রাজধানীতে ভিক্ষাবাণিজ্য
- আজিম উদ্দিন
- ৩১ ডিসেম্বর ২০১৯, ০০:০০
ভিক্ষুকের থাকতে হয় বিশেষ যোগ্যতা! কী সেই যোগ্যতা? তা হলো মানুষের সহানুভূতি পাওয়ার যোগ্যতা। এ যোগ্যতা থাকলেই ‘দক্ষ ভিক্ষুক’ হয়ে উঠতে পারে কেউ। ভিক্ষুক সমাজে তার কদর অকল্পনীয়। যে নিজের অসহায়ত্ব সবার সামনে মুন্সিয়ানার সাথে উপস্থাপন করতে পারে; সে ভিক্ষাবৃত্তিতে তত উন্নতি করে। ভিক্ষার মূল পুঁজি সহানুভূতি আর ধর্মীয় অনুভূতি। তবে বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে ভিক্ষাবৃত্তি নিষিদ্ধ। এরপরও অনেক সময় অসহায়, দুর্বল, দরিদ্র ও পঙ্গুরা ভিক্ষাবৃত্তিতে জড়িয়ে পড়েন অপছন্দনীয় হওয়া সত্ত্বেও। অপমানকর হলেও পুনর্বাসন আর ভরণপোষণের ব্যবস্থা না থাকায় তারা ভিক্ষা করতে বাধ্য হন। কিন্তু এ ধরনের ভিক্ষুকের সংখ্যা এখন খুবই কম। কয়েক দশক ধরে রাজধানী ঢাকায় গড়ে উঠেছে চক্রের মাধ্যমে ভিক্ষাবৃত্তি। রীতিমতো এটিকে অনেকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। চক্রের অধীনে না এলে ঢাকায় ভিক্ষা করা এখন কঠিন।
সামাজিক জীবনে কোনো আত্মমর্যাদার অধিকারী অন্য কারো কাছে হাত পাততে পারেন না। স্বীয় মান-মর্যাদা অকারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়; এমন কাজ পারতপক্ষে কেউ করতে চান না। অথচ আজকে আমাদের সমাজে ভিক্ষাবৃত্তি দিন দিন আরো বেড়েই চলেছে। রাস্তাঘাট, অলিগলি সবখানেই আছে দুষ্টচক্রের অধীনে ভিক্ষায় নিয়োজিত ভিক্ষুকরা।
২০১০ সালে একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, নবজাতক শিশুদের অপহরণ করে এনে ছয় মাসের বেশি সময় ধরে পাতিলে ভরে রেখে বিকলাঙ্গ বানানো হয়, আবার কারো হাত-পায়ের রগ কেটে বা কব্জি কেটে তাদের নামানো হয় ভিক্ষাবৃত্তিতে। এমন নির্মম ও বর্বর ঘটনাটি ঘটে রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরে এক প্রভাবশালীর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ক্লাবঘরে। এসব চক্রের সাথে সখ্য আছে প্রশাসনের একশ্রেণীর কর্মচারীর। ২০১৬ সালে রাজধানীতে এ ধরনের অপরাধে জড়িত দুই হোতা র্যাবের হাতে গ্রেফতার হওয়ার পর তাদের স্বীকারোক্তিতে প্রকাশ পেয়েছে গা শিউরে ওঠা সব তথ্য। নবজাতক শিশু থেকে শুরু করে চলাচলে অক্ষম বৃদ্ধদেরও ভিক্ষাবৃত্তিতে ব্যবহার করছে এই অপরাধী চক্র। শুধু বেঁচে থাকা বা পেটের দায়ে নয়, ভিক্ষা করে বা ভিক্ষুকদের ব্যবহার করে বাড়ি-গাড়ি করার নজিরও রয়েছে।
সমাজকল্যাণ অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, রাজধানীতে নিয়মিত ভিক্ষুক রয়েছেন প্রায় ৫০ হাজার। তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, বর্তমানে এ সংখ্যা অন্তত দুই লাখ। এক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রতিদিন রাজধানীতে প্রায় ২০ কোটি টাকার ভিক্ষাবাণিজ্য হয়ে থাকে। মাসে এই ভিক্ষার টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় ৬০০ কোটি টাকা। সঙ্ঘবদ্ধ ভিক্ষুক চক্র আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কিছু সদস্য ও এলাকাভিত্তিক অনেক প্রভাবশালীকে ম্যানেজ করে চালায় বলে ভিক্ষাবাণিজ্য বন্ধ হচ্ছে না।
রাজধানীর রামপুরা, বাড্ডা, বেইলি রোড, ফার্মগেট, আজিমপুর, হাইকোর্ট মাজার, মতিঝিল, কমলাপুর, ওয়ারী, ডেমরা, যাত্রাবাড়ী, মিরপুর, শ্যামলী, গাবতলী ও উত্তরাসহ অন্তত ২০টি পয়েন্টে কাজ করছে এ চক্র। তাদের বিভিন্ন নামে রয়েছে নিজস্ব অফিস, আছে ভিক্ষুক কল্যাণ সমিতি নামে অন্তত ৫০টি সংস্থা। এসব সমিতিতে প্রতিদিন ভিক্ষুকদের জমা দিতে হয় ৩০-৪০ টাকা। ভিক্ষা শুরুর আগে ২০০-৩০০ টাকা দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করতে হয় ভিক্ষুক কল্যাণ সমিতিতে। একেকটি চক্রের আওতায় রয়েছে ৩০০ থেকে দুই হাজার ভিক্ষুক। কয়েকটি সমিতি সূত্রে জানা গেছে, একজন ভিক্ষুকের দিনে গড়ে আয় ৩০০ টাকা। প্রতিদিন ৫০ হাজার থেকে শুরু করে বড় সমিতিতে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত জমা হয় চক্রের আওতায়।
রামপুরার ভিক্ষুকদের দালাল জানান, ১৫ বছর আগে চাকরির সন্ধানে রাজধানীতে আসেন তিনি। তারপর একজনের মাধ্যমে ভিক্ষুকদের দালালির কাজে যোগ দেন। ১০০ টাকা রোজ কাজ শুরু করে এখন তার আয় প্রতিদিন ৪০০-৫০০ টাকা। তিনি আরো জানান, প্রভাবশালী ব্যক্তিরাই এসব চক্রের পেছনে রয়েছেন। এলাকাভিত্তিক ২০-৩০ জনের কমিটি এসব ভিক্ষুক নিয়ন্ত্রণ করে। এসব চক্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে ভিক্ষুকরা জানান, ভিক্ষাবৃত্তি ঘিরে চলে চাঁদাবাজিও। অন্তত ৩০০ পয়েন্টে একজন করে লাইনম্যান ভিক্ষুকদের নিয়ন্ত্রণ করেন।
কয়েকজন ভিক্ষুক জানান, খিলগাঁও ডিসিসি মার্কেট এলাকা থেকে নিয়ন্ত্রণ করে ভিক্ষুকদের একটি চক্র। ২০ জনের একটি চক্র ভিক্ষাবাণিজ্যে জড়িত। বাড়তি আয়ের লক্ষ্য নিয়ে তারা নানা প্রলোভনে দেশের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে নারী-পুরুষ ও শিশুদের অগ্রিম টাকা দিয়ে ঢাকায় নিয়ে আসেন। ভিক্ষার অর্ধেক টাকা দিতে হয় এ চক্রের তহবিলে। এ টাকায় তাদের নিরাপত্তা ও ভিক্ষার জায়গার নিশ্চয়তা মেলে। ক্ষেত্রবিশেষে ভিক্ষার পয়েন্ট সুরক্ষিত থাকে। তবে ভিক্ষুকদের সারা দিনের আয়ের টাকা ভাগ-বাটোয়ারা হয় রাতে।
প্রতিদিন প্রতিটি পয়েন্টে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীকে পাঁচ হাজার ও স্থানীয় সন্ত্রাসীদেরও একটি বড় অঙ্কের চাঁদা দিতে হয় চক্রকে। দিন দিন ভিক্ষাবৃত্তি যেন পরিণত হচ্ছে লাভজনক বাণিজ্যে। পেশাদার ভিক্ষুকদের উৎপাতে অতিষ্ঠ নগরবাসী। রাজধানীর কিছু এলাকা ভিক্ষুকমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। তাতে কাক্সিক্ষত ফল মিলছে না। মানুষের মর্যাদাবোধ জাগ্রত করেই সম্ভব অমর্যাদাকর ভিক্ষাবৃত্তি রোধ করা। হ
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা