০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৩ মাঘ ১৪২৩১, ৬ শাবান ১৪৪৬
`

সুনীল অর্থনীতির হাতছানি

-

ব্লু-ইকোনমি বা সমুদ্র অর্থনীতি বিশ^ অর্থনৈতিক পরিমণ্ডলে দিন দিন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। আসলে সমুদ্রসম্পদনির্ভর পরিচালিত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডই ব্লু-ইকোনমি বা সুনীল অর্থনীতি। ১৯৯৪ সালে অধ্যাপক গুন্টার পাউলি ভবিষ্যতের অর্থনীতির রূপরেখা প্রণয়নে একটি টেকসই এবং পরিবেশবান্ধব মডেল হিসেবে ব্লু-ইকোনমির ধারণা দেন। মানবসভ্যতার ভবিষ্যৎ খাদ্য ও জ¦ালানি চাহিদা মেটাতে বিশে^র নজর এখন সমুদ্র তলদেশে সঞ্চিত সম্পদের ওপর। পৃথিবীর ৬৩০ কোটি মানুষের ১৫ শতাংশ প্রোটিন চাহিদার জোগান দিচ্ছে সমুদ্রের বিশাল জলরাশি। জনসংখ্যা পরিসংখ্যানের তথ্যমতে, ২০৫০ সাল নাগাদ বিশে^র জনসংখ্যা দাঁড়াবে ৯০০ কোটি। এ বিপুল জনগোষ্ঠীর খাদ্য ও জ্বালানি চাহিদা পূরণের একমাত্র ক্ষেত্র হতে পারে সমুদ্রসম্পদ। সমুদ্র ঘিরে বিশ^ বাণিজ্যে প্রতি বছর প্রায় ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড হয়। আন্তর্জাতিক আমদানি রফতানির ৬০ ভাগ সমুদ্রপথে হয়ে থাকে। পৃথিবীর অনেক দেশ বিশেষ করে ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় আয়ের বেশির ভাগ অবদান রাখছে সমুদ্র অর্থনীতি। অস্ট্রেলিয়া সামুদ্রিক সম্পদের উৎকর্ষসাধন ও পর্যটন শিল্পের মাধ্যমে বছরে আয় করছে ৪৪ বিলিয়ন ডলার। জাপান, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরসহ ভারত মহাসাগরের অনেক দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে সমুদ্র অর্থনীতি। বাংলাদেশ পেয়েছে ভূ-খণ্ডের প্রায় সমআয়তনের সমুদ্রসীমা। উন্নয়ন কৌশলের মাধ্যমে সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করে যদি সমুদ্রসম্পদকে কাজে লাগাতে পারি আমরা, তবে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ শুধু সময়ের ব্যাপার।
একবিংশ শতাব্দীর অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা ও বিশ^ায়নের যুগে বিকাশমান অর্থনীতির দেশগুলো সব বিকল্প সম্ভাবনা কাজে লাগাতে তৎপর। সেজন্য সম্ভাবনাময় সব খাতকে গুরুত্ব দিয়ে বিনিয়োগ করছে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার। প্রাকৃতিক সম্পদ, সামুদ্রিকসম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার করে অনেক দেশ ইতোমধ্যে নিম্নআয়ের থেকে উচ্চ আয়ের দেশের কাতারে শামিল হয়েছে। এজন্য সংশ্লিষ্ট দেশগুলো দীর্ঘমেয়াদি কর্মকৌশল প্রণয়ন করে রাজস্ব থেকে ব্যয় করেছে লাখ লাখ ডলার। তেমনি করে দ্বিপক্ষীয়-বহুপাক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে দক্ষ জনবল নিয়োগ করে আর প্রযুক্তি ঘাটতি মেটাতে সহায়তা নিয়েছে উন্নত দেশগুলোর সমুদ্র বিশারদ ও উন্নত প্রযুক্তির। সমুদ্র অর্থনীতির সুফল পেতে আমাদেরও প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট সরকারি নীতিমালা ও বিনিয়োগ মানসিকতা। বাংলাদেশ সরকারের উচিত সামুদ্রিক অর্থনীতির সম্ভাবনা কাজে লাগাতে প্রযুক্তি দক্ষতা বাড়াতে গবেষণা খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ দেয়া ও প্রয়োজনে উন্নত প্রযুক্তির দেশগুলোর সহায়তা নেয়া।
অতীতে সমুদ্রসীমা নিয়ে ভারত ও মিয়ানমারের সাথে বিরোধ থাকায় সমুদ্রসম্পদ ব্যবহারে প্রতিবন্ধকতা ছিল বাংলাদেশের। জাতিসঙ্ঘের আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে সমুদ্রসীমা নিয়ে সেই বিরোধের নিষ্পত্তি হয়েছে। সমুদ্র আইনের ভিত্তিতে বাংলাদেশ পেয়েছে এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার আয়তনের সমুদ্রসীমা, যার ১২ নটিক্যাল মাইল রাজনৈতিক সীমা (এই অংশে বাংলাদেশ যা খুশি তাই করতে পারবে), ২০০ নটিক্যাল মাইল অবধি অর্থনৈতিক সীমা (প্রাণিজ-অপ্রাণিজ ও তেল-গ্যাসসহ খনিজসম্পদ উত্তোলনের ক্ষমতা) আর ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল মহীসোপান অঞ্চলে মৎস্য আহরণ, গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ, তেল-গ্যাস অনুসন্ধান, উত্তোলন ও অন্যান্য খনিজসম্পদ আহরণের আধিপত্য। ১ নটিক্যাল মাইল = ১.৮৫ কিলোমিটার। সমুদ্র উপকূলবর্তী অনেক উন্নত দেশ সমুদ্রসীমায় সঞ্চিত সম্পদ কাজে লাগিয়ে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি লাভ করেছে। উদাহরণস্বরূপ দীর্ঘ মহীসোপান সম্পন্ন দেশের নাম হিসেবে নরওয়ের নামটি প্রণিধানযোগ্য। আটলান্টিক মহাসাগরের উপকূলে অবস্থিত দেশটিকে বলা হয় ‘ধীবরের দেশ’ অর্থাৎ মৎস্যজীবীদের দেশ। কেননা দেশটির উপকূলে রয়েছে সুদীর্ঘ মহীসোপান অঞ্চল। মহীসোপান অঞ্চল হলো উপকূল থেকে অপেক্ষাকৃত অগভীর অনধিক ১৮০ মিটার গভীর পর্যন্ত সমুদ্রের বিস্তৃত অংশ। এ মহীসোপান অংশই সামুদ্রিক মৎস্যচারণ ক্ষেত্র আর সবচেয়ে বেশি মৎস্য আহরিতও হয় ওই অংশে। তাই নরওয়ে সামুদ্রিক মৎস্য রফতানিতে বিশ্বের অন্যতম প্রধান দেশ। দেশটির বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধানতম খাতও মৎস্যসম্পদ।
সমুদ্র গবেষণাকারী সংস্থা ‘সেভস আওয়ার সি’ সম্প্রতি জানিয়েছে, বঙ্গোপসাগর থেকে প্রতি বছর প্রায় ৮০ লাখ টন মৎস্য আহরিত হয়। সেখানে বাংলাদেশ মাত্র ৯৫ হাজার টন মাছ ধরতে পারে। বাংলাদেশী জেলেরা ৩৫৪ নটিক্যাল মাইলের মধ্যে মাত্র ৭০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত গিয়ে মাছ শিকার করেন। তাদের কাছে দূর সমুদ্রে গিয়ে মাছ শিকারের জন্য যেমন উন্নত প্রযুক্তির জাহাজ নেই, তেমনি নেই উন্নতমানের মাছ ধরার জাল। অথচ জেলেরা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে সামুদ্রিক মৎস্য সংগ্রহ করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারে বাংলাদেশ। বাংলাদেশকে বার্ষিক জ্বালানি চাহিদা মেটাতে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে জ্বালানি তেল আমদানি করতে হয়। উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার ও বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করে সমুদ্র তলদেশে অনুসন্ধান চালানো হলে, তেল-গ্যাস, খনিজবালু, ইউরেনিয়াম, টারটারিয়ামসহ অনেক সম্পদের সন্ধান মিলতে পারে। এতে এক দিকে যেমন দেশের ভবিষ্যৎ জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে; অন্য দিকে বিরাট অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রারও সাশ্রয় হবে।
সমুদ্রের তলদেশ হলো প্রাকৃতিক তেল ও গ্যাসের আঁধার। ভূ-মধ্যসাগরের উপকূলে অবস্থিত ১৯টি দেশ নিয়ে গঠিত মধ্যপ্রাচ্য। সমুদ্র উপকূলবর্তী হওয়ায় দেশগুলো খনিজ তেল-গ্যাস ও প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ। যাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের চালিকাশক্তিই হলো তেল ও গ্যাস রফতানি। খনিজসম্পদ অনুসন্ধানে নিয়োজিত আমাদের সরকারি সংস্থার তথ্যে হতাশ হতে হয়েছে। সমুদ্রায়নকে ২৬টি অর্থনৈতিক ব্লকে ভাগ করা হয়েছে। এর মধ্যে শুধু চারটি ব্লকে পুরোদমে কার্যক্রম চলছে। বাকিগুলো শুধু আয়তন আর সীমা নির্ধারণেই সীমাবদ্ধ হয়ে রয়েছে। সেগুলোতে কী পরিমাণ সম্পদ সঞ্চিত আছে; তা অনুসন্ধানের কাজ যে তিমিরে ছিল সেখানেই রয়ে গেছে।
চীন-জাপান যৌথ বিনিয়োগে আগ্রহ দেখালেও বাংলাদেশ কর্তৃক অনুসন্ধান কাজটি সম্পন্ন না হলে চুক্তিবদ্ধ অনিশ্চিত। তাই সঞ্চিত সম্পদের পরিমাণ নির্ণয়ে অনুসন্ধানটি কার্যক্রমে জোর দিতে হবে। এদিকে প্রতি বছর ৭০ বিলিয়ন ডলার বাংলাদেশের সাথে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংঘটিত হয় সমুদ্রপথে। সমুদ্র জাহাজের স্বল্পতায় বিদেশী জাহাজে পণ্য আমদানি রফতানিতে বাংলাদেশকে প্রতি বছর ভাড়া হিসেবে গুনতে হয় পাঁচ বিলিয়ন ডলার। নিজস্ব জাহাজে পণ্য পরিবহনের ব্যবস্থা করেও বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় করে অর্থনীতিকে গতিশীল করা যায়। তথ্যসূত্রে প্রাপ্ত সমুদ্রের বুকে তিন লাখ হেক্টর নতুন ভূমি উঁকি দিয়ে উঠেছে। এগুলোর কৃষি ও পর্যটন সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে হবে। এছাড়া পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার, প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিন ও কুয়াকাটার বৈচিত্র্যতা (পৃথিবীর একমাত্র স্থান যেখানে একই সাথে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখা যায়) কাজে লাগিয়ে বিদেশী পর্যটক আকর্ষণে উদ্যোগ প্রয়োজন। মুক্তবাজার অর্থনীতির বিশ^ায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সমুদ্রকেন্দ্রিক যে সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, তার গুরুত্ব অনুধাবন করে টেকসই উন্নয়নের স্বার্থে সমুদ্রসম্পদকে কাজে লাগিয়ে কিভাবে আত্মনির্ভরশীল হওয়া যায় সেদিকে মনোযোগী হতে হবে আমাদের। এছাড়া সমুদ্র অর্থনীতিনির্ভর কর্মসংস্থান হতে পারে দেশের বেকার সমস্যা সমাধানের বিকল্প পথ। এ খাতের উন্নয়নে সরকারের আন্তরিকতা অনস্বীকার্য। উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন সত্যি করতে হলে স্বল্প পরিসরে নয় বড় পরিসরে সমুদ্রে অনুসন্ধান কাজ চালাতে হবে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির আলোকে নিতে হবে কর্মপরিকল্পনা ও মেগা প্রকল্প। এসডিজি অর্জনে এ খাতের উন্নয়ন না করেও বাংলাদেশের উপায় নেই। জাতিসঙ্ঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনের ১৪ নম্বর অনুচ্ছেদে লিপিবদ্ধ সমুদ্র অর্থনীতির উন্নয়ন সাধন করবÑ মর্মে বাংলাদেশ চুক্তিতে সই করেছে। তাই সমুদ্রসম্পদপ্রাপ্তিতে বাংলাদেশ যেমন হতে পারে সমুদ্র অর্থনীতিনির্ভর সমৃদ্ধ দেশ; তেমনি এসডিজি বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করে ঘোচাতে পারে বেকারত্বের অভিশাপ। হ
লেখক : শিক্ষক
[email protected]

 


আরো সংবাদ



premium cement
কুষ্টিয়ার সাবেক এমপি সেলিম আলতাফ জর্জের অফিস ভাঙচুর ট্রাম্পের গাজা দখলের ঘোষণার তীব্র নিন্দা-প্রতিবাদ জামায়াতের আনিসুল হকের আস্থাভাজন তৌফিকার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা পাকিস্তানের যৌথ নৌ মহড়ায় অংশ নিচ্ছে ইরান গাজায় ইসরাইলি যুদ্ধাপরাধীর তদন্ত শুরু করেছে সুইস কর্তৃপক্ষ ফিলিস্তিনিদের নিয়ে ট্রাম্পের দেয়া প্রস্তাবে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবের ছাত্র-জনতার রোষানলের দায় শেখ হাসিনাকেই বহন করতে হবে : খেলাফত মজলিস কুলাউড়ায় উপজাতীয়দের হাতে বাঙালি যুবক খুন : ৭ খাসিয়ার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা শেখ হাসিনার উসকানিমূলক বক্তব্যের কারণে ৩২ নম্বরের বাড়ি ভাঙচুর ছিনতাই প্রতিরোধে ট্রাফিক সার্জেন্টদের দেয়া হচ্ছে ক্ষুদ্র অস্ত্র : ডিএমপি কমিশনার ছয় নতুন মুখ নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার ওয়ানডে দল ঘোষণা

সকল