আলতা বানুর ডেঙ্গু ভাবনা
- জান্নাতুল বুশরা
- ২৭ আগস্ট ২০১৯, ০০:০০
প্রাতঃকালে ফার্মগেট গমন করিবার প্রাক্কালে এক অভিনব দৃশ্যের অবতারণা করিল। দ্বিতল বাসে না উঠিলে এই দৃশ্য কখনই তাহার চোখে পড়িত না। তাহার সুশীল ভাবনারও বিকাশ হইত না। ভূমি হইতে ইহার দৃশ্য দেখা যায় না, একখানা বিরাট উঁচু দেয়ালের কারণে। দৃশটি একটি কন্সট্রাকশন সাইটের। উন্নয়নের জোয়ারে প্লাবিত বঙ্গদেশে এখন ভবনের চাইতে নির্মাণাধীন ভবন, আর সচল সড়কের চাইতে সংস্কারাধীন সড়কের সংখ্যাই বেশি। যাহার ফলে শাহবাগ হইতে ফার্মগেট আসিতে লাগিল মাত্র এক ঘণ্টা। তাও সকাল পৌনে আটটা বলিয়া কথা। নইলে শাহবাগ হইতে ফার্মগেট এক ঘণ্টাই আসিতে পারা চাট্টিঘানি কথা? কোন কথা হইতে কোন কথায় আসিয়া পড়িলাম। তবে আলতা বানু এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী কি না। কাজের কথার আশপাশে আরো অনেক প্রাসঙ্গিক, উপপ্রাসঙ্গিক কিংবা একেবারে না-প্রাসঙ্গিক কথাবার্তা বলাই সে এখন তাহার কর্তব্য কাজ বলিয়া মনে করে। বাচাল সে সর্বকালেই ছিল। এখন পার্থক্য হইল, পূর্বে যাহা বাচালতা ছিল; হালে তাহা মুক্তচিন্তায় রূপ হইয়াছে। সকল চিন্তাই মুক্ত চিন্তা হইতে পারে। শুধু শর্ত থাকে যে, তাহা অবশ্যই ধর্মচিন্তা হইতে পারিবে না। কথায় কথায় আসল কথা হারাইয়া ফেলিলাম। উন্নয়নের জোয়ারে প্লাবিত এই দেশের একটি কনস্ট্রাকশন সাইটে আলতা বানু দেখিল যে, সকল কর্মী সারিবদ্ধ হইয়া শারীরিক কসরত করিতেছে। সাইটে যে সকল মাস্টার ইঞ্জিনিয়ার থাকিয়া থাকেন, তাহারা হয় জাপানি না হয় কোরীয় হইবে, এত দূর হইতে তাহাদের জাতীয়তা নির্ণয় করা সত্যিই দুরূহ ব্যাপারই বটে। কিন্তু বিষয় তাহা নহে। বিষয় হইতেছে পরের দেশে কার্য সম্পাদন করিতে আসিয়াও তাহারা কত কর্তব্যপরায়ণ। কাজ করিবার সময় যাহাতে অলসতা না আসে এবং ফুরতি থাকে তাহা নিশ্চিত করিতে এই কসরত। সকলের সমক্ষে পরদেশী ঊর্ধ্বতনেরা কিছু বলিলেন। কী বলিলেন তাহা আলতা বানুর কর্ণকূহরে পোঁছাইতে পারিল না। আন্দাজ করা যায়, যাহাই বলিয়াছেন, তাহা যে কর্মীদের লাগিয়া উদ্দীপনামূলক ছিল; তাহা পর মুহূর্তেই বুঝে আসিল; যখন কর্মিগণ হস্ত ঊর্ধ্বে তুলিয়া সমস্বরে সম্মতি জানাইল। ইহার পর তাহারা ফের দলে দলে বিভক্ত হইয়া বিস্তর শলাপরামর্শ করিয়া তবেই মাঠে নামিল দিনের কার্য সম্পাদন করিতে। আহ্! কী সুন্দর শৃঙ্খলা। এই দৃশ্য আলতা বানুকে বড়ই প্রীত করিল।
গত কয়েক দিন ধরিয়া ডেঙ্গুর মতো সিরিয়াস বিষয় নিয়াও কর্তৃপক্ষের যেরূপ প্রয়াস দেখিয়া আসিয়াছে, তাহাতে কন্সট্রাকশন সাইটে এরূপ শৃঙ্খলা তাহার একেবারেই মানানসই লাগিতেছে না। এই স্থাপনা বানাইতে দেরি হইলে তো কাহারো মৃত্যু হইবে না। অবশ্য তাহাদের কথা আর কি বলিবে, এই তো বেশিদিন হয় নাই, খবর হইয়াছিল যখন এক জাপানি কোম্পানি একটি স্থাপনা নির্ধারিত সময়ের আগেই সম্পন্ন করিয়া বাঁচিয়া যাওয়া কয়েক কোটি অর্থ আমাদের সরকারকে ফিরাইয়া দিয়াছিল। তাহাদের মতো হাদারাম জাতি কিরূপে সারা বিশ্বে একটি উন্নত জাতি হইতে পারিল তাহা আলতা বানুর মাথায় আসিতেছে না। তাহাদের অপেক্ষা এই দেশের ঠিকাদাররাও অধিক বুদ্ধিমান, তাহারা জানে কিভাবে কাজ আটকাইয়া উপরি আয় করা যায়। না হইলে তাহারা হালের ডেঙ্গু নিধন কর্মসূচি লক্ষ্য করিয়াই দেখুক না, কিরূপে কত অল্প কাজ করিয়া শুধু ফটোসেশনের মাধ্যমেই ডেঙ্গু তাড়ানো যায়।
সেই দিন আলতা বানু ‘মুখবই’তে একখানা ফটো দেখিয়া তাজ্জব বনিয়া গিয়াছে। একজন মন্ত্রী টিভি-সিনেমার তারকাদিগকে লইয়া ডেঙ্গু নিধনে মালকোচা মারিয়া নামিয়াছেন। সেইখানে তাহারা একই জায়গায় হালি চারেক লোক ঠেলাঠেলি করিয়া, একটি ঝাড়ু দুইজনে ধরিয়া মধ্যসড়কে গোধূলি লগ্নের ধুলা উড়াইতে ছিলেন, নাকি এডিস শমা তাড়াইতেছিল তাহা ঠাহর করা যাইতেছিল না। সেইখানে তাহার ফেবারিট নায়িকা রূপবানও উপস্থিত ছিলেন। তাহাকে দেখিয়াই তো আলতা বানুর বিশ্বাস হইল যে, এডিস মশকি এখন জমিয়া থাকা পানি ছাড়িয়া মধ্যসড়কের ধুলায় গড়াগড়ি খাইতেছে। তাহাকে ঝাড়ু দিয়া ঝাটাপিটা করিয়া বিদেয় না করিলে মশকবাহিনী সরিবার নহি।
এ দিকে তাহাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচাইতে বড় স্যার বলিয়াছেন, ডেঙ্গু পরিস্থিতি স্বাভাবিক রহিয়াছে। আক্রান্তের সংখা মাত্র পাঁচজন, যাহা খুবই স্বাভাবিক। কারণ, এই দেশ ট্রপিকাল হাওয়ার এইরূপ ডেঙ্গু খুব স্বাভাবিক। তাই তিনি কাজ একটু বিলম্বেই শুরু করিয়াছেন। স্যার ডেঙ্গু নিধনে বদ্ধ পরিকর হইয়া ক্যাম্পাসে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযানে নামিয়া ছিলেন। ছেলেমেয়েরা একেবারেই একরোখা, বেআদব। ‘মশকি নিধনের ওষুধ কই?’ হেথায় হোথায় জমিয়া থাকা পানি, ময়লা, এমনকি এডিস মশকি মারিয়া তাহারও ফটো তুলিয়া ‘মুখবই’তে দিয়া পরিস্থিতি উত্তাল করিয়া রাখিয়াছে।
এইসব শিক্ষার্থী কোনো কাজের না, সারা বছর খালি আন্দোলন। এত কিসের দাবি, হ্যাঁ? সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের একান্ত অনুগত, মেধাবী শিক্ষার্থী, খাঁটি দেশপ্রেমিক, জাতির কাণ্ডারি বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষার্থী কর্তৃক বিপুল ভোটে নির্বাচিত সোনার ছেলে নামে খ্যাত দলভুক্ত প্রতিনিধিগণ ও তাহাদের বিশ্বস্ত সমর্থকগণ এইরূপ প্রতিক্রিয়াই ব্যক্ত করিতেছেন। তাহাদের কথা শুনিয়া আলতা বানুর টনক নড়িল। আসলেই তো, কত শখ ছিল তাহার,বিশ্ববিদ্যালয়ে উঠিয়াছে, সারাদিন খালি এইখানে ওইখানে প্রজাপতি হয়ে ডানা মেলিয়া উড়িয়া বেড়াইবে। তা না, আন্দোলনের লাগিয়া কোনো কিছুই করিয়া উঠিতে পারিতেছে না। এই তো কয়েক দিন আগেও ডেঙ্গু জ্বরে মৃত গ্র্যাজুয়েটের জানাজা ক্যাম্পাসে পড়িবার অনুমতি দেন নাই বলিয়া কত আন্দোলন করিল। তাহারা কী জানে? এই সামান্য জ্বরে মৃতের জানাজা পড়াইয়া যদি নিউজ হয়; তবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশের কী মান মর্যাদা থাকিবে? একজন গ্র্যাজুয়েটের পিতামাতার কান্নার চাইতে দেশের মর্যাদা কি বড় নয়? ধিক! বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়াও বৃহৎ স্বার্থে চিন্তা করিতে শিখিল না। যদিও দুনিয়ার সব চাইতে ক্ষমতাধর দেশের রাষ্ট্রপতির নিকট নিজের দেশ লইয়া, মানুষ লইয়া, ইতিহাস বিকৃত করিয়া মিথ্যাচার করিলে দেশের মান ক্ষুণœ হয় না। বরং স্বপ্নের দেশের সিটিজেনশিপ মিলে। কিন্তু দেশের সনামধন্য এক নারী বয়াতি কাম এমপি যতই বলুন না কেন ‘ডেঙ্গু গুজব। লোকে কেবল জ্বর হইলেই ডেঙ্গু ভাবে।’ তবে যা রটে তাহার কিছু হইলেও বটে। সে কারণে গুজব হইলেও ডেঙ্গু লইয়া আলতা বানুর ভয়ের সীমা-পরিসীমা নাই। তাহার প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি হলে হলে ডেঙ্গু ছড়াইতেছে। তাহার কক্ষেও একজন আক্রান্ত হইয়াছে। বড় শখ করিয়া আলতা বানু হলে উঠিয়াছিল, হলে না থাকিলে নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের আধা জ্ঞানভাণ্ডারই অর্জন হয় না। কিন্তু এডিস মশকি আতঙ্কে তাহার রাত্রির ঘুম হারাম হওয়ার দশা। ডাক্তারগণ বলিতেছেন, এখন জ্বর হইলেই তাহাদের সহিত পরামর্শ করিবেন। ভাবিবেন না ইহা সাধারণ। আলতা বানুরও মাথা ব্যাথা। গাত্র ব্যথা। ডেঙ্গু আতঙ্কে আলতা বানু ভয়ে সারা দিন গাত্রে নারিকেল তৈল মাখিয়া বসিয়া থাকে। এই দিকে মেয়রের বয়ান, আপনারা সাবধান থাকুন বেশি বেশি কাপড় বোরকা নেকাব পড়িয়া, মশকি যাতে কামড়াইতে না পারে। বেশি ধোঁয়া দিলে সারা দেশে এমনকি পাশের বন্ধু দেশেও মশকি ছড়াইয়া যাইতে পারে। অলরেডি বিচার আসিয়া পড়িয়াছে। তাই ধোঁয়া বেশি ব্যবহার করা যাইবে না। আপনারা তো আগেই দেখিয়াছেন কিরূপে মশকির ধোঁয়া দিলে উত্তরের মশা দক্ষিণে যায় আর দক্ষিণের গুলি উত্তরে যায়। তাই প্রয়োজনে বোরকা নেকাব পড়িয়া কামড় হইতে বাঁচিয়া থাকুন।’ এই কথা আলতা বানুর মনঃপূত না। মানে বোরকা পরিধান করিবার বিষয়টা। পোশাকটি নারী স্বাধীনতার অন্তরায়। মরিয়া গেলেও ইহা আলতা বানু সমর্থন করিতে পারে না। আফটার অল শি ইজ অ্যা সেকুলার সিটিজেন। সে নাস্তিক নহে; আবার কট্টর ধার্মিকও নহে। আজান শুনিলে মাথায় কাপড় দেয়, শবে কদর, শবে বরাতে নামাজও আদায় করে, আবার পরীক্ষার প্রাক্কালে বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদে গিয়া পরম করুণাময়ের কাছে দয়া ভিক্ষাও মাগে। কিন্তু ধর্ম নিয়া বাড়াবাড়ি তাহার পছন্দ নহে। এই ক্যাম্পাসে আসিবার পর দেখিল, হিজাবি মেয়েদের দারুণ কদর। একখানা টাইটেলও পাইল, ফ্যাশনও করিতে পারিল, মন চাহিলে হিজাব খুলিয়াও ফেলিতে পারে। বেশির ভাগ সময় হিজাব পরিধান করে বলিয়া সকলের পছন্দের পাত্রীও হইল। কিন্তু বোরকা-নেকাব? না না, মশকি থাকিয়া বাঁচিবার তরেও সে তাহা তাহার অঙ্গে জড়াইতে পারিবে না। আলতা বানুর আরেক সহপাঠীও আক্রান্ত, তাহাকে ডাক্তার বলিয়াছে ‘ঢাকায় আর টেস্ট-চিকিৎসা হইবে না, বাড়ি গিয়া বিশ্রাম লও’, হাসপাতালে জায়গা নাই, রিপোর্ট দেয়ার লোক নাই, রক্ত দেয়ার লোকও নাই, সকলেই অসুস্থ, ইন্টার্ন ডাক্তারদিগের ছুটি নাই, ওষুধ, মশারির দাম বাড়িয়াছে কয়েক গুণ, কাহারো পৌষ মাস, কাহারো সর্বনাশ। তাই আলতা বানু এখন প্রার্থনা করে, আল্লাহ ডেঙ্গু দূর করিয়া দাও। ইস! বাঙালি যদি শৃঙ্খলাবদ্ধ হইত, তা হইলে দেশটা পরিষ্কার রাখিত। তবে তিন দিনের জমিয়া থাকা পানিতে এডিস মশকির বংশবিস্তার রোধ হইত, আলাদা করিয়া মশককে ধরিয়া ক্ষমতা নষ্ট করিয়া প্রকৃতিতে ছাড়িয়া দিবার কথা ভাবিতেও হইত না। হ
লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
(এটি সাধুভাষায় লিখিত)
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা