০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৩ মাঘ ১৪২৩১, ৬ শাবান ১৪৪৬
`

ঘটে যাওয়া ঘটনা ও নির্লিপ্ততা

-

ভারত একটি বড় দেশ। আমাদের সবচেয়ে ‘ঘনিষ্ঠ’ বন্ধু রাষ্ট্র। সেই দেশে সাম্প্রতিক সময়ে যা ঘটছে; তা ভারতীয় সংবিধানের লঙ্ঘন বলে মনে করছেন দেশটির প্রতিবাদী মহল। ভারতের সংবিধানে ১৯৭৬ সালে ৪২তম সংশোধনীর মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষতা ধারাটি সংযুক্ত করা হয়। দেশটির সংবিধানের ১৫ ধারা অনুযায়ী, ধর্মের কারণে রাষ্ট্রের বৈষম্যমূলক আচরণ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ২৫(১) ধারায় বলা হয়েছে, প্রত্যেক নাগরিকেরই নিজের ধর্ম ঘোষণা, আচরণ ও প্রচার করার সমান অধিকার রয়েছে। ২৬ ধারায় আরো বলা হয়েছে, প্রতিটি নামধারী ধর্মগোষ্ঠীর অধিকার আছেÑ স্বতন্ত্রভাবে নিজ নিজ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নির্মাণ ও পরিচালনা করার এবং নিজেদের ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ ও পরিচালনার। নিজেদের সব ধর্মীয় বিষয় নিয়ন্ত্রণের এবং এ উদ্দেশ্যে স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি ক্রয় এবং পরিচালনার। সংবিধানে এমন ধারা সন্নিবেশিত থাকলেও ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর ভারতের হিন্দুত্ববাদীরা পাঁচ শ’ বছরের প্রাচীন বাবরি মসজিদ ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়। এটি নিয়ে কয়েক দশকের আইনি লড়াইয়ের পর গত ৯ নভেম্বর ভারতের সুপ্রিম কোর্টের সদ্য বিদায়ী প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈয়ের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চ বাবরি মসজিদের জায়গায় রামমন্দির তৈরির আদেশ দেন। এই রায়ে ভারতীয় বিচার বিভাগের সাবেক অনেক বিচারপতি এবং বিশিষ্ট নাগরিকরা স্তম্ভিত হয়েছেন। অনেকেরই ধারণা এটা হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র কায়েমের প্রচেষ্টা এবং সংখ্যালঘু মুসলমানদের ওপর চরম অবিচার। এ রায়ের প্রতিক্রিয়ায় ভারতের অনেকে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন।
ভারতীয় মুসলমানদের ওপর সবচেয়ে আঘাত এনেছে সম্প্রতি পাস হওয়া সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) আর এনআরসি। ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ঘোষণা দেন, প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে ভারতে চলে আসা হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, খ্রিষ্টানদের নাগরিকত্ব দেয়া হবে কিন্তু পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান থেকে যেসব মুসলমান এসেছে তাদের বের করে দেয়া হবে। তিনি কট্টর হিন্দুত্বের বার্তা দিয়ে বোঝাতে চেয়েছেন ভারত হবে একটি হিন্দু রাষ্ট্র। কিন্তু ভারত সরকারের এ পদক্ষেপ মেনে নিতে পারেননি দেশটির অনেক নাগরিক। এর বিরুদ্ধে তীব্র বিক্ষোভ হয়েছে ভারতজুড়ে। এখনো দেশটিতে এ নিয়ে চরম অসন্তোষ বিদ্যমানা। হিন্দু, মুসলমান সব শ্রেণীর মানুষই এর প্রতিবাদে রাজপথে নেমে এসেছেন।
ভারতের নতুন নাগরিকত্ব আইন ও এনআরসি বাস্তবায়ন হলে পাকিস্তান, আফগানিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশকে বেশি সঙ্কটে পড়তে হবে। কিন্তু আমাদের দেশের সরকার বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশ সরকার বিষয়টি ভারতের অভ্যন্তরীণ বললেও বিপুলসংখ্যক মানুষ বাংলাদেশে প্রবেশ করার আশঙ্কা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে সীমান্ত দিয়ে ভারত থেকে অনেক লোক বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করছেন। এমনিতেই মানবিকতার কথা বিবেচনা করে ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ যে সঙ্কট মোকাবেলা করছে; এরপর এনআরসি আর সিএএ’র কারণে ভারত থেকে লোক এলে তা হবে গোদের ওপর বিষফোঁড়া।
বহুবিধ সঙ্কটের অন্তর্জালে আবদ্ধ বাংলাদেশে নিজের অধিকার নিয়ে বেশির ভাগ সময় কথা বলতে পারছেন না নাগরিকেরা। এনআরসির কুফল বাংলাদেশে কতটা প্রভাব ফেলবে তা নিয়ে কথা বলা এখন স্পর্শকাতর একটি বিষয়। বললে কী পরিণতি হতে পারে তার জলজ্যান্ত উদাহরণ ডাকসুর ভিপি নুরু ও তার সঙ্গীরা। সুতরাং সাংবিধানিক বলি আর নিত্য সমস্যার কথাই বলি না কেন, সব ধরনের স্বাধীন মতবাদের ওপর এক ধরনের প্রচ্ছন্ন হুমকি কাজ করছে দেশে।
মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতি মুহূর্তে লাঞ্ছিত বঞ্চিত হচ্ছে; এটি নিয়ে কথা বলা যাবে না। ভোটের অধিকার রাতের আঁধারে লুণ্ঠিত হচ্ছে প্রতিবাদ করা যাবে না। ব্যাংক, শেয়ারবাজারের অর্থ গায়েব হয়ে যাচ্ছে, হিসাব চাওয়া যাবে না। দুর্নীতির বাহু কতটা প্রশস্ত হয়েছে তা রূপপুরের বালিশকাণ্ড, আর মেডিক্যালের পর্দাকাণ্ড থেকে অনুমান করা যায়। ক্যাসিনো-জুয়াড়ির তাণ্ডব সমাজের কত গভীরে প্রবেশ করেছে তা তো কিছু দিন আগে আমরা টের পেয়েছি। এখন তার নামগন্ধ পর্যন্ত নেই। চাল, ডাল, তেল, নুনসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আকাশছোঁয়া দাম হলেও কণ্ঠ নিচু করেই কথা বলতে হবে। পেঁয়াজ-লবণের দাম অস্বাভাবিকের চেয়েও অস্বাভাবিক কিন্তু কথা বলা যাবে না। বরং রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নির্বাহীর কাছ থেকে জাতি পেঁয়াজ না খাওয়ার পরামর্শ পেয়েছেন। হত্যা, ধর্ষণ, গুম, নিপীড়ন-নির্যাতনের মতো ঘটনা প্রতি মুহূর্তে ঘটছে। বিশ্বজিৎ থেকে খাদিজা, তনু থেকে নুসরাত, নুরু থেকে আবরারসহ কত মানুষই তো নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে; কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। বরং একটি ঘটনা আরেকটি বড় ঘটনাকে সুচারুভাবে ঢেকে দিচ্ছে।
ভারতে নতুন নাগরিকত্ব আইন ও এনআরসির বিরুদ্ধে জোরালো আন্দোলন হচ্ছে। এ আন্দোলনে সব শ্রেণীর নাগরিক শরিক হচ্ছেন। এ আন্দোলন অন্যায় ও অন্যায্য আইনের বিরুদ্ধে এবং সাম্য ও মৈত্রের পক্ষে। আন্দোলনকে প্রতিহত করতে সরকার রাষ্ট্রীয় বাহিনী ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে, ইতোমধ্যে ২৪ আন্দোলনকারী নিহত হয়েছেন। কিন্তু আন্দোলন দমাতে পারেনি। বরং এর তেজ দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। অধিকারের প্রতি সোচ্চার নাগরিকের গতিপথ কেউ রুদ্ধ করতে পারে না। সাংবিধানিক ও মানবাধিকার লুণ্ঠনের চেষ্টা করলে এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর অধিকার সাধারণ জনগণের আছে। ১৭৭৬ সালের ৪ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের যে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ঘোষিত হয়; সেখানে বলা হয়েছে, ‘সব মানুষকে সমান হিসেবে সৃষ্টি করা হয়েছে। বিধাতা তাদের কয়েকটি অপরিহার্য অধিকার দিয়েছেন; এগুলোর মধ্যে জীবন, স্বাধীনতা ও সুখের অন্বেষণ প্রধান। এ সব অধিকার নিশ্চিত করতে মানুষের মাঝে সরকার রয়েছে। সরকার শাসিতদের কাছ থেকেই ক্ষমতা লাভ করে। যখনই কোনো ধরনের সরকার জনগণের এসব অধিকার নিশ্চিত না করে বরং যদি ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায় তখন এ সরকারকে পরিবর্তন বা উৎখাত করার ক্ষমতা জনগণের রয়েছে।’
জনগণের কষ্টার্জিত অর্থে সরকার পরিচালিত হয়। সেই সরকার যখন জনগণের ওপর জুলুম করার চেষ্টা করে তখন জনগণের প্রতিবাদ করার অধিকার সাংবিধানিকভাবেই নিশ্চিত করা আছে। প্রতিবাদ না করলে জুলুম-নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যাবে, যা জনগণকেই সহ্য করতে হবে। ব্রিটিশ জনগণের ওপর রাজার নিষ্ঠুর নিপীড়ন-নির্যাতনের প্রতিবাদে ১২১৫ সালে ম্যাগনাকার্টা এবং ১৬৮৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিল অব রাইটস বা অধিকার আইন তৈরি করে রাজা জনগণের অধিকার এবং সার্বভৌমত্ব মেনে নিতে বাধ্য হন। যে আইনগুলো আজো ব্রিটিশ জনগণকে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সুরক্ষা দেয়।
আজ আমাদের সমাজে রাষ্ট্রীয় ছত্রছায়ায় প্রতিনিয়ত যে অন্যায়-অত্যাচার, জুলুম-নির্যাতন চলছে তা যদি নির্লিপ্ততায় মেনে নেই; এর ফলে যে ক্ষত সৃষ্টি হবে, তা অনিরাময়যোগ্য রোগে পরিণত হবে। এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের মতো ও পথ আমাদের এখনই তৈরি করতে হবে। এর ব্যর্থতার কুফল আমাদের বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বয়ে বেড়াতে হবে; যা আমাদের নির্লিপ্ততার ফল বৈ কিছু নয়। হ
[email protected]

 


আরো সংবাদ



premium cement
মার্কিন জাহাজকে পানামা খালে টোল দিতে হবে না নবাবগঞ্জে তাফসিরে যাচ্ছেন মিজানুর রহমান আজহারি শেষ মুহূর্তের গোলে সেমিফাইনালে রিয়াল মাদ্রিদ নোয়াখালীতে জামায়াতের কর্মী সমাবেশ প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী হলেন সাংবাদিক মনির হায়দার শেষ কার্যদিবসে লেনদেন শুরু উত্থান দিয়ে ডেভিড বিসলির ও রবার্ট এ ডেস্ট্রোর সাথে বিএনপি প্রতিনিধির দলের সাক্ষাৎ শৈলকূপায় মহাসড়কে টায়ার ফেটে বাসে আগুন নিকারাগুয়ায় অভিবাসীবাহীদের নৌকাডুবিতে শিশুসহ মৃত্যু ৫ ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের হুমকিতে কতটা উদ্বিগ্ন ভারত শুধু কংক্রিটেই নয়, ফ্যাসিবাদের চিহ্ন আছে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার বাঁকে : ফজল আনসারী

সকল