জ্ঞান সাধনায় লাইব্রেরি

মহান আল্লাহ শেষ নবী হজরত মোহাম্মদ সা:-এর কাছে যে আসমানি নির্দেশটি সর্বপ্রথম পাঠান তা হচ্ছেÑ ‘ইকরা’ অর্থাৎ পড়। হজরত আদম আ:-কে সৃষ্টির পরপরই যে প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে হয়েছিল তা হচ্ছে ‘জ্ঞান’। আল্লাহ ওই প্রতিযোগিতায় আদম আ:-কে উত্তীর্ণ করেছিলেন।
বর্তমান সময়েও যারা জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নত ও সেরা তাদের বিশেষ সম্মান দেয়া হয়। যুগে যুগে বিভিন্ন মুসলিম ও অমুসলিম মনীষীরা পৃথিবীর একমাত্র নির্ভুল গ্রন্থ আল-কুরআনের অনুবাদ করে স্মরণীয় হয়ে আছেন। বাংলা ভাষায় প্রথম কুরআন অনুবাদ করেন গিরিশ চন্দ্র সেন। তেমনি ইংরেজিতে আলেকজান্ডার বস, ফরাসিতে আন্দ্রে ডুরোয়ার, উর্দুতে আবদুস সালাম মুহাম্মদ, ফার্সিতে কামালুদ্দীন হোসাইন, হিন্দিতে আহমদ শাহ মসিহি, কাশ্মিরি ভাষায় মুহাম্মদ ইয়াহইয়া শাহ, জার্মান ভাষায় সলেম স্কেইজার, ইতালীয় ভাষায় আন্দ্রে অ্যারি ভ্যারিনি, রুশ ভাষায় পিওটর ভি পেস্টানিকভ, গুজরাটি ভাষায় কারিরি লোকনান, রুমানিয়া ভাষায় সিলডেস্টোও কন্ট্রাভিয়ান, চীনা ভাষায় টিয়েং লি, আফ্রিকার সোহায়লি ভাষায় ইসমাইল আব্দুর রাজ্জাক, সুদানি ভাষায় এইচ কামরুদ্দীন সালেহ এবং কোরিয়ান ভাষায় মংসান কিম প্রথম কুরআন অনুবাদ করেন। এই কাজ সম্ভব হয়েছিল তাদের জ্ঞান সাধনার কারণে।
জ্ঞান সাধনার একটি সহায়ক শক্তি হিসেবে লাইব্রেরি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। যুগে যুগে দেশে দেশে মনীষীরা লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠায় অবদান রেখেছেন। বিশ্বের সবচেয়ে বড় গ্রন্থাগার ‘দ্য লাইব্রেরি অব কংগ্রেস’। এতে বই রয়েছে দুই কোটি ৮০ লাখ। আমাদের দেশে ঢাকার শাহবাগে পাবলিক লাইব্রেরি অবস্থিত। এখানে প্রায় দুই লাখ বইয়ের এক বিশাল সাম্রাজ্য রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় পাঠাগারটিও দুর্লভ বইয়ে সমৃদ্ধ। এছাড়া প্রায় এক লাখের মতো বই সংগ্রহে রয়েছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র লাইব্রেরিতে, ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরিতে ২৫ হাজার বইয়ের বিশাল এক সংগ্রহশালা, আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ লাইব্রেরিতে প্রায় সাত হাজার বই এবং গ্যেটে ইনস্টিটিউট লাইব্রেরি পাঁচ হাজারেরও বেশি বইয়ের মাধ্যমে আলোকিত মানুষ তৈরির প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তা ছাড়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার বিপুল বই নিয়ে জ্ঞান সাধনায় ভূমিকা রাখছে। তবে ১০ শতাংশ শিক্ষার্থী তার নিজের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গ্রন্থাগার ব্যবহার করেন না বলে এক পরিসংখ্যানে জানা গেছে।
আমাদের দেশের প্রায় ৩৫ শতাংশ মানুষ এখনো অক্ষরজ্ঞানহীন। অথচ মানুষকে সুশিক্ষিত করে গড়ে তুলতে মধ্যযুগের মুসলমানরা বিশ্বময় আলো ছড়ানোর জন্য ব্যাপকভাবে লাইব্রেরি গড়ে তুলেছিলেন। ৮৩০ সালে খলিফা আল মামুন বায়তুল হিকমা নামে বিশাল এক গ্রন্থশালা প্রতিষ্ঠা করেন। এ ছাড়া কর্ডোভা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে গ্রন্থাগারটি প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, তৎকালীন সেই পাঠাগারে সংরক্ষিত ছিল ছয় লাখ গ্রন্থ। চতুর্থ শতাব্দীতে সর্বপ্রথম মুসলিম পণ্ডিত ও প্রশাসক সায়েব বিন আব্বাস আরব জাহানে ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি প্রবর্তন করেন। ১৯১২ সালে আমেরিকা অঞ্চলে ঘোড়ার গাড়ির মাধ্যমে পাঠাগার যাতায়াত করত বিভিন্ন লোকালয়ে। ফ্রান্সে এটি শুরু হয় ১৯২০ সালে। বর্তমান বিশ্বে গাড়িতে করে বহনযোগ্য গ্রন্থাগার প্রায় সব দেশে চালু আছে। বাংলাদেশে প্রথম ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরির উদ্যোগ নেন অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ। আধুনিককালে তুরস্কের ‘সোলাইমানিয়া’ লাইব্রেরিটির অবস্থান শীর্ষে। পর্যায়ক্রমে মিসরের দারুল কুতুব, ইরাকে আবদুল্লাহ মারাশি নাজাফির প্রতিষ্ঠিত বিখ্যাত লাইব্রেরি, মদিনার মাকতাব আল আবদুল আজীজ অগ্রগণ্য।
লিও টলস্টয়কে বলা হয়েছিল জাতীয় উন্নয়নের জন্য আপনি যুব সমাজের প্রতি কিছু বলুন, তিনি বলেছিলেনÑ আমার তিনটি পরামর্শ আছে : ১. পড়, ২. পড় এবং ৩. আর পড়। এটি যেন মহান আল্লাহর সেই প্রথম বাণী ‘পড়, তোমার প্রভুর নামে’ এরই প্রতিফলন। আমাদের ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও জ্ঞানের দিগন্ত আলোকিত করতে ভালো মানের সমৃদ্ধ লাইব্রেরির বিকল্প নেই। মানুষের হাজার হাজার বছরের লিখিত-অলিখিত সব ইতিহাস ঘুমিয়ে আছে একেকটি গ্রন্থাগারের ছোট ছোট তাকে। এ থেকে আমরা ধারণা করতে পারি জ্ঞান সাধনায় লাইব্রেরির গুরুত্ব কতটুকু। হ
লেখক : কলেজ শিক্ষক