নিরাপদ পানির নিশ্চয়তা কতটুকু
- নাজমুন্নাহার নিপা
- ১৪ জুলাই ২০২০, ০০:০০
পরিবেশের অন্যতম প্রধান উপাদান পানি। দিন দিন এই পানির চাহিদা বেড়েই চলছে। কিন্তু সেই পানি নিরাপদ না হলে তা জীবনের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। পানি ছাড়া এক দিনও চলা আমাদের পক্ষে অসম্ভব। আমাদের শরীরের দুই-তৃতীয়াংশই পানি, যা রক্তে ৮৩, হাড়ে ২২, মস্তিষ্কে ৭৪, পেশিতে ৭৫ ভাগ। অর্থাৎ শরীরের অভ্যন্তরীণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোর সঠিক কাজ সম্পাদনে পানির প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। প্রতিদিন পর্যাপ্ত পানি পান না করলে শরীর দ্রুত ক্লান্ত হয়ে পড়ে। পানির অভাবে আমাদের শরীরে পুষ্টি সরবরাহ ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ ব্যাহত হয়। পানি রক্তে ও কোষে অক্সিজেন ও অনান্য পুষ্টি উপাদান সরবরাহ করে। এ ছাড়া সারা শরীরের রক্ত সরবরাহ ও সঞ্চালন বৃদ্ধি পায় পানি পানে। পানি শরীরের তাপমাত্রাও নিয়ন্ত্রণ করে। পানি হজমশক্তি বাড়ায়, হজমপ্রক্রিয়া ঠিক রাখে। কেবল মানুষই নয়, প্রাণিকুলের স্বাভাবিক জীবনের জন্যও পানি প্রয়োজন।
প্রাপ্তবয়স্ক একজন মানুষের দৈনিক দুই থেকে তিন লিটার পানি পান করতে হয়। সুস্থ শরীর নিয়ে বেঁচে থাকতে পানি অন্যতম একটি নিয়ামক। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োটেকনোলজি ইনফরমেশনের গবেষণা অনুযায়ী, প্রতিদিন ৫০০ মিলিলিটার পানি পান করলে দেহের বিপাক প্রক্রিয়া ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পায় এবং দুই লিটার পানি পান করলে ৪০০ কিলোজুল শক্তি উৎপাদন হয়। আমরা প্রতিদিন ইউরিন, ঘাম, শ্বাস-প্রশ্বাস প্রভৃতির মাধ্যমে শরীর থেকে পানি হারায়। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, রাজধানীতে দৈনিক পানির প্রয়োজন ২২০ থেকে ২৩০ কোটি লিটার। ঢাকার পানি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান গড়ে দিনের চাহিদার পুরোটাই সরবরাহ করা হয়। তবে নগরবাসীর দীর্ঘ দিনের অভিযোগ, ওয়াসার পানিতে মাত্রাতিরিক্ত দুর্গন্ধ ও ময়লা থাকে। দীর্ঘ সময় ধরে ফোটানো হলেও কিছু এলাকায় সরবরাহকৃত পানি থেকে দুর্গন্ধ যাচ্ছে না, তা পানযোগ্যও হচ্ছে না।
ঢাকাসহ সারা দেশের সরবরাহকৃত পানির মান নিয়ে সম্প্রতি এক জরিপ চালায় বিশ্বব্যাংক। ওই প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বাসাবাড়িতে যে পানি সরবরাহ হয় সেখানে ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ প্রায় ৮২ শতাংশ। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের আদর্শ মানমাত্রা অনুযায়ী, পানীয় জলে শূন্য ই-কোলাই এবং শূন্য টোটাল কলিফর্ম থাকতে হবে। ভূগর্ভের পানি নানাভাবে দূষিত হতে পারে। এর মধ্যে অন্যতম একটি হলো বৃষ্টির পানির সাথে ভূপৃষ্ঠের দূষণ মিশ্রিত হয়ে ভূগর্ভে জমা হওয়া। অন্য দিকে ভূপৃষ্ঠস্থ পানি দূষণের কারণ অনেক, এর মধ্যে কয়েকটি হলোÑ বিভিন্ন কলকারখানার বর্জ্য পরিশোধন ছাড়া নিকটস্থ জলাশয়ে মিশে যাওয়া; বিশেষ করে নদীতে নির্গত করা, গৃহস্থালি ময়লা আবর্জনা পুকুর, খাল-বিল ও অন্যান্য জলাশয়ে নিক্ষেপ এবং পানিতে থালা-বাসন ধোয়া, মানুষ ও গবাদিপশুর গোসল, পাটের আঁশ ছাড়ানোর সনাতন পদ্ধতির কারণে পানি দূষিত হয়। প্রাকৃতিক কারণে পশুপাখি ও বিভিন্ন জলজ মৃত প্রাণী পানিতে মিশে পানি দূষিত হয়। এ ছাড়াও শহরের ড্রেনেজ লাইনের ময়লা আবর্জনা মিশ্রিত দূষিত পানি নদীতে মিশে পানি দূষিত হয়। পুরো পৃথিবী নিরাপদ পানির সঙ্কটে ভুগছে। ২৮টি দেশে নিরাপদ পানির অভাবের অবস্থা খুবই গুরুতর। ৩০ বছর পর পানির অভাবে দুর্গত লোকের সংখ্যা হবে দুই থেকে তিন শ’ কোটি।
এশিয়ান ওয়াটার ডেভেলপমেন্ট আউটলুক-২০১৬ শীর্ষক এক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ৪৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশে নদীর পানি সবচেয়ে বেশি দূষিত হচ্ছে আর নদী অববাহিকাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে অবনতি হয়েছে নেপাল, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত গঙ্গা অববাহিকার পানি। প্রতিবেদনটিতে আরো বলা হয়েছে, পানি নিরাপত্তার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ঝুঁকিপূর্ণ। এ দেশের মাটির উপরের ও নিচের দুই ধরনের পানির অবস্থাই খারাপ। বাংলাদেশে ভূগর্ভের পানি উত্তোলনের প্রবণতা অনেক বেশি। এ দেশে প্রতি বছর ৩০ দশমিক ২১ ঘন কিলোমিটার পানি উত্তোলন করা হয় ভূগর্ভ থেকে, যার ৮৬ শতাংশ ব্যবহৃত হয় কৃষিকাজে, বাকি ১৩ শতাংশ গৃহস্থালি কাজে এবং ১ শতাংশ পানি শিল্পের কাজে ব্যবহৃত হয়। পরিবেশগত ঝুঁঁকি বৃদ্ধির একটি অন্যতম কারণ হচ্ছে ভূগর্ভ থেকে ব্যাপক হারে পানি উত্তোলন।
জলবায়ু পরিবর্তনে আগামীতে এক ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে চলেছে। এর ফলে পানির সঙ্কট আরো তীব্রতর হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। প্রচলিত পানির উৎসগুলো আর্সেনিক, আয়রন, ব্যাকটেরিয়াসহ বিভিন্ন ধরনের দূষণের শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত। ফলে পানির গুণগতমান নিশ্চিত করাও একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পানির অপর নাম জীবন হলেও যদি সেটা দূষিত হলে নানা রোগের কারণ হয়ে থাকে। দূষিত পানি পান করার কারণে সম্প্রতি পানিবাহিত রোগের প্রকোপ বেড়েছে।
প্রতি বছর বিশ্বের প্রায় ৩১ লাখ মানুষ দূষিত পানি পান করায় নানা রকম রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। এদের প্রায় ৯০ শতাংশই পাঁচ বছরেরও কম বয়সের শিশু। বিশ্বে প্রতি ১৫ সেকেন্ডে একজন করে শিশু পানিবাহিত রোগে মারা যায়। হেপাটাইটিস, টাইফয়েড, ডায়রিয়া, কলেরা, আমাশয়, জন্ডিসের মতো ব্যাধির উৎস দূষিত পানি। দূষিত পানি থেকে ক্যান্সারের মতো মারাত্মক রোগও হতে পারে এমনই তথ্য দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োটেকনোলজি’। সংস্থাটির মতে, দূষিত পানিতে এমন কিছু রাসায়নিক আছে, যা মানুষের প্যানক্রিয়াসের কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেয়। ফলে ইনসুলিনের স্বাভাবিক নিঃসরণ বন্ধ হয়ে মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়। দীর্ঘ দিন দূষিত পানি ব্যবহারের কারণে শরীরে টক্সিন (বিষাক্ত পদার্থ) জমা হয়, যা বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেয়। দূষিত পানির ফলে কিডনি রোগ, দীর্ঘমেয়াদি লিভার সমস্যা এবং চক্ষুরোগী বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে স্মরণ রাখতে হবে, বিশুদ্ধ পানির নিশ্চয়তা দিতে না পারলে জনস্বাস্থ্যকে হুমকিমুক্ত করা যাবে না। নিরাপদ পানি পানে পানি পরিশোধনের বিকল্প নেই। পুকুর, কুয়া, খাল ও অন্যান্য ছোট জলাশয়ে যেখানে বাহ্যিক কোনো দূষণ নেই এমন পানিকে ছেঁকে নিয়ে ফিটকিরি দিয়ে পরিষ্কার করা যায়, এভাবে দ্রবীভূত অবাঞ্ছিত উপাদান যেমনÑ ফাইটোপ্লাংকটন তলানি আকারে জমা হয়। এ ছাড়া বর্তমানে পানি নিরাপদ করতে এক ধরনের বড়ি ব্যবহার করা হয়, যা হ্যালোজেন ট্যাবলেট বা হ্যালোট্যাব নামে পরিচিত। পানির জীবাণু ধ্বংস করতে ক্লোরিন বহুল ব্যবহৃত একটি রাসায়নিক। একবিংশ শতাব্দীর এই যুগে পানি বিশুদ্ধকরণের অনেক অত্যাধুনিক পদ্ধতি রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি হলো আলট্র্রাভায়োলেট রিভার্স ওসমোসিস প্রযুক্তি। পরিষ্কার ও স্বচ্ছ পানি জীবাণুমুক্ত করতে অতিবেগুনি বিকিরণ কার্যকরী একটা পদ্ধতি। জাতিসঙ্ঘের ৪৭তম সাধারণ পরিষদে সতর্কবাণী হিসেবে বলা হয়েছে, বিশ্ববাসী, পানি সাশ্রয় করুন, যুক্তিযুক্তভাবে তা ব্যবহার করুন এবং পানিসম্পদ সুরক্ষা করুন।
আমাদের দেশে নিরাপদ পানির সমস্যা নগরে ও গ্রামে সবখানেই রয়েছে। হাওর ও সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলে পানি সমস্যা নিরসনে নজর দেয়া উচিত। এ ছাড়া একটি বড় বিষয় হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নিরাপদ পানি নিশ্চিত করা। কারণ শিক্ষার্থীরা দিনের একটি বড় সময় সেখানেই কাটায়। ২০০৬ সালের পর আর্সেনিকমুক্ত টিউবওয়েল চিহ্নিতকরণের কাজ এখন কতটা গতিশীল সে দিকে গুরুত্ব দেয়া দরকার। তবে সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, সবার মধ্যে নিরাপদ পানি ব্যবহারে সচেতনতা সৃষ্টি করা। নিরাপদ পানির অপর নাম জীবন এটি বোঝাতে হবে সবাইকে। এটা নিয়ে ভাবা জরুরি হয়ে পড়েছে। তাই নিরাপদ পানি পান ও ব্যবহারে দেশের মানুষকে সচেতন করা একটা বড় বিষয়। নিরাপদ পানি নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। যত দিন যাবে ততই নিরাপদ পানির সমস্যা বাড়বে। আর এ সমস্যা সমাধানযোগ্য। আমরা যার যার অবস্থান থেকে সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ করলেই এ সমস্যার সমাধান হবে।
লেখক : শিক্ষার্থী, কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল
[email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা