গণতান্ত্রিকভাবে পররাষ্ট্র দখল
- এরশাদ নাবিল খান
- ২১ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০
২০১৪ সালে ইউক্রেনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল ক্রিমিয়া ভোটের মাধ্যমে বিচ্ছিন্ন হয়ে রাশিয়ার সাথে মিশে যায়। গণভোট দেয়ার আগে কিন্তু ইউক্রেনের শাসকরা বুঝতে পারেননি ক্রিমিয়া দখল করতে রাশিয়া তৈরি ছিল। দীর্ঘ দিন ধরে ক্রিমিয়ায় বসবাসকারী রুশপন্থীদের রাশিয়া এমনভাবে প্রলুব্ধ করে যে, ক্রিমিয়া ইউক্রেনের সাথে থাকবে না বেরিয়ে যাবে। এই প্রশ্নে ভোটের সিদ্ধান্ত যখন গৃহীত হয়; তখন রাশিয়ার পরিকল্পনা বুঝতে না পারলেও পরে ইউক্রেনের শাসকরা বিষয়টি জানতে পারেন। কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। ভোটগ্রহণের গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ক্রিমিয়াকে অধিগ্রহণ করে নেয় রাশিয়া।
গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে একটি রাষ্ট্র অধিগ্রহণ কথাটি বিদঘুটে শোনালেও রাজনীতির পরিহাসে কোনো কোনো দেশ তথা রাষ্ট্রের ভাগ্যে তাই ঘটেছে। গণতন্ত্র হচ্ছে জনগণের তথা জাতির ইচ্ছানুযায়ী দেশ চালানোর ব্যবস্থা। জাতির ইচ্ছানুযায়ী যদি একটি রাষ্ট্র চলে তা হলে অধিগ্রহণ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকার কথা নয়। কোনো জাতি নিজেকে অন্যের হাতে সঁপে দিতে চায় না; রাষ্ট্র অধিগ্রহণ সম্ভব কেবল তখনই, যখন একটি জাতির ইচ্ছার বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীন, ষড়যন্ত্রকারী ও জাতীয় বিশ্বাসঘাতকরা দেশের নাগরিকদের শাসন করতে চায়।
শুধু ভৌগোলিক আয়তন দিয়ে কোনো রাষ্ট্রের শক্তি বা সমৃদ্ধির সম্ভাবনাকে যাচাই করা যায় না। জাতীয় শক্তির বহু উপাদান রয়েছে। একটি অভাব অন্যান্য উপাদানের ভালো অবস্থা দিয়ে পুষিয়ে নেয়া যায়। ক্ষুদ্র জাপান আয়তনের বিচারে তার চেয়ে বহু গুণে বড় চীনকে বিংশ শতাব্দীর ত্রিশের দশকে রীতিমতো অস্থির করে রেখেছিল। সে সময় আয়তন ছাড়া শক্তি অন্যান্য উপাদান যথা মনোবল, জাতীয় চরিত্র, নেতৃত্বের গুণাবলি, উচ্চতর সামরিক সংগঠন, সামাজিক চরিত্র ইত্যাদি ক্ষেত্রে জাপান ছিল চীনের চেয়ে অনেক অগ্রসর। একইভাবে ক্ষুদ্র বেলজিয়াম নিজের চেয়ে অনেক বড় কঙ্গো কিংবা ব্রিটেন সারা পৃথিবীতে সাম্রাজ্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল। তাই শুধু আয়তন কোনো রাষ্ট্রের জন্য ক্ষুদ্রতার নির্ধারক হতে পারে না। কিন্তু গণতান্ত্রিক উপায়ে রাষ্ট্র দখলকারী একটি রাষ্ট্র, তার দালাল ও চরেরা দখলকৃত রাষ্ট্রের জনগণের মনে নিছক আয়তনগত ক্ষুদ্রতার ধারণা দিয়ে এমন একটি মনোজাগতিক অবস্থার জন্ম দেয়; যাতে তারা মনে করতে শুরু করে, জাতি ও রাষ্ট্র হিসেবে এত বিশাল একটি মারমুখী দেশের সামনে টিকে থাকা অসম্ভব, তাই স্বকীয়তা টিকিয়ে রেখে স্বাধীন দেশের নাগরিক থাকাটা অবাস্তব চেষ্টা। কখনো কখনো একটি জাতির মননে সাংস্কৃতিক হীনম্মন্যতা সৃষ্টি করা হয়। বিদেশী অঞ্চল, নগর ও প্রতিষ্ঠানকে রাষ্ট্রটির জাতীয় সাংস্কৃতিক আদর্শ বলে বদ্ধমূল ধারণা সৃষ্টি করা হয়।
সবচেয়ে ভয়াবহ যেটি তা হলো, যে রাষ্ট্রকে পদানত করা হবে, সেই ভূখণ্ডের অর্থনীতি যতখানি সম্ভব নিজের পক্ষে পরনির্ভরশীল করে তোলা; যাতে একসময় ওই রাষ্ট্রের জনগণ দখলদার রাষ্ট্রের সমৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক উন্নতিতে ভাগিদার হতে মনে মনে ভাবতে শুরু করে ওই রাষ্ট্রের সাথে মিশে গেলে হয়তো নিজেদের অর্থনৈতিক ভাগ্যের পরিবর্তন আসে। তারা বুঝতে চায় না, এপার আর ওপারের সমৃদ্ধি বা অর্থনৈতিক অবস্থার যে তারতম্য তা ওপারের অর্থনৈতিক উন্নতি নয়, ষড়যন্ত্রে সৃষ্ট এপারের অর্থনৈতিক অনুন্নয়নের ফল এবং ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করতে পারলে ওপারের চেয়েও এপার অধিক উন্নত ও সমৃদ্ধ হয়ে উঠতে পারে।
অর্থনৈতিক দুর্দশার চরমে না পৌঁছালে কোনো জাতিই পরাধীনতা মেনে নিতে চায় না। এরূপ চিন্তা করতে বাধ্য করার জন্য বৃহৎ রাষ্ট্রকে বহুবিধ ফাঁদ পাততে হয়। দরকার হলে নদীর গতি বন্ধ করে দিয়ে, গণহত্যার মতো পরিস্থিতি পর্যন্ত সৃষ্টি করতেও কসুর করে না।
বিভিন্ন উপায়ে দখলদার রাষ্ট্রটি ছোট দেশের জনগণের মনে নিজেদের আত্মরক্ষার ব্যাপারে চূড়ান্ত হতাশা, সাংস্কৃতিক দাসত্বে বস করে বৃহৎ রাষ্ট্র সম্পর্কে ভক্তিবাদ সৃষ্টির অব্যাহত কর্মসূচি হাতে নিয়ে থাকে। তখন ছোট রাষ্ট্রের নাগরিকরা পাগল হয়ে উঠেপড়ে লাগে বড় দেশের সাথে নিজেকে লীন করতে। তখন গণতান্ত্রিক উপায়ে তারা নিজেদের রাষ্ট্রকে প্রতিবেশী বা বৃহত্তর রাষ্ট্রের হাতে তুলে দেয়। বিংশ শতাব্দীর ত্রিশের দশকের শেষ দিকে নাৎসি জার্মানির মুখে নার্ভাস অস্ট্রিয়া যে নিজেকে তথাকথিত ‘রাখীবন্ধন’ চুক্তির মাধ্যমে জার্মানির হাতে তুলে দিয়েছিল, তা এরকম একটি পরিস্থিতির উদাহরণ।
তাঁবেদার সরকার কখনো যদিওবা গণরোষে পরাজিত হলেও তবু গণতান্ত্রিকভাবে অন্য রাষ্ট্র অধিগ্রহণ করা করা যায়। ঘুঁটিটা ঠিকমতো চাললে কাজ হাসিল হতে পারে। একটি ক্ষমতাসীন সরকার, বিশেষ করে তা যদি হয় নির্বাচিত এবং একনায়কমূলক তা হলে সেই দলের বিস্তৃতি, সাংগঠনিক শক্তি, অর্থনৈতিক ভিত্তি সব কিছুই অন্য যেকোনো দলের চেয়ে ব্যাপক ও শক্তিশালী হওয়ার কথা। সেই সরকার ক্ষমতা থেকে চলে গেলেও দলটির অবকাঠামো ও বলবান সংগঠনের শিকড় থেকে যায়। অন্য দিকে, নতুন সরকারের ছত্রছায়ায় অন্য দলগুলো হয়তো নিজেদের সংগঠনগুলোর ক্ষমতা বৃদ্ধির একটি সুযোগ পায়। কিন্তু দীর্ঘকাল ধরে একটি কর্তৃত্ববাদী সরকারের সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা ও জেঁকে বসা দলের সংগঠন ও শক্তির সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতার শক্তি তাদের পক্ষে স্বল্প সময়ে আয়ত্ত করা সম্ভব হয় না। এর সুযোগ নিয়ে দখলদার রাষ্ট্রের তাঁবেদার দলটি ভোটের মাধ্যমে ফের ক্ষমতায় আসতে পারে। তখন আবার তাঁবেদারি শুরু করে বা করতে পারে। কেননা তাঁবেদারিতেই নিজেদের কায়েমি স্বার্থ নিহিত থাকে। তাই জনগণের অনিচ্ছা সত্ত্বেও নির্বাচিত সরকারই অনেক সময় দেশকে পররাষ্ট্রের হাতে তুলে দিতে পারে। এমন নজির এশিয়ার সিকিম। দেশটির নির্বাচিত গণপরিষদ প্রতিবেশী রাষ্ট্রের কাছে সোপর্দ করে। ১৯৭৪ সালে এটি সম্ভব হয়, সিকিমের তখনকার নির্বাচিত গণপরিষদ প্রতিনিধিরা ছিল দুর্নীতিপরায়ণ, দেশপ্রেম বিবর্জিত, লোভী। হ
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা