২১ নভেম্বর ২০২৪, ৬ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

ছলচাতুরির শেষ কোথায়!

-

বিশে^র দেশে দেশে আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এসেছে আমূল পরিবর্তন। মূল ধারার রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে ডালপালায় ভর করে ক্ষমতা দখল ও দীর্ঘস্থায়ী করতে অনেক দেশে নতুন নতুন অপকৌশলের আবির্ভাব ঘটতে দেখা যাচ্ছে। এ অপকৌশলের দাপটে মূল ধারার রাজনৈতিক ব্যবস্থার অন্তরালে স্থান করে নিচ্ছে ‘ভয়ের সংস্কৃতি, অবদমন ও ছলচাতুরি নামের অপরাজনীতি।’
বিশ্বের অনেক দেশে মূল ধারার রাজনৈতিক ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ায় সেখানে বিশৃৃঙ্খল অবস্থা বিরাজ করছে। বিপরীতে ভয়ের সংস্কৃতি, অবদমন ও ছলচাতুরি করে মূল ধারার রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করা হচ্ছে; যারা এমন কাজে লিপ্ত, তারা মনে করেন এসব করেই ক্ষমতা চিরস্থায়ী করা যাবে। তারা সত্যিকার অর্থেই বোকার স্বর্গে বাস করেন। কারণ এ ভয়ঙ্কর রাজনৈতিক অপকৌশলের ওপর যারাই আশ্রয় নিয়েছেন; তারাই ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন।
বর্তমানে অনেক দেশে ভয়ের সংস্কৃত জেঁকে বসায় ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র চরম মূল্য দিচ্ছে। আমরা দেখেছি, আরব বসন্তের সুফল আরববাসীর জীবনে পরিবর্তনের হাওয়া আনতে না পাড়লেও এর ফলে নতুন দিগন্তের সূচনা হয়েছিল। যার ধারাবাহিকতায় মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে গণতান্ত্রিক ধরা ধীর লয়ে হলেও একটু একটু করে শক্তিশালী হচ্ছে।
মূল ধারার রাজনীতিতে বিশ্বাসী নয়, এমন শাসকগোষ্ঠী রাষ্ট্রযন্ত্রকে নিজেদের ক্ষমতা দখল ও তা পাকাপোক্ত করতে ব্যবহার করে থাকে। আইন ও সংবিধানের তোয়াক্কা করেন না তারা। এভাবে তারা যখন অসাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করেন; তখনই সেসব দেশে জেঁকে বসে ভয়ের সংস্কৃতি, অবদমন ও ছলচাতুরি। ভয়ের মাত্রা কত যে ভয়ঙ্কর হতে পারে; ভুক্তভোগী ছাড়া তা কেউ অনুভব করতে পারবেন না। বিষয়টি অন্যের কল্পনাতে আসা দুষ্কর।
সাম্প্রতিক সময়ে দেশে দেশে রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে যে মাত্রায় ভয় দেখানো হচ্ছে; তা কোনোভাবেই শুভবুদ্ধির কারো কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। বিশ^ায়নের এ যুগে ভয়ের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে যেকোনো জাতি-রাষ্ট্রই গন্তব্যহীন হয়ে পথহারা পথিকের মতো চলতে চলতে একসময় খাদের কিনারে এসে দাঁড়াবে, এটিই নিয়তি। আর শাসকগোষ্ঠী জনগণ থেকে বিছিন্ন হয়ে পড়ে। রাষ্ট্রের মালিক জনগণ তাদের মৌলিক মানবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধহীন এক বিপজ্জনক ব্যবস্থার দিকে এগোতে থাকে।
স্বাভাবিকভাবে অবদমন বলতে আমরা বুঝি, কোনো ব্যবস্থাকে প্রস্ফুটিত হতে না দেয়া বা সমূলে মূলোৎপাটন করা। দেখা গেছে, একুশ শতকে দুর্বল গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে যত সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে উঠেছে; রাষ্ট্রযন্ত্রের মাধ্যমে নিষ্ঠুরভাবে অবদমন করা হয়েছে। ব্যতিক্রম শুধু আরব বসন্ত। কিন্তু আরব বসন্তের সুফল আরববাসী প্রকৃত অর্থে কাজে লাগাতে পারেননি। এখনো মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে নতুন নতুন মাত্রায় অবদমন চলছে। বেশির ভাগ দেশেই জনগণের ভোটাধিকার ভূলুণ্ঠিত। স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠী মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন যেকোনো সময় তীব্র রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপ নিতে পারে। অন্য দিকে দেশে দেশে বিরোধী দলের ওপর শাসকগোষ্ঠীর অত্যাচারের স্ট্রিম রোলার চালানোর ফলে বিরোধী দল ক্রমেই সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের দিকে ঝুঁকছে। এই পথেই মুক্তির স্বাদ নিতে চাইছে। তাই শাসকগোষ্ঠীও সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন অবদমন করতে হেন কোনো অপকৌশল নেই, যা প্রয়োগ করছে না। এমনি এক আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় আধুনিক বিশ্বের রাজনীতি প্রবহমান। তাই দেখা যাচ্ছে, ক্ষমতা নিষ্কণ্টক করতে স্বৈরাচারী শাসকরা ভয়ের সংস্কৃতি এবং ভিন্নমত অবদমন করছে নিষ্ঠুরভাবে। সেসব দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিনিয়ত ঘটছে গুম, খুন আর অপহরণ। আর নিজেদের এসব অপকর্ম ঠেকাতে আশ্রয় নেন ছলচাতুরির। এসব দেশ-কাল-সমাজ ও রাষ্ট্র ভেদে বিভিন্ন প্রকৃতির হয়ে থাকে; অর্থাৎ নতুন নতুন মোড়কে প্রয়োগ হতে দেখা যায়।
কোনো ঘটনা ঘটলে জনমনে অসন্তুষ্টি দেখা দিলে, সেই ঘটনাকে আড়াল করতে আরেকটি ঘটনা সামনে নিয়ে আসা হয়। অর্থাৎ সমস্যার সমাধান না করে জনগণের দৃষ্টি ভিন্ন খাতে প্রবহিত করাই এই ছলচাতুরির মূলধন। এতে ভুক্তভোগীরা দেশের প্রচলিত আইন ও মানবাধিকার থেকেও বঞ্চিত হয়ে থাকেন। কারণ সংবিধান, আইন, আদালত ও মানবাধিকার পিষ্ট করেই দেশে ছড়িয়ে দেয়া হয় ভয়ের সংস্কৃতি। এতে প্রথমে দুর্বল বিরোধী মতকে নিশ্চিহ্ন করতে সবার আগে টার্গেট করা হয়। ক্রমেই সব বিরোধী মতের গলা টিপে ধরা হয়।
উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোতে শাসকরা ছলচাতুরির আশ্রয় নেন বেশি। কারণ উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের নাগরিকরা মানবাধিকার, আইন ও ন্যায়ের শাসনের চেয়ে ফাঁকা উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় বেশি নির্ভর করেন। এ ধরনের ধামাচাপা কোনো দেশের আর্থরাজনীতির জন্য মঙ্গল বয়ে আনতে পারে না।
বিশাল জনসমষ্টির কোনো রাষ্ট্রে কোনো অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটবে না; এ রকমটি ভাব বাস্তবতাবিবর্জিত। কিন্তু অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারকাজে যখন রাষ্ট্রযন্ত্র সরাসরি হস্তক্ষেপ করে; তখন রাষ্ট্রের নাগরিকদের নাভিশ্বাস ওঠা স্বাভাবিক। তখনই জন্ম নেয় সামাজিক প্রতিরোধের। সুতরাং সামাজিক প্রতিরোধই হয় একমাত্র পথ ছলচাতুরি থেকে রাষ্ট্রের নাগরিকদের সংবিধান, মানবাধিকার, আইন ও ন্যায়ের শাসনের সুফল সম্পর্কে সচেতন ও উৎসাহিত করার। এর ব্যতিক্রম হলে জাতি-রাষ্ট্র কঠিন থেকে কঠিনতর সঙ্কটে পড়ে। তখন উত্তরণের পথ হয় আরো দুর্গম।
উন্নয়নশীল অনেক দেশে একটি বিপজ্জনক প্রবণতা লক্ষণীয়, ওই সব দেশে সুশীলসমাজের অনেকেই আজ সত্য ঘটনা বা সত্য কথা বলতে দ্বিধা করছেন। কারণ তারা মনে করেন কোনোভাবে জীবনটা অতিবাহিত করতে পারলেই হলো। ঝামেলার মধ্যে গিয়ে নিজের বিপদ ডেকে আনার কোনো মানে হয় না। এভাবে চলতে থাকলে আর যাই হোক রাষ্ট্রের বিপদ আরো ত্বরান্বিত হবে, নির্দ্বিধায় তা বলা যায়। তাই সচেতন সবাইকে গা বাঁচানো নীতি পরিহার করতে হবে।
যেকোনো রাষ্ট্রে শাসকগোষ্ঠী যদি নাগরিকদের সাথে ছলচাতুরি করে তা হলে জনমত, নির্বাচন ও আইন দিয়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। কল্যাণকর রাষ্ট্র গঠন করাও অসম্ভব। টালবাহানা না করে যত দ্রুত সম্ভব ধামাচাপা বাদ দিয়ে সংবিধান, আইন ও ন্যায়ের শাসন প্রতিষ্ঠা হওয়া উচিত আগামীর পথ চলার অবলম্বন।
দুর্বল গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার দেশগুলোতে নির্বাচনসংশ্লিষ্ট সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের ক্ষমতা প্রয়োগে বাধাগ্রস্ত হয়, ক্ষেত্রবিশেষে ক্ষমতা প্রয়োগে ইচ্ছুকও নয়। বরং ক্ষমতা অপপ্রয়োগ করার দৃঢ় মানসিকতায় বিভোর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তথা রাষ্ট্রযন্ত্র। এমন রাষ্ট্রযন্ত্রই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ক্ষমতার অংশী হয়ে হেন অপকর্ম নেই; যা করে না।
তাই যেসব দেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা দুর্বল; সেসব রাষ্ট্রে সব রাজনৈতিক দলকে, সুনাগরিককে, সুশীলসমাজের প্রতিনিধিদের, রাষ্ট্রযন্ত্র তথা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ভয়ের সংস্কৃতির অবসানকল্পে কাজ করতে হবে। কারণ পুলিশি রাষ্ট্র কোনো দেশের জন্যই কল্যাণকর নয়। এমনকি জনপ্রতিনিধিরাও তখন যথাযথ ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন না। কারণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্রযন্ত্র মনে করে জনপ্রতিনিধিদের তারাই নির্বাচিত করে থাকে। সুতরাং তারাই প্রকৃত ক্ষমতার মালিক মুক্তার বনে যায়। এমন অবস্থা যেসব দেশে বিদ্যমান, সেখানে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনকেই অবলম্বন করে রাজনৈতিক পালাবদল ঘটানোর বিকল্প কিছু নেই।
লেখক : শিক্ষক
সধযসঁফঁষলহঁ৭১@মসধরষ.পড়স


আরো সংবাদ



premium cement