পারতপক্ষে বিদেশে চিকিৎসা নয়
- কাজী আশফিক রাসেল
- ৩১ ডিসেম্বর ২০১৯, ০০:০০
চীনা দার্শনিক কনফুসিয়াসের কাছে তার এক শিষ্য জানতে চেয়েছিলেন, ‘রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলিক উপাদানগুলো কী কী?’ জবাবে কনফুসিয়াস বলেছিলেন, ‘খাদ্য, নিরাপত্তা এবং জনগণের আস্থা অর্জন।’ শিষ্য পুনরায় জানতে চাইলেন, ‘দুর্যোগ মুহূর্তে জরুরি প্রয়োজনে রাষ্ট্রকে যদি কোনো কিছু উৎসর্গ করতে হয়, তবে সেটি কী?’ কনফুসিয়াস উত্তর দিয়েছিলেন, ‘জনগণের আস্থা যেন কখনো না হারায়।’ আমাদের দেশে চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি আস্থার সঙ্কট দৃশ্যমান। আমরা সবাই কমবেশি চিকিৎসাসেবা নিয়ে শঙ্কিত। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নানা রোগে আক্রান্ত অসংখ্য মানুষ চিকিৎসার উদ্দেশে অন্য দেশে পাড়ি দিচ্ছেন। উচ্চবিত্তরা সিঙ্গাপুর ও ব্যাংককে ছুটছেন; আর মধ্য ও নি¤œবিত্ত মানুষ যাচ্ছেন পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে। ফলে দেশ হচ্ছে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত এবং প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে আমাদের চিকিৎসা খাত। এ ক্ষেত্রে একটি প্রশ্ন আসতে পারে; তবে কি দেশের চিকিৎসকরা অযোগ্য? মোটেই তা নয়।
সম্প্রতি আমার দুই নিকটাত্মীয় সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর জখম হলে জরুরি ভিত্তিতে একটি সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। আমিও সেই সুবাদে হাসপাতালে বেশ কিছুদিন ছিলাম। আমাদের হাসপাতালগুলোর চিকিৎসাসেবার অপর্যাপ্ততা, সমন্বয়হীনতা ও অব্যবস্থাপনার কিছু বাস্তবচিত্র খুব কাছ থেকে দেখেছি। হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা সরঞ্জামের অপর্যাপ্ততা দেখে মনে হয়েছেÑ ‘ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সরদার।’ এ কথাটি এ দেশের ডাক্তারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি সঙ্গতিপূর্ণ। হাসপাতালগুলোতে ধারণক্ষমতার চেয়ে তিন থেকে চার গুণ রোগী বেশি থাকেন প্রতিদিন। বহির্বিভাগে সামর্থ্যরে চেয়ে তিন-চারগুণ বেশি রোগী দেখতে হয় চিকিৎসকদের। স্বাভাবিকভাবে সব রোগীর প্রতি যথাযথ মনোযোগ দেয়া সম্ভব হয় না। কোনো কোনো ডাক্তারের আচরণগত সমস্যা আছে, তা বিবেচনায় নিয়ে বলছিÑ ডাক্তাররা প্রতিদিন সামর্থ্যরে বাইরে পরিশ্রম করছেন। যোগ্যতার প্রশ্ন যদি আসে; তবে বলতে হয়, এই তো কিছুদিন আগে দেশের সরকারি হাসপাতালে প্রথমবারের মতো মিনিমালি ইনভাসিব কার্ডিয়াক সার্জারি করা হয়েছে, যেখানে বুক ফাঁক না করে, পাঁজরের হাড় না কেটে সফল অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। বোনমেরো ট্রান্সপ্লান্টেশন থেকে শুরু করে লিভার সিরোসিস রোগে আক্রান্তদের স্টেমসেল প্রতিস্থাপন করার মতো সাফল্য বাংলাদেশের চিকিৎসকদের রয়েছে। এত সাফল্য থাকার পরও বাংলাদেশের ডাক্তারদের অবহেলার কোনো অবকাশ থাকতে পারে না।
আমাদের দেশে চিকিৎসা ক্ষেত্রে প্রকৃত সমস্যা হচ্ছেÑ হাসপাতাল বা চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার। চিকিৎসক চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার একটি অংশ মাত্র। এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না, আমাদের দেশে সরকারি হাসপাতালগুলোর ব্যবস্থাপনা প্রায় সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করেন তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী সংগঠনের নেতারা। তারা সরাসরি দলীয় রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত। যখন যারা ক্ষমতায় থাকেন, তাদের পক্ষের সংগঠন হাসপাতাল নিয়ন্ত্রণ করে। মন্ত্রী, মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতারা তাদের ক্ষমতার উৎস। সরকারি হাসপাতালগুলোতে যেসব অনিয়ম-দুর্নীতি হয়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এরা জড়িত।
আমাদের মনে হয়, দেশের চিকিৎসাব্যবস্থার প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে এ অসাধু কর্মচারীরা যাতে কোনো হাসপাতালে আধিপত্য বিস্তার করতে না পারে, সেজন্য বিভিন্ন হাসপাতালে তাদের বদলি প্রক্রিয়ার মধ্যে রাখা উচিত। পর্যাপ্ত চিকিৎসা সরঞ্জাম ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক ব্যবস্থা করাসহ প্রতিটি হাসপাতালকে দালালমুক্ত করা উচিত। দেশের চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে ঢালাওভাবে অপপ্রচার বন্ধ করতে হবে। মধ্যযুগের কবি ভারতচন্দ্র রায় গুণাকর বলেছিলেন, ‘নগর পুড়িলে কি দেবালয় এড়ায়?’ আমাদের বর্তমান সমাজে প্রতিটি পেশার লোকের মধ্যেই পচন ধরেছে। ডাক্তাররাও তা থেকে আলাদা হবেন, এটি আশা করা বাতুলতা মাত্র।
দেশ থেকে প্রতি বছর চিকিৎসা বাবদ যে পরিমাণ অর্থ বিদেশী ডাক্তারদের হাতে চলে যাচ্ছে, তা দিয়ে বিশ্বের যেকোনো বড় হাসপাতালের মতো কয়েকটি বিশ্বমানের চিকিৎসাকেন্দ্র বাংলাদেশে করা সম্ভব হবে বলে আমাদের ধারণা। হ
লেখক : শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা