০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৩ মাঘ ১৪২৩১, ৬ শাবান ১৪৪৬
`

রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র

-

উপমহাদেশের রাজনীতির একটি বৈশিষ্ট্য হলো প্রধান নেতা বা নেত্রীকে ঘিরে রাজনৈতিক দলের বিকাশ। প্রধান ব্যক্তিত্বকে ঘিরে দলের সব কার্যক্রম পরিচালিত হতে দেখা যায়। এটি শুধু এখনই নয়, ব্রিটিশ ভারতে এর সূচনা। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীকে সামনে রেখে স্বাধীন ভারতে সে ধারা প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওয়াহেরলাল নেহরু। বাংলাদেশের রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্রের প্রভাব শুরু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মর্মান্তিক রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের পর। পঁচাত্তরের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনীতিতে আবির্ভাব। ১৯৮১ সালের ৩০ মে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর তার স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া দলের সঙ্কটকালীন সময়ে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। বাংলাদেশের রাজনীতি মূলত ‘শেখ’ এবং ‘জিয়া’ এ দুই পরিবারের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে।
পাকিস্তানের রাজনীতিতেও পরিবারতন্ত্রের প্রভাব লক্ষণীয়। দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর মৃত্যুদণ্ডের পর তার কন্যা অক্সফোর্ড পড়–য়া বেনজির ভুট্টো পাকিস্তান পিপলস পার্টির হাল ধরেন। পরে তিনি ১৯৮৮ ও ১৯৯২ সালে দেশটির প্রধানমন্ত্রী হন। আত্মঘাতী বোমা হামলায় তার মৃত্যুর পর স্বামী আসিফ আলী জারদারি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। মাত্র ১৯ বছর বয়সে দেশের সবচেয়ে পুরনো রাজনৈতিক দলের পারিবারিক পরম্পরায় পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন বেনজির ও আসিফ আলী জার্দারির পুত্র বিলাওয়াল ভুট্টো। অন্য দিকে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের ছেলেরা রাজনীতিতে না এলেও তার মেয়ে মরিয়ম নওয়াজ শরিফ রাজনীতিতে এসেছেন। তার ভাই শাহবাজ শরিফ পাঞ্জাব প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী, এমনকি তিনি পাকিস্তান মুসলিম লীগের (এন) সভাপতিও ছিলেন।
রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্রের প্রভাব শুধু উপমহাদেশে নয়; বিশ্বের অনেক দেশেই পরিলক্ষিত হয়। খোদ যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডায় পরিবারতন্ত্রের রাজনীতি বেশ প্রভাব বিস্তার করেছে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট সিনিয়র বুশ ১৯৮৯-১৯৯৩ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। তারপর তার ছেলে জর্জ ডব্লিউ বুশ পরপর দুই দফায় (২০০০-২০০৮) যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ছোট ছেলে জেব বুশ ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের গভর্নর ছিলেন। এ ছাড়াও বিল ক্লিনটন যুক্তরাষ্ট্রে দুই মেয়াদে (১৯৯৩-২০০১) প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তার স্ত্রী হিলারি ক্লিনটন নিউ ইয়র্ক অঙ্গরাজ্য থেকে নির্বাচিত সিনেটর ছিলেন। আর ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নেন। এগুলোর বাইরে মার্কিন রাজনীতিতে কেনেডি পরিবারের রয়েছে প্রভাব। কানাডার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোও পারিবারিক কারণে রাজনীতির বলয় থেকে বের হতে পারেননি। তার বাবা পিয়েরে ট্রুডো ১৯৬৮-১৯৭৯ পর্যন্ত কানাডার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। এশিয়ার দেশ জাপান (ফুকুদা), ফিলিপাইনে কোরাজোন একুইন ও তার ছেলে বেনিন একুইন, তারা একুইনোর রাজনৈতিক উত্তরসূরি। সিঙ্গাপুর, মিয়ানমার (অং সান), নেপাল (থাপা), শ্রীলঙ্কা (বন্দর নায়েকে) এমনকি সমাজতান্ত্রিক দেশ উত্তর কোরিয়া (কিম) এবং চীনেও (চিয়াং) পরিবারতন্ত্রের দ্বারা রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। তারা দীর্ঘ দিন উত্তরাধিকারের ভিত্তিতে রাষ্ট্র ক্ষমতা পরিচালনা করে আসছেন। পৃথিবীর বহু দেশেই পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হচ্ছে।
রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র দোষের কিছু নয়, বরং বংশানুক্রমে রাজনীতিতে এসে সুনাম কুড়িয়েছেন এমন রাজনীতিবিদ নেহায়েত কম নয়। ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনে গান্ধী ও নেহরু পরিবারের অবদান সবচেয়ে বেশি। স্বাধীনতা-পরবর্তী ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওয়াহেরলাল নেহরু ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। জওয়াহেরলাল নেহরুর বাবা মতিলাল নেহরু একজন প্রথম সারির কংগ্রেস নেতা ছিলেন। জওয়াহেরলাল নেহরুর মৃত্যুর পর তার কন্যা ইন্দিরা গান্ধীকে ১৯৬৪ সালে ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি রাজ্যসভার সদস্য হিসেবে নিয়োগ দেন। ওই সময় ইন্দিরা লালবাহাদুর শাস্ত্রীর মন্ত্রিসভায় তথ্য ও প্রচার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। অবশ্য তিনি ১৯৫০ সাল থেকেই অপেশাগতভাবে বাবা জওয়াহেরলাল নেহরুর অফিস সহকারীর কাজ করে আসছিলেন। ১৯৬৬ সালে লালবাহাদুর শাস্ত্রীর হঠাৎ মৃত্যুর পর ইন্দিরা গান্ধী ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন। ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত চার মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন কালে নিজ দেহরক্ষীর হাতে নিহত হন। তার মৃত্যুর পর ছেলে রাজীব গান্ধী দেশটির প্রধানমন্ত্রী হন। রাজিব গান্ধীর মৃত্যুর পর রাজনীতিতে আসেন তার স্ত্রী সোনিয়া গান্ধী। তার নেতৃত্বে ২০০৪ সালে কংগ্রেস ক্ষমতায় আসে। সোনিয়া গান্ধী ১৯৯৮ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন। তিনি সভাপতির পদ থেকে সরে যাওয়ার পর তার ছেলে রাহুল গান্ধী কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। যদিও তিনি ২০১৯ সালের নির্বাচনে পরাজয়ের দায় নিয়ে সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেন। বর্তমানে কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন রাজীব ও সোনিয়া গান্ধীর মেয়ে প্রিয়াঙ্কা ভদ্র গান্ধী। ভারতীয় রাজনীতিতে কিছু পরিবার প্রাদেশিক রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করছে।
স্পষ্টতই আমাদের দেশে ‘শেখ’ এবং ‘জিয়া’ পরিবার দেশের মূল রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করলেও পরিবারকেন্দ্রিক রাজনীতি শুধু এ দুই পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। ভারত ও বাংলাদেশের প্রায় সব মন্ত্রী, এমপিদের স্ত্রী, সন্তানেরা উত্তরাধিকারের ভিত্তিতে রাজনীতিতে এসেছেন। তবে আশঙ্কার কথা হচ্ছে এমপি-মন্ত্রীদের সন্তানেরা তাদের পূর্বসূরিদের মতো রাজনৈতিক দূরদর্শিতা দেখাতে ব্যর্থ হচ্ছেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, মাঠের রাজনীতির সাথে কোনো যোগাযোগ না থাকা সত্ত্বেও এমপি-মন্ত্রীদের স্ত্রী, মেয়ে, ছেলেরা স্বামী বা বাপের রেখে যাওয়া অঢেল সম্পত্তির কিছু অংশ ব্যয় করে দলীয় নেতাকর্মীদের নিজের পক্ষে কিনে নেয়ার চেষ্টা করেন। এতে করে রাজনীতিতে দক্ষ লোকের প্রবেশ ঘটছে না; বরং অনেক ক্ষেত্রে দক্ষ ও সৎ রাজনীতিবিদেরা অপমানিত হয়ে দল ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। অথবা দলীয় কর্মকাণ্ড থেকে নিষ্ক্রিয় থাকছেন। বর্তমান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ব্যবসায়িক শ্রেণীর আগমন বেশি ঘটছে এবং তাদের হাতেই নেতৃত্বের ভার চলে যাচ্ছে। এ কারণে রাজনৈতিক সংস্কৃতি দিন দিন নিম্নমুখী হচ্ছে। ‘চুজ অ্যান্ড পিক’ নীতির ওপর নির্ভর করে নেতৃত্ব নির্বাচন করলে রাজনৈতিক দলগুলোর বিভিন্ন স্তরের কমিটিগুলোতে প্রভাব বজায় রাখতে নেতার স্ত্রী-সন্তানদের বড় পদে বসিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়। ফলে তাদের প্রভাব ও দাপটের কাছে অনেক যোগ্য ও ত্যাগী নেতা বঞ্চিত হয়ে রাজনীতির প্রতি অনীহা দেখান বা নিজেকে সরিয়ে নেন। অবশ্য কাউন্সিলের মাধ্যমে নেতৃত্ব নির্বাচন করলে এ সঙ্কট থেকে অনেকটা বেরিয়ে আসা যায়। কিন্তু উপমহাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কাউন্সিলের মাধ্যমে নেতা নির্বাচনের সংস্কৃতি নেই বললেই চলে।
আসল কথা হচ্ছে, প্রতিটি রাজনৈতিক দলেরই একটি আদর্শ আছে। রাষ্ট্রকে সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য প্রয়োজন আদর্শিক রাজনৈতিক দল যে দলকে দক্ষ, যোগ্য ও মেধাবী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা পরিচালনা করবেন। দেশ ও দেশের জনগণের প্রতি সেবার মন নিয়ে রাজনীতি না করতে পারলে ধীরে ধীরে রাজনৈতিক সংস্কৃতির আসল রূপটি আমাদের কাছ থেকে হারিয়ে যাবে। একটি দেশকে সঠিক ধারায় পরিচালিত করতে রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র মুখ্য নয়, প্রয়োজন দক্ষ সংগঠক এবং যোগ্য নেতৃত্ব। হ
লেখক : সদস্য, জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দল, কেন্দ্রীয় কমিটি

 


আরো সংবাদ



premium cement
আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিককে পঙ্গু করে রেখেছিল : ড. মাসুদ সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্রের বাড়িতে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ৩ পল্লী উন্নয়ন অ্যাকাডেমি থেকে বাদ গেল শেখ পরিবারের নাম বইমেলায় ৮ ও ১৫ ফেব্রুয়ারি সময় পরিবর্তন হচ্ছে, থাকছে না শিশুপ্রহর রাখাইন স্টেট : ঘুমধুমে স্থলবন্দর করার চিন্তা করছে সরকার ফ্যাসিবাদ উৎখাত করেছে ছাত্ররা আর তাদের সাহস জুগিয়েছেন শিক্ষকরা মশিউর রহমানের নতুন বই ‘টেকসই সমৃদ্ধিতে আল-কুরআনের দর্শন’ পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এপ্রিলে ঢাকা সফর করতে পারেন : তৌহিদ আ’লীগের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বাড়িতে বিক্ষুব্ধ জনতার আগুন প্রবীণ সাংবাদিকদের জন্য মাসিক ভাতা আগামী বছর থেকে : মুহাম্মদ আবদুল্লাহ শেখ হাসিনার ডক্টরেট ডিগ্রি নিয়ে অনুসন্ধান করবে দুদক

সকল