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও পঙ্গু হাসপাতালে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন, চোখের পানি ফেলছেন।
আমাদের দেশের চিকিৎসাব্যবস্থার মান কত উন্নত তা করোনাকালে চোখে আঙুল দিয়ে জানান দিয়েছিল। রাতারাতি চিকিৎসাব্যবস্থার উন্নয়ন হবে, এমনটি প্রত্যাশা করিনি। তবে যারা আহত হয়েছেন তাদের সঠিক চিকিৎসার জন্য যা যা করা দরকার তা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে করতে হবে। শুধু ঘোষণা দিয়েই যেন সব কিছু শেষ না হয়ে যায়। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আহতদের সবার চিকিৎসা ব্যয় সরকার বহন করবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সেবা বিভাগের সচিব মো: জাহাঙ্গীর আলম স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, সরকারি হাসপাতালে তাদের চিকিৎসা ব্যয় ও বেসরকারি হাসপাতালে আহতদের চিকিৎসা ব্যয় সরকার গ্রহণ করবে। কিন্তু বাস্তবে কতটুকু হচ্ছে তা খতিয়ে দেখা দরকার। মাঠপর্যায়ে সরকারের এ নির্দেশনা বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। অনেক ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচার ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যয় ভার আহতদের পরিবারকেই বহন করতে হচ্ছে। অনেকে প্রয়োজনীয় ওষুধটুকু ক্রয় করতে পারছে না। বিনাখরচে চিকিৎসা ব্যয় বলতে যা বোঝায় তা অনেক রোগীর ক্ষেত্রে ব্যত্যয় ঘটছে। এ বিষয়টিও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
পুলিশের ছোড়া রাবার বুলেট ও ছররা গুলিতে হাজারো মানুষ আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে শুধু চোখে আঘাত পেয়েছেন প্রায় ৫৫০ জন। তাদের মধ্যে কারো এক চোখ আবার কারো দুই চোখই হারিয়েছেন। এসব মানুষের যথাযথ চিকিৎসা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে না পারলে আল্লাহ তায়ালার আরশ কেঁপে উঠবে। যদিও সরকার আহত রোগীদের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে চিকিৎসার কথা বলেছেন। কিন্তু আমাদের সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসাব্যবস্থা কত উন্নত তা কম বেশি সবারই জানা আছে। সব আহত ও পঙ্গুত্ববরণকারী ব্যক্তিদের সঠিক চিকিৎসার স্বার্থে সারা দেশে সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে নির্ভুল তালিকা প্রণয়ন করা সময়ের দাবি। যেন কোনো আহত মানুষ বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ না করেন। বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে আহতদের চিকিৎসা বিল গ্রহণ না করতে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে- বেসরকারি হাসপাতালগুলো সরকারের এ আদেশ কতটুকু বাস্তবায়ন করছে তাও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। তবে আমরা এ ধরনের দৃশ্যমান কোনো খবর দেখিনি; বরং বিনা চিকিৎসার খবর এবং অর্থের অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছে না এমন খবরই বেশি মুদ্রিত হচ্ছে। সরকার বিনামূল্যের চিকিৎসার কথা বললেও অনেক ক্ষেত্রে বিনামূল্যে ওষুধ পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে আহত রোগীদের বাইরে থেকে ওষুধ কিনতে হচ্ছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে অনেকের দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসার প্রয়োজন হবে তখন তাদের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা। তারা যখন হাসপাতাল থেকে একটু সুস্থ হয়ে বাড়িতে ফিরে যাবে তখনো তাদের চিকিৎসার ব্যয়ভার করা প্রয়োজন। এ ব্যাপারে দ্রুত সুনির্দিষ্ট একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা জরুরি।
পরিবারের একজন ব্যক্তি হারিয়ে যাওয়া মানে পুরো পরিবারটি হারিয়ে যাওয়া। কারণ যার যায় সে বুঝে বিচ্ছেদের কী যন্ত্রণা! ৫ আগস্ট স্বৈরশাসক পতনে যারা জীবন দিয়েছেন, যারা আহত হয়েছেন, যারা পঙ্গুত্ববরণ করেছেন সেসব মানুষের জীবনকে ঘোর অন্ধকারে ঠেলে দেয়া মোটেও সুখকর হবে না। আহত বহু মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছেন। আমার পরিচিত একজন কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সে নরসিংদীর মাধবদীতে পুলিশের ছোড়া গুলিতে আহত হয়। এখন পর্যন্ত সে তার শরীরের ছোড়া গুলি খুলতে পারেনি। অর্থের অভাবে হাসপাতালে ভর্তি হতে পারছে না। এ রকম বহু আহত রোগী দেশের আনাচে-কানাচে রয়েছেন তাদের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত ও পুনর্বাসন করা প্রয়োজন। কারণ এ বিজয় রচনায় তাদের মুখ্য ভূমিকাকে অস্বীকার করার সুযোগ নেই। সুযোগ নেই তাদের তাজা রক্তকে অবজ্ঞা করার। আমরা তাদের ঋণ কোনো দিন শোধ করতে পারব না। তবে যারা শহীদ হয়েছেন, যারা আহত হয়েছেন, তাদের পরিবারের প্রতি সহমর্মিতার হাত প্রসারিত করতে পারি। তারা কোনো কিছু প্রাপ্তির আশায় এ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েননি। জাতির মুক্তি ছিল তাদের একমাত্র বাসনা। সে জন্য অকাতরে তারা জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন। সেসব শহীদ ভাইদের হত্যার বিচার দ্রুত সময়ের মধ্যে করা প্রয়োজন। যেন শহীদ ভাইদের রেখে যাওয়া স্বজনদের চোখের পানি আর না ঝরে। আমাদের সবারই মনে রাখা দরকার, এদের শুধু চিকিৎসা দেয়াই যথেষ্ট নয়; পুনর্বাসন করাও জরুরি।


আরো সংবাদ



premium cement