নবান্ন উৎসব কৃষকের অজানা
- শতদল বড়–য়া
- ২৪ ডিসেম্বর ২০১৯, ০০:০০
অগ্রহায়ণের শুরুতে ধান কাটা চলছে। নবান্ন উৎসবে মেতেছে শহরের নাগরিক জীবন। অথচ যাদের পরিশ্রমে মাঠে মাঠে উৎপন্ন হয় সোনালি ধান; সেই তাদের কাছে কিন্তু নবান্ন উৎসব কী তা জানা নেই তাদের। চন্দনাইশের উত্তর হাশিমপুরে একটা অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। পথের দূরত্ব কমাতে বিল আড়াইড় হাঁটছিলাম। ধানের ম ম গন্ধে হাটতেও বেশ ভালো লাগছিল। পথের ধারে ছোট চায়ের দোকান। গরম গরম পিঁয়াজু বানাতে দেখে সেই দোকানে বসে পড়লাম। লোকে ঠাসা দোকান। বেশির ভাগই দিনমজুর। তারা পাশের জমিতে ধান কাটছিলেন। সহপাঠী বললেন, এখন তো নবান্ন উৎসবের দিন। গ্রামে এ উৎসব বেশ মজা করে পালন করা হতো একসময়। এক চাষি বললেন, নবান্ন উৎসব আবার কী? নবান্ন উৎসব আবহমান বাংলার একটি সামাজিক ঐতিহ্য। গ্রামাবাংলায় এখন এই ঐতিহ্য তেমন একটা চোখে না পড়লেও শহরে বিভিন্ন সংগঠন ঘটা করে পালন করে। যাদের ঘিরে উৎসবের উদ্ভব; সেই তারা কিন্তু এ ব্যাপারে কিছুই জানেন না।
ফের যাত্রা শুরু করলাম। সাথী হলেন এক জাত চাষি। দিগন্তবিস্তৃত ফসল দেখে বললাম, ফসল ভালো হয়েছে। চাষি বললেন, মাঠে রাশি রাশি ধানের থোকা দেখে আমাদের মনও খুশির জোয়ারে ভাসছে। সেই খুশি আবার মিইয়ে যায় যখন প্রতিকূলতার কথা মনে পড়ে। দিনমজুরের সঙ্কট, বৈরী আবহাওয়া, বিলম্ব বৃষ্টি কিংবা অনাবৃষ্টি থেকে বাঁচিয়ে ফসল গোলায় তুলতে পারি না জমির মালিকের হিস্যা আর মহাজনের ঋণ পরিশোধের কারণে, তখন মনপীড়া বেড়ে যায়।
বীজ, সার, দিনমজুরের বেতন যোগাতে ধান রোপণের শুরুতে মহাজনের কাছ থেকে যে ঋণ নেয়া হয়েছিল তার জন্য কষ্টের ফসল গোলায় তোলার আগেই সমন জারি হয় মহাজনের টাকা পৌঁছে দিতে। রোদে পুড়ে শরীরের নোনাজল ঢেলে যে ফসল উঠানে উঠে; তা দেখে কৃষকপরিবারে খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবতা বড়ই কঠিন। শর্ত মতো সব খাতে ভাগভাটোয়ারা করে দেখা যায় কৃষাণের গোলা খালিই থেকে গেছে। তার মনের কোনো আশা পূর্ণ হয় না। কৃষাণীর একটা নতুন শাড়ি কেনার ইচ্ছা আর কৃষাণকে সাহস করে বলা হয় না। মেয়ের আবদার বাপের কাছে একজোড়া কানের দুল। মেয়েও সে কথা বাবাকে বলতে পারে না। বাবা কথা দিয়েছিল ছেলেকে ধান উঠলে নতুন শার্ট-প্যান্ট কিনে দেবে। বাবা আজ বাকরুদ্ধ। ছেলেমেয়ে দুজনই বাবার কাছে গিয়ে বসে বলে, এত চিন্তা করছ কেন? আমাদের যা আছে তা দিয়ে এ বছর পার করতে পারব। এই সামান্য ক’টা টাকা নাও, বাজার থেকে মুরগি কিনে আনো। অনেক দিন গোশত খাওয়া হয় না।
কৃষাণী বলল, ধরো, এই টাকা দিয়ে তোমার জন্য একটা লুঙ্গি আনবে বাজার থেকে। কৃষাণ আহত সুরে বলে, আমি তো কোনো টাকা তোমাকে দিতে পারিনি। কোথায় টাকা পেলে! কৃষাণী সহজ-সরল জবাবÑ আজ বয়স্কভাতা পেয়েছি না! কৃষাণ এতক্ষণে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলে, সহজে হারব না, ফের মাঠে নামব। নতুন ধানের চারা রোপণ করব। উল্লিখিত কথাগুলো বংলাদেশের কৃষক পরিবারের সাধারণ চিত্র। বারবার তারা আশায় বুক বাঁধে। সামনের ফলনে আশা পূরণ হবে। এভাবেই ধানের মধ্যে লুকায়িত স্বপ্নগুলো বারবার মাথা দুলিয়ে চাষাবাদের প্রেরণা যোগায় কৃষককে। বৃষ্টি চুয়ে পড়া ভাঙা চালে নতুন শণের ছাউনি দেয়ার কথাটি মনে পড়তেই কৃষাণ আর ঠিক থাকতে পারে না, ছুটে চলে টাকার খোঁজে। এটিই আমাদের কৃষকের দিনকাল। সুখ নামের সোনার হরিণ তাদের অধরাই থেকে যায়।
হেমন্তে ধানক্ষেত সোনালি আবরণে ছেয়ে যায়। মনে হয় মাঠে কেউ যেন মুঠো মুঠো সোনা ছড়িয়ে দিয়েছে। ধানের শীষে ঝরে পড়ে সোনা রোদ। ক্ষেত যখন পাকা ধানে ভরপুর হয়, তখন সবার মনে আশার সঞ্চার হয়। কৃষক ধান কাটতে শুরু করে। ধানের স্তূপ চাষির উঠান অপরূপ শোভিত করে। কাঁচা ধানের গন্ধে চাষির মন উৎফুল্ল হয়, বৌ-ঝিয়েরা কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। হেমন্ত তাই কৃষকের কাছে কাক্সিক্ষত ঋতু। এর রূপে জীবনানন্দ লিখেছেনÑ
‘আমি এই অঘ্রাণের ভালবাসি
বিকালের এই রঙ
রঙের শূন্যতা-রোদের নরম রোম-ঢালু মাঠ
বিবর্ণ বাদামি পাখি, হলুদ বিচালি,
পাতা কুড়াবার দিন ঘাসে ঘাসে।’
বাংলার হেমন্ত যেন ফসলের গানে ভরা। তবে যারা মাঠে কাজ করে ফসল ফলান তাদের একটাই আকুতিÑ কষ্টের ফসল ঘরে তুলতে পারলেই বাঁচি। আগের মতো কৃষকের বাড়িতে নেই ধানের গোলা, গোয়ালে নেই গরু। এমনও কৃষক আছে, তাদের গোয়ালঘর পর্যন্ত নেই। পুকুর ভরা মাছের কথা বাদই দিলাম। কৃষকের নেই পুকুর। সবকিছুতে পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে। কিন্তু কৃষকের অবস্থার কোনো পরিবর্তন আজো হয়নি। তারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে মাঠে ফসল উৎপাদন করে বছরের ছয়মাস কোনো রকমে চললেও বাকি সময় চাল কিনে সংসার চালায়। কৃষক সরকার দেয়া সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। এক অদৃশ্য হাতের ইশারায় দেখা যায় প্রকৃত কৃষক সরকারি সুযোগ-সুবিধা না পেয়ে অকৃষক তা পেয়ে গেল। এভাবে কোনো দিন কৃষকের দুর্দিন কাটবে না। তবে আশার কথাÑ কৃষকও ঘরে বসে নেই। তারাও ছুটছে তাদের জন্য বরাদ্দ অনুদানের খোঁজ নিতে জেলা-উপজেলা এবং শহরের নির্দিষ্ট স্থানে। অধিকার আদায়ে সোচ্চার না হলে ভাগ্য সুপ্রসন্ন হবে না; এই কথাটি আজ বুঝতে শুরু করেছে আমাদের কৃষক। হ
লেখক : প্রাবন্ধিক
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা