০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৩ মাঘ ১৪২৩১, ৬ শাবান ১৪৪৬
`

ছাত্ররাজনীতি নিয়ে ভাবনা

-

রাজনৈতিক আন্দোলন ও রাজনীতির চর্চায় ছাত্রসমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণ করা উচিত কি না, তা নিয়ে বিতর্ক দীর্ঘ দিনের। ছাত্ররাজনীতির নামে শিক্ষাঙ্গনে অনভিপ্রেত সন্ত্রাস, হানাহানি, চাঁদাবাজি, মাস্তানি ইত্যাদি আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় অনেকে এটি বন্ধের দাবি তুলেছেন, কিন্তু এ দাবি যে সবাই সমর্থন করছেন তা কিন্তু নয়। যারা সমর্থন করছেন না, তাদের মতে মাথাব্যথার সমাধান মাথা কেটে ফেলা নয়, ব্যথা সারানো। তাদের অভিমতÑ দোষ রাজনীতির নয়, রাজনীতির নামে যে মারাত্মক ভাইরাস ছাত্রসমাজকে আক্রান্ত করেছে সেটি নির্মূলই সবার প্রচেষ্টার লক্ষ্য হওয়া উচিত। এই বিতর্কে কারা জয়ী হবেন তা আমাদের জানা নেই। কিন্তু শিক্ষাঙ্গনে রাজনীতির ছত্রছায়ায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সচেতন নাগরিকদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। এমন এক সময় ছিল যখন আমাদের দেশের ছাত্রসমাজ পড়াশোনাকে তপস্যা হিসেবে গ্রহণ করেছিল। তখনকার কৃষিনির্ভর জীবনযাত্রায় রাজনীতি সাধারণ সমাজের বিষয় ছিল না। রাজনীতির সাথে সম্পর্ক রাখা না রাখা জনজীবনে তেমন প্রভাব ফেলত না। বর্তমান সময়ে রাজনীতি বিশে^র চালিকাশক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষের আর্থসামাজিক জীবনে এমনকি শিক্ষা-সংস্কৃতি-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও রাজনীতি সর্বব্যাপী প্রভাব ফেলেছে। বিশ শতকের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ সময় পৃথিবীজুড়ে সমাজতন্ত্র ও পুঁজিবাদের ভাবাদর্শগত লড়াই বিশ্বকে আলোড়িত করেছে। পাশাপাশি ঔপনিবেশিক দেশগুলোতে চলেছে সাম্রাজ্যবাদী শোষণ, নিপীড়ন। পরাধীনতার হাত থেকে মুক্তির লড়াইও চলেছে সমানতালে। ফলে ঔপনিবেশিক ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সমাজের সচেতন ও সংগ্রামী অংশ হিসেবে ছাত্রসমাজ রাজনৈতিক সংগ্রামে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে।
আমাদের দেশের ছাত্রসমাজ ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, ৬ দফা ও ১১ দফার আন্দোলনে এবং রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেছে। আজকের বিশে^ কেবল উন্নয়নশীল দেশের ছাত্ররা রাজনীতিতে অংশ নিচ্ছেন তা নয়, ইংল্যান্ড, আমেরিকা, ফ্রান্স, জার্মানির মতো উন্নত দেশেও ছাত্ররা রাজনৈতিক আন্দোলনে সম্পৃক্ত হচ্ছেন। অবশ্য তাদের সাথে আমাদের ছাত্ররাজনীতির তফাৎ আকাশ-পাতাল। ইংল্যান্ড-আমেরিকায় ছাত্রদের রাজনীতিতে মুখ্য স্থান নিয়েছে যুদ্ধবিরোধী মানবতাবাদী ভূমিকা। ফান্স, ইতালি, জাপানে ছাত্র আন্দোলনের চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছে সমাজ বিপ্লবের ভাবাদর্শ। আর আমাদের দেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় দলগুলো সমাজের অগ্রসর অংশ হিসেবে ছাত্রসমাজকেই ক্ষমতায় যাওয়ার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। রাজনৈতিক ভাবাদর্শ কিংবা স্বার্থের প্রভাব বলয়ে আনতে ছাত্রদের সংগঠিত করে থাকে। ফলে ছাত্রদের এক অংশ ভবিষ্যৎ নাগরিক হিসেবে, রাজনীতি সচেতন মননশীল ব্যক্তি হিসেবে গড়ে ওঠার পরিবর্তে রাজনৈতিক দলের ক্রীড়নকে পরিণত হচ্ছে। এসব নেতৃত্বে ত্যাগী রাজনীতিবিদের পরিবর্তে সুবিধাবাদী, স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি ও ধনীদের প্রাধান্য বেড়ে যাওয়ায় তারা জনগণের মতামতের চেয়ে জবরদস্তিমূলক পথে ক্ষমতা রক্ষা কিংবা দখলে সচেষ্ট। ফলে ছাত্রসমাজ এখন সুস্থ দেশ গঠনমূলক আদর্শবাদী রাজনীতির পথ থেকে খানিকটা বিচ্যুত। নীতিহীন উচ্ছৃঙ্খলতা, অনভিপ্রেত অনাচার, পরীক্ষায় দুর্নীতি, জঘন্য অপরাধপ্রবণতা, বিকৃত ও অশ্লীল অপসংস্কৃতিতে তারা প্রভাবিত হচ্ছে। কোথাও ছাত্ররাজনীতিতে উগ্রবাদকে উসকে দেয়া হচ্ছে। দেশের ক্ষমতাকেন্দ্রিক অস্থির রাজনীতির নেতিবাচক প্রভাব ছাত্রসমাজের মধ্যেও পড়ছে। ফলে ছাত্ররাজনীতির রুচিবিকার ঘটছে। স্বাধীনভাবে দেশব্রতী ভবিষ্যৎ নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠায় সুস্থ-সবল-উদ্দীপনাময় দিকনির্দেশনা এখন ছাত্রসমাজের সামনে অনুপস্থিত। তাদের শিক্ষা কেবল যেকোনো পন্থায় পরীক্ষা পাসের ও সার্টিফিকেট প্রাপ্তিতে পর্যবসিত হয়েছে। দায়িত্ব ও আনন্দের কাজে দেশ গঠন ও সমাজসেবায় ভূমিকা নেই বললেই চলে। সাংস্কৃতিক চর্চা, গ্রন্থাগার কার্যক্রম, খেলাধুলা, শিক্ষা সফর, নির্মল আনন্দ-বিনোদন ইত্যাদিতে তাদের পরিকল্পিতভাবে কাজে লাগানো হচ্ছে না।
এখন দেশের শিক্ষার্থীদের কাছে বরেণ্য ব্যক্তিদের আদর্শ হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে না। গণমাধ্যমের বদৌলতে মডেল তারকা, স্থূল নাটকের নায়ক-নায়িকা কিংবা অস্ত্রবাজ অ্যাকশন হিরোকে আদর্শ হিসেবে উপস্থাপিত করা হচ্ছে। অ্যারিস্টটল বলেছেন, মানুষমাত্রই রাজনৈতিক জীব। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, পূর্ণবয়স্ক নাগরিকের রাজনৈতিক দায়িত্ব যতটা, অপ্রাপ্তবয়স্কেরও ততটা হবে। একজন নেতার রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা যতটুকু; একজন অধ্যাপক ও গবেষকের ততটা কিছুতেই নয়। এ দিক থেকে বলা যায়, ছাত্রসমাজের সাধারণ রাজনৈতিক দায়িত্ব থাকলেও প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক দায়িত্ব তেমন নেই। অর্থাৎ তাদের যে রাজনৈতিক সচেতনতা দরকার তা পরোক্ষ। এই সচেনতার মূল লক্ষ্যÑ উপযুক্ত নাগরিক হিসেবে নিজেদের গড়ে তোলা। সেজন্য প্রয়োজন জ্ঞান অর্জন, চরিত্র গঠন, মনুষ্যত্বের সর্বাঙ্গীণ উদ্বোধন। দেশের ইতিহাস ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সাথে পরিচয় সাধন। ছাত্রজীবনের সুস্থ রাজনৈতিক সচেতনতা এ ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে। কিন্তু ছাত্রধর্ম থেকে বিচ্যুত হয়ে অসুস্থ, বিকৃত, পঙ্কিল সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক আবর্তে জড়িয়ে অনৈতিক পথে পা বাড়ানো ছাত্রজীবনের কাম্য হতে পারে না।
ছাত্রজীবনে প্রত্যক্ষ রাজনীতির চেয়ে যেসব কাজে ছাত্রছাত্রীদের আন্তরিকভাবে অংশগ্রহণ করা উচিত সেগুলো হলো দুর্গত ও বিপন্ন মানবতার সেবা, জনসেবা, গ্রামোন্নয়ন, নিরক্ষরতা দূরীকরণ, গরিব ও মেহনতি মানুষকে সহায়তা, জনস্বাস্থ্য রক্ষা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম, পরিবেশ সংরক্ষণ, বৃক্ষরোপণ ইত্যাদি। ভবিষ্যতে আমাদের ছাত্রসমাজ যেন জাতীয় স্বার্থে দেশপ্রেমিকের মহৎ দায়িত্ব মাথা পেতে নিতে পারে, সেজন্য শক্তি অর্জন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে গঠনমূলক রাজনীতি সম্পর্কে সচেতনতা অপরিহার্য নয়। কিন্তু জাতীয় জীবনে চরম মুহূর্ত না এলে ছাত্রদের সক্রিয় ও প্রত্যক্ষভাবে দলীয় রাজনীতির আবর্তে জড়িত না হওয়াই ভালো। দেশের কর্ণধার ও রাজনৈতিক নেতাদের কর্তব্য হবে ছাত্রদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার না করা, দলীয় রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত রাখা। হ


আরো সংবাদ



premium cement
শুধু কংক্রিটেই নয়, ফ্যাসিবাদের চিহ্ন আছে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার বাঁকে : ফজল আনসারী বন্ধ কোম্পানির শেয়ার নিয়ে কারসাজি থামাতে উদ্যোগ নেয়া হবে কবে ৩২ নম্বরের বাড়ি ভাঙ্গা নিয়ে যা বলছেন উপদেষ্টা ও অভ্যুত্থান সংশ্লিষ্টরা গাজাকে যুক্তরাষ্ট্রের মালিকানাধীন করার ট্রাম্পের প্রস্তাব যেসব দেশে সমালোচিত টিকটক করাকে কেন্দ্র করে যুবক খুন এমপি-মন্ত্রীর বাড়ি ভেঙে শহীদদের জন্য ভবন নির্মাণের দাবি হান্নানের পুঠিয়ায় যুব মহিলা লীগের সভানেত্রী গ্রেফতার চট্টগ্রামে শেখ মুজিবের ম্যুরাল ভাঙচুর নোবিপ্রবিতে মালেক উকিল হলের নামফলক ভেঙে ‘বিজয় ২৪’ নামকরণ শিক্ষার্থীদের ভোলায় তোফায়েল আহমেদের বাসভবনে আগুন জাবিতে শেখ মুজিবের ম্যুরাল ও গ্রাফিতি ভেঙ্গে দিল শিক্ষার্থীরা

সকল