অপরাধ প্রবণতা বনাম শাসনব্যবস্থা
- মাওলানা এরফান শাহ
- ২৭ অক্টোবর ২০২০, ০০:০০
রাষ্ট্রকাঠামো তিনটি ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। আইন, বিচার ও নির্বাহী বিভাগ। সরকারের দায়িত্ব রাষ্ট্রের এ তিন অঙ্গের সমন্বয় করা এবং বিভাগ তিনটিকে নিজস্ব গতিতে স্বাধীনভাবে চলতে সহযোগিতা করা। তাহলেই কেবল জননিরাপত্তা, মানবাধিকার, ন্যায়বিচার আর সুশাসন জাতিকে উপহার দেয়া সম্ভব। সরকার যদি একে একে সব ভিত্তি দলীয়করণের মাধ্যমে নিজের কব্জায় নিয়ে গুলিয়ে ফেলে, তাহলে রাষ্ট্রকাঠামো দুর্বল হয়ে পড়ে। এভাবে অযাচিত হস্তক্ষেপ, ক্ষমতার অপব্যবহার ও পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ চলতে থাকলে জননিরাপত্তা, সুশাসন, ন্যায়বিচার ও মানবাধিকার বলতে আর কিছু অবশিষ্ট থাকবে না।
কথায় বলে, ‘আইনের চোখে সবাই সমান’। অথচ বর্তমান বাস্তবতা হচ্ছে কোনো অপরাধ যতক্ষণ পর্যন্ত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল না হয়, ততক্ষণ প্রশাসনের ঘুম ভাঙে না। এক দিকে দলীয় সাইনবোর্ড ব্যবহার করে অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছে, অন্য দিকে বিরোধী দলের সাইনবোর্ড লাগিয়ে নিরপরাধ ব্যক্তিকে হয়রানি করা হচ্ছে। বিচারপ্রার্থীকে পদে পদে ঘুষ, মিথ্যা মামলা, নিরীহ মানুষকে হয়রানি, রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তি ও ক্ষমতার অপব্যবহার এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাবে ধরাকে সরা জ্ঞান এবং হেফাজতে পিটিয়ে হত্যার ঘটনাও ঘটছে। সরকারের উচ্চমহল থেকে রেড সিগন্যাল না এলে দলীয় অপরাধীরা গ্রেফতার হয় না। অতএব, শুধু আইন প্রণয়ন করলে হবে না, আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করতে হবে।
করোনা মহামারী শেষ হতে না হতেই দেশজুড়ে আরেক মহামারী দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে গণধর্ষণ! এ ছাড়া পুলিশি হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। এসবের প্রতিবাদে উত্তাল রাষ্ট্র। ফুঁসে উঠছে সাধারণ জনগণ। দেশজুড়ে চলছে বিক্ষোভ ও আন্দোলন। ছাত্রসমাজ রাজপথে নেমে পড়েছেন। মা-বোনরা তাদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন! সিলেট এমসি কলেজে গণধর্ষণ ও বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নির্যাতনে রায়হান আহমদের মর্মান্তিক মৃত্যু দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও নিন্দার ঝড় তুলেছে। বিশ্ব বিবেককে নাড়া দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এর বিরুদ্ধে মিছিল, মিটিং ও মানববন্ধন হয়েছে। রাজনৈতিক দল, আলেম-ওলামা, ছাত্রসমাজ, সুশীলসমাজ, ধর্মীয় ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছে।
রায়হানের মৃত্যুর বিষয়ে তার পরিবারের ভাষ্য, পুলিশ তাকে বন্দরবাজার ফাঁড়িতে ধরে নিয়ে গিয়ে ১০ হাজার টাকা ঘুষ দাবি করে। বলা হয় টাকা দিলে ছেড়ে দেয়া হবে। পরদিন মোবাইল ফোনে বিষয়টি জানার পর রায়হানের মা তার চাচাকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে ওই পুলিশ ফাঁড়িতে পাঠান। কিন্তু পুলিশ তা নিতে রাজি হয়নি। পরে ১০ হাজার টাকা নিয়ে যাওয়া হলেও ততক্ষণে নির্যাতনে রায়হানের মৃত্যু হয়। এ ক্ষেত্রে দু’টি গুরুতর অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। এক. ঘুষ দাবি এবং দুই. নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা। সঠিক তদন্তের মাধ্যমে এ ঘটনায় দায়ী ও দোষী ব্যক্তিদের বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যে জবাবদিহি ও আইনের ঊর্ধ্বে নয়; তা কিন্তু তাদের অনেকে ভুলতে বসেছেন। সরকারের উচিত তাদের বিষয়টি স্মরণ করে দেয়া। তাদের আগ্রাসী ও মোসাহেবী মনোভাব পরিত্যাগ করতে হবে। সেবক যদি শাসক হয় আর রক্ষক যদি ভক্ষক হয় জনগণ যাবে কোথায়? যাদের দায়িত্ব জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বিধান করা তারাই আজ জননিরাপত্তায় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে! তাদের হাতেই অনাকাক্সিক্ষত হত্যাকাণ্ড ঘটছে! রাষ্ট্রকে এ ধরনের অমানবিক ও মর্মান্তিক বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কঠোর হস্তে দমন করতে হবে।
বলা হয়ে থাকে, পুলিশ জনগণের বন্ধু। এ ধরনের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকাকে প্রশ্নবৃদ্ধ করে। গোটা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এসব ঘটনায় জড়িত না হলেও বাহিনীর গুটিকয়েক অসৎ সদস্যের কারণে সংশ্লিষ্ট বাহিনীর ভাবমর্যাদা ক্ষুণœ হচ্ছে। সরকার জনগণের আস্থা হারাচ্ছে আর রাষ্ট্র হচ্ছে কলঙ্কিত! সরকারের উচিত এ ধরনের উচ্ছৃঙ্খল সদস্যদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে থাকা অবস্থায় মৃত্যু রোধে দেশে আইন রয়েছে। নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন ২০১৩ অনুযায়ী এ ধরনের মৃত্যুর ঘটনায় মামলা করার সুযোগ আছে। কিন্তু আইন থাকলেও এর তেমন প্রয়োগ নেই; যে কারণে বারবার এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। এর কারণ এ ধরনের ঘটনায় মামলা করতে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো ভয় পায়। সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্র ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর উচিত এগিয়ে আসা। সিলেটে পুলিশ হেফাজতে রায়হানের মৃত্যুর ঘটনায় অবশ্য মামলা হয়েছে। জানা যায়, মামলাটি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনে স্থানান্তর করা হয়েছে। এ ছাড়া স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত চেয়ে উচ্চ আদালতে রিট করা হয়েছে। আমরা আশা করব এর মধ্য দিয়ে পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনায় রায়হানের পরিবার ন্যায়বিচার পাবে।
সিলেট এমসি কলেজে নববধূকে গণধর্ষণের পর নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে নারীকে বিবস্ত্র করে বর্বরোচিত নির্যাতনের রেশ কাটতে না কাটতেই আরো অনেক ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। রাজধানীতে ১৩ বছর বয়সী এক স্কুলছাত্রী, খাগড়াছড়িতে চাকমা মহিলা, বেনাপোলে দুই কিশোরী মেয়ে গণধর্ষণের শিকার হয়েছে। এসব ধর্ষণ কিংবা নারী নির্যাতনের ঘটনার পর দেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিছু সময় পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়। ফেসবুকে ঝড় ওঠে, বিক্ষোভ হয় এবং তার পর গতি হারায়। তবে কোনোটারই শেষ পর্যন্ত নিরপেক্ষ তদন্ত ও সুষ্ঠু বিচার সম্পন্ন হয় না। ফলে অপরাধ প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। অপরাধীরা অপরাধ করে পার পেয়ে যাচ্ছে।
এ পর্যন্ত যতগুলো ধর্ষণ ও ধর্ষণজনিত হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে তার যথাযথ বিচার সম্পন্ন হওয়ার নজির খুবই কম। এর কারণ চূড়ান্ত রিপোর্টে ঘাপলা, নয়তোবা সাক্ষ্য-প্রমাণ প্রভাবিত করে অপরাধীর পার পেয়ে যাওয়া এবং জটিল ও ব্যয়বহুল বিচারব্যবস্থা, গরিব ও অসহায় নাগরিকদের পক্ষে এ ব্যয়ভার বহন করা সম্ভব নয়। অনেক ক্ষেত্রে নির্যাতিতা বিচার চাইতে গিয়ে পাল্টা হুমকির সম্মুখীন হতে হয়। এ পরিস্থিতি থেকে আমাদের অবশ্যই বেরিয়ে আসতে হবে। শিক্ষা ও চিকিৎসাসেবার মত বিশেষ করে গরিব ও সাধারণ জনগণ যেন রাষ্ট্রীয় খরচে ন্যায়বিচার ও নিরাপত্তা সেবা পান তা নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। বলাবাহুল্য, ধর্ষণের আইন আছে ঠিকই তবে তার যথাযথ প্রয়োগ নেই বললেই চলে। আইন যারা প্রয়োগ করবেন তারা ওই আইনের পথে হাঁটেন না। কখনো অর্থের লোভ, কখনো রাজনৈতিক প্রভাব প্রতিপত্তি, কখনোবা হুমকি-ধমকিতে শুরুতেই গলদ দেখা দেয়। কখনো দলীয় লোকদের তোষামোদী ও রক্ষা করতে প্রশাসন উঠেপড়ে লাগে। মামলার চার্জশিট গঠনের সময় ফাঁকফোকর থেকে যায়। এসব কারণে আদালতের রায়ে ধর্ষিতা কিংবা ভিকটিম ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হন। এসব মামলার ক্ষেত্রে চার্জশিট গঠনের সময় কোনো ম্যাজিস্ট্রেট অথবা পুলিশের কোনো পদস্থ কর্মকর্তার নজরদারি করা অপরিহার্য। এ ক্ষেত্রে চূড়ান্ত রিপোর্টের সময় ভিকটিমের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা যেতে পারে। এতে চার্জশিট দাখিলের ক্ষেত্রে যে জটিলতা তৈরি হয় তা অনেকাংশে কমে আসবে।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) উদ্যোগে আয়োজিত আলোচনা সভায় বক্তারা বলেন, বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে দেশে ধর্ষণ বাড়ছে। স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমদ বলেন, বিচারহীনতার পরিবেশ তৈরি হওয়ায় দেশে ধর্ষণ বেড়েছে। সুজনের জাতীয় কমিটির সদস্য অধ্যাপক সি আর আবরার বলেন, ধর্ষণ, নারী নির্যাতন এমন পর্যায় চলে গেছে যে অপরাধীরা মনে করে যা ইচ্ছা তাই করা যাবে এবং রাজনৈতিক কারণে পার পাওয়া যাবে। সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ধর্ষণের মহামারী এখন সমাজের সর্বক্ষেত্রে বিরাজমান। সরকার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করেছে। তবে সবচেয়ে বড় কথা হলো বিচার হওয়া। বিচারে দীর্ঘসূত্রতা, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, রাজনৈতিক প্রভাব ইত্যাদি কারণে যথাযথ বিচার হচ্ছে না। বিচারহীনতার এ সংস্কৃতি দূর করে অপরাধীকে যথাযথ বিচারের আওতায় এনে শাস্তি দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। বিচার যদি দ্রুত না হয় এবং সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত না হয় তা হলে এ বিধান অর্থহীন হয়ে যাবে।
পারস্যের অমর কবি শেখ সাদীর একটি উক্তি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বলেছেন, তিনটি বস্তু তিনটি বস্তু ব্যতীত স্থায়ী হয় না। এক. জ্ঞান অনুশীলন ব্যতীত। দুই. ধন-সম্পদ ব্যবসা ব্যতীত। তিন. রাষ্ট্র শাসন ব্যতীত। অতএব, শাসনব্যবস্থা তথা বিচারব্যবস্থা যত আধুনিক, সহজ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও মজবুত হবে রাষ্ট্র তত বেশি অপরাধমুক্ত, নিরাপদ, বাসযোগ্য, শক্তিশালী ও উন্নত হবে।
লেখক : গ্রন্থকার
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা